আবারও ভারতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক

সেঞ্চুরি করেছেন পন্ত।
ছবি: বিসিসিআই

মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচ চলছে আহমেদাবাদে। চতুর্থ টেস্টটি শুধু সিরিজের ভাগ্যই নির্ধারণ করে দেবে না, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালিস্টও ঠিক করে দেবে। এই টেস্টে হার এড়াতে পারলেই সিরিজ জিতবে ভারত। সেই সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলবে দলটি। ওদিকে ইংল্যান্ড টেস্ট জিতে নিলে সিরিজ সমতায় শেষ হবে। আর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে যাবে অস্ট্রেলিয়া। এমন এক ম্যাচেই আবারও হাজির হলো আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক।

প্রথম ইনিংসে ২০৫ রানে অলআউট হয়েও ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরেছিল ইংল্যান্ড। আজ দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ধৈর্যের প্রতিমূর্তি চেতেশ্বর পূজারাকে ফিরিয়ে দিয়ে যে আশা জাগিয়েছিল ইংল্যান্ড, সেটা পূর্ণতা পেয়েছে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি শূন্য রানে ফেরায়। একপর্যায়ে ১৪৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ভারত। কিন্তু ঋষভ পন্তের ১০১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস ভারতকে দিন শেষে এগিয়ে রেখেছে। ৩ উইকেট হাতে ৮৯ রানে এগিয়ে আছে স্বাগতিক দল।

অথচ আজ হয়তো লিড নিয়েই দিন শেষ করতে পারত ইংল্যান্ডও। কিন্তু বিতর্কিত এক আম্পায়ারিং সেটা হতে দেয়নি।

এই সেই সিদ্ধান্ত।
ছবি: টুইটার

১১৫ বলে সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন পন্ত। মাত্র দ্বিতীয় উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করেছেন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারতের মাটিতে। যেভাবে খেলছেন, তাতে এ কীর্তির প্রথম ব্যক্তি অ্যাডাম গিলক্রিস্টের একজন উত্তরসূরি বিশ্ব ক্রিকেট পেয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। সৌরভ গাঙ্গুলী তো তাঁকে ঘিরে অনেক বড় স্বপ্ন দেখার কথাই বলছেন। কিন্তু এই ইনিংসটা ৩৫ রানেই থেমে যেতে পারত।

ভারতের রান তখন ১৫২। পন্ত ও ওয়াশিংটন সুন্দরের জুটিতে এসেছে মাত্র ৬ রান। এমন সময় অফ স্পিনার ডম বেসের একটি বল পন্তের প্যাডে আঘাত হানে। জোরাল আবেদন করে ইংল্যান্ড। কিন্তু আম্পায়ার নিতিন মেনন সাড়া দিলেন না। রিভিউ নিয়ে নেন ইংলিশ অধিনায়ক। রিপ্লেতে দেখা গেছে বল বেলে লাগত। কিন্তু যেহেতু আম্পায়ার আউট দেননি, ‘আম্পায়ার্স কল’ হিসেবে সে যাত্রায় বেঁচে যান পন্ত। সে ধাক্কা সামলে দ্রুতই ফিফটি পেরিয়ে যান পন্ত। ফিফটির পর আরও আগ্রাসী হয়ে উঠে মাত্র ৩৩ বল পরই পেয়ে যান সেঞ্চুরি।

পন্তের ইনিংসে ম্যাচের গতি বদলে যাওয়াতেই তাঁর ওভাবে বেঁচে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, পন্তের একটু আগেই রোহিত শর্মা এলবিডব্লু হয়েছিলেন। সেবারও রিভিউতে দেখা গেছে, বেলে লাগবে বল। কিন্তু সেবার আম্পায়ার আউট দেওয়াতে কপাল পুড়েছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানের। ফক্স ক্রিকেটে এ ম্যাচে ধারাভাষ্য প্যানেলে থাকা মার্ক ওয়াহ, প্যাট কামিন্স ও ইসা গুহ দুই ক্ষেত্রে দুই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্ময় লুকাননি।

বলের পঞ্চাশভাগ স্টাম্পের ওপরের দাগের নিচে ছিল না বলেই আম্পায়ার্স কল দেওয়া হয়েছিল।
ছবি: টুইটার

পন্ত বেঁচে যাওয়ার পর ওয়াহ বলে বসেন, ‘অ্যাঁ? ওহ, না। এটা তো আউট ছিল!’

অস্ট্রেলিয়ান পেসার কামিন্স ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, ‘ছোট পার্থক্য, তারা বলের পঞ্চাশ ভাগের হিসাবটা বেলের ওপর অংশ থেকে মাপে না। তারা স্টাম্পের ওপর ভাগ থেকে বলের পঞ্চাশ ভাগের হিসাব করে।’ ইংলিশ সাবেক নারী ক্রিকেটার ইসা গুহ যোগ করেন, ‘যেটা বেলের ওপর ভাগ হওয়া উচিত। বোলারদের জন্য এটা খুবই বিরক্তিকর।’

তাঁদের এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়মকানুনের আলোচনা ভালো লাগেনি মার্ক ওয়াহর। সাবেক ব্যাটসম্যানের পরিষ্কার কথা, সাদা চোখে যা দেখে আউট মনে হচ্ছে, সেটা আউট দেওয়াই উচিত। এর জন্য ‘আম্পায়ার্স কল’ নামে কিছুর অপেক্ষায় রাজি নন তিনি, ‘এটা প্রতিদিন (প্রতি ক্ষেত্রে) আউট।’

কামিন্স বোঝাচ্ছিলেন, দুই দলের জন্যই একই নিয়ম। তবে এতে যে খেলায় এলবিডব্লুর সিদ্ধান্ত পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সেটাও স্বীকার করেছেন এই ফাস্ট বোলার, ‘একজন ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লু করতে হলে স্টাম্পে লাগাতে হয়। কিন্তু রিপ্লেতে স্টাম্পে লাগবে দেখানোর পরও দেখা যাচ্ছে তারা আউট হচ্ছে না। এর ফলে স্টাম্পে বল লাগানোর জায়গাটা খুব কমে আসছে। এখন তো লম্বা ব্যাটসম্যান হলে হাফভলি বল করতে হয়, নয়তো একদম স্টাম্প বরাবর বল করতে হয়।’

ম্যাচের গল্প বদলে দিয়েছেন পন্ত।
ছবি: বিসিসিআই

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে জোর আলোচনা। অনেকেই বলছেন পন্তকে যদি আউট না দেওয়া হয়, তবে রোহিত কিংবা গতকাল জনি বেয়ারস্টোকে আউট দেওয়াটা অন্যায়। আবার এই দুজনের চেয়ে পন্তকেই খালি চোখে বেশি আউট বলে মনে হচ্ছিল। সৌরভ মালহোত্রা নামের এক ক্রিকেট অনুরাগী বলেছেন, ‘পন্তরটা রোহিতের চেয়ে বেশি আউট ছিল। কিন্তু ডিআরএস তো এমনই। আম্পায়ারদের বেশি মহান মনে করায় এটা।’

জ্যাক মেন্ডেল নামের আরেকজন বলেছেন, ‘দুঃখিত, বেয়ারস্টো বা শর্মা কাউকেই এলবিডব্লু দেওয়া ঠিক হয়নি। প্রথমেই তাঁদের আউট দেওয়া ঠিক হয়নি। খুবই সূক্ষ্ম ছিল। আর যেখানে এই দুজনকে মাঠে আউট দেওয়া উচিত হয়নি, সেখানে বেসের বলে পন্ত আউট দেওয়া উচিত ছিল। আম্পায়ার্স কল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ঝামেলা সৃষ্টি করছে।’

ডেইলি মেইলের ক্রিকেট প্রতিবেদক পল নিউম্যানের কণ্ঠেও একই সুর, ‘বেয়ারস্টো এবং রোহিতের চেয়ে আমার মতে এটাই (পন্ত) বেশি আউট ছিল। এবার মেনন ব্যাটসম্যানের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং পন্ত বেঁচে গেলেন...আমার মনে হচ্ছে এটা অনেক বড় কিছু হতে পারে।’ এর আগেও আম্পায়ার্স কল বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে রোহিত শর্মা ও অজিঙ্কা রাহানেকে নটআউট দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। পরদিনই জো রুটকে সবাই নিশ্চিত আউট ভেবে নিলেও মাঠের আম্পায়ার নটআউট দেওয়ায় বিতর্কিতভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন রুট।

ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরেও আম্পায়ার্স কল ভুগিয়েছে। সেখানেও দুই ক্ষেত্রে আম্পায়ার্স কলের কারণে ভিন্ন দুটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তৃতীয় আম্পায়ার; যা দেখে শচীন টেন্ডুলকারও ক্রিকেট থেকে এই বিতর্কিত বিষয়টি বাতিল করে দিতে বলেছেন, ‘একবার তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে যাওয়ার পর মাঠে কী সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, সেটা একদমই মাথায় রাখা উচিত নয়। বল স্টাম্পে ১০ ভাগ লাগল নাকি ১৫ ভাগ লাগল, সেটা ব্যাপার নয়। কারণ, যখন বোল্ড হন, তখন এ নিয়ে (বলের কত ভাগ লেগেছে) কেউ কথা বলে না।’

এমসিসির বিশ্ব ক্রিকেট কমিটিতেও কদিন আগে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া এই কমিটি ক্রিকেট থেকে আম্পায়ার্স কল বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। আইসিসির কাছে তাঁদের পক্ষ থেকে এটা তুলে নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কথা, একই বল তৃতীয় আম্পায়ার একবার আউট, আরেকবার নটআউট দিতে পারেন না। আর সেটা দূর করতে হলে মাঠের আম্পায়ার কোন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেটা ভুলে যাওয়াই ভালো।