আবু জায়েদ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন, বিশ্বজুড়েই এখন সুইং বোলারদের দুর্দিন

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দলে নেই আবু জায়েদফাইল ছবি

ইবাদত হোসেনের বলটি ক্রিজের ৬ মিটার লেংথ থেকে লাফিয়ে উইকেটকিপার লিটন দাসের গ্লাভসে। ব্যাটসম্যান ডিন এলগার গতি ও বাউন্স দেখে একটু যেন চমকেই গেলেন। ইবাদত কিছুক্ষণ এলগারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে চোখ ফেরালেন ডারবানের ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের দিকে। সেখানে ভেসে উঠল বলটির গতি—ঘণ্টায় ১৪২ কিলোমিটার। ঠিক তখনই স্টাম্প মাইকে কোনো এক স্লিপ ফিল্ডারের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আর তাকাইস না। ভুইলা যা। ওই বল গেসেগা। পরেরটা নিয়া ভাব।’

আরও পড়ুন

ফাস্ট বোলারদের এই ‘নিড ফর স্পিড’–এর বিষয়টি ওয়াসিম আকরামের একটি ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে যায়। ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক পাকিস্তানি পেসার বলেছিলেন, ‘স্পিড গান সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। সবাই জোরে বল করেই খুব রোমাঞ্চ অনুভব করে। এখন বোলারদের দেখি বল করেই স্পিড গানের দিকে তাকায়। আমরা কখনো এসব নিয়ে চিন্তাও করিনি। স্পিড গান আসলে সুইং মেরে ফেলছে।’

বাংলাদেশের পাঁচ পেসার (বাঁ থেকে) রেজাউর রহমান, খালেদ আহমেদ, আবু জায়েদ, শহীদুল ইসলাম ও ইবাদত হোসেন। গতির কারণে টেস্ট দলে জায়েদের ভূমিকা কমে গেছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ব ক্রিকেটের বর্তমান প্রবণতার দিকে একটু মনোযাগ দিয়ে তাকালেই ওয়াসিমের ১৮ বছর আগের কথাটার সত্যতা পাওয়া যায়। সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ তো বাংলাদেশেই। গত দুই বছরে বাংলাদেশে একঝাঁক পেসার ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যার শুরুটা হয়েছিল আবু জায়েদকে দিয়ে। এর পর থেকে ইবাদত হোসেন, খালেদ আহমেদ, শরীফুল ইসলামদের আগমনে সমৃদ্ধ হতে থাকে পেস আক্রমণ। নিজেকে শুধরে ফিরে আসেন তাসকিন আহমেদও।

টেস্টের জন্য একসঙ্গে এত পেস বোলার আগে পায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু যাঁকে দিয়ে এই পেস–বিপ্লবের শুরু, সেই আবু জায়েদ বাদ পড়ে গেছেন দল থেকে। তাঁর বদলে দলে নেওয়া হয়েছে তরুণ রেজাউর রহমানকে।

জায়েদ সুইং বোলার। বল করে ইবাদতের মতো বিগ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার মতো গতিও তাঁর নেই। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকে তাঁর বলের গতি। ছোট ছোট সুইং ও সিম মুভমেন্টের সঙ্গে ব্যাটসম্যানকে পড়ার দক্ষতা জায়েদের শক্তি।

ভুবনেশ্বর কুমারকে এখন টেস্ট দলে দেখাই যায় না
ফাইল ছবি: এএফপি

কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনা—জায়েদের এই দক্ষতা ম্যাচের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই কার্যকর ধরা হয়। বল পুরোনো হয়ে গেলে জায়েদ আর খুব একটা কার্যকর থাকেন না। যে কারণে জায়েদকে বাদ দিয়ে দীর্ঘদেহী ও গতিময় বোলারের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। কারণ, ফ্ল্যাট উইকেটে গতিময় ও দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলারই বেশি কার্যকর।

আরও পড়ুন

গত কয়েক বছরে সুইংয়ের চেয়ে গতিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াও। ভুবনেশ্বর কুমারের কথাই ধরুন। যশপ্রীত বুমরা, মোহাম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, মোহাম্মদ সিরাজ, নবদ্বীপ সাইনিদের মতো ১৪০/১৪৫ কিলোমিটার গতির বোলারদের ভিড়ে ভুবনেশ্বরের সুইংয়ের জায়াগা কই! ভারতীয় টেস্ট দলে তাই দুর্দান্ত এই সুইং বোলার সুযোগই পাচ্ছেন না।

মোহাম্মদ আব্বাসের টেস্ট গড় ২৩। ২৫ টেস্ট খেলে এর মধ্যেই ৯০ উইকেটের মালিক এই পাকিস্তানি সিমার। কিন্তু সুইং বোলার হওয়াতে আব্বাসের গতিও কম। শাহিন শাহ আফ্রিদি ও নাসিম শাহর গতিতে তো তিনি বল করেন না। যে কারণে পাকিস্তান টেস্ট দলেও তিনি নিয়মিত নন। ঘরের মাঠে খেলা হলে আরও না। আব্বাস সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন ২০২১ সালের আগস্টে।

পাকিস্তান দলে জায়গা হচ্ছে না মোহাম্মদ আব্বাসের
ফাইল ছবি: এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার চ্যাড সায়ের্স ও মাইকেল নেসারও একই ধাঁচের বোলার। দুজনই অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলে নিয়মিত। যে কোনো টেস্ট সিরিজের দলে দুজনের একজনের নাম থাকবেই। কিন্তু দুজনের কপালে জুটেছে একটি টেস্ট ম্যাচ। কারণ জস হ্যাজলউড, প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, স্কট বোল্যান্ড, জাই রিচার্ডসন—প্রত্যেকেই সায়ের্স ও নেসারের চেয়ে গতিতে এগিয়ে। নিয়ন্ত্রিত গতি এখন যুগের চাহিদা। বোলিং মেশিনের মতো নিখুঁত লাইন-লেন্থের সঙ্গে ঘন্টায় ৯০ মাইল বেগের গতির মিশ্রণ ব্যাটসম্যানের জন্য শ্বাসরোধী অবস্থা তৈরি করার জন্য আদর্শ। যদি হাতে থাকে গতি ও নিয়ন্ত্রণ, তাহলে সুইংয়ের কি দরকার!

ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড অবশ্য ব্যতিক্রম। তবে ক্রিকেটের মৃতপ্রায় আর্ট সুইং এই দুই দেশে এখনো বহাল তবিয়তে আছে একমাত্র কন্ডিশনের কারণে। জিমি অ্যান্ডারসন ও টিম সাউদির মতো আউটসুইং বোলার এখন নেই বললেই চলে। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে দুজনই ভয়ঙ্কর বোলার। গতি কম হলেও সুইং ও নিয়ন্ত্রণ দিয়ে সেটি পুষিয়ে দেওয়ায় দুজন কতোটা দক্ষ, সেটা তো তাঁদের রেকর্ডেই স্পষ্ট। তবে দুজনই তাদের ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ে আছেন। অ্যান্ডারসন–সাউদি বিদায়ের পর তাঁদের মতো সুইং বোলার আসবে কি না, সেটি আসলেই খুব কৌতূহলের বিষয়।