আরও একবার রুট ও বাকি দশজন

রুট পঞ্চাশ করলেও ইংল্যান্ডকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেননিছবি: রয়টার্স

দুদিনও হয়নি সাবেক ইংল্যান্ডের সাবেক স্পিনার মন্টি পানেসার বলেছিলেন কথাটা।

বছরজুড়ে টেস্টে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং মানে তো জো রুটের দাপটই। মেলবোর্নে আজ অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগেই বছরে টেস্টে ১৬০০ রানের বেশি হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড অধিনায়কের।

কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে সেভাবে সমর্থন রুট পাচ্ছেন না বোঝাতে পানেসার বলেছিলেন, ‘গত এক বছরে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (বছরে মোট রানের তালিকায়) দ্বিতীয় যিনি, তার রান ৫০০-র মতো, তার মানে রুটের সঙ্গে অন্যদের ব্যবধান হয়ে গেছে ১০০০ রানের মতো। জো রুট সব সময় একাই ইংল্যান্ডকে কিছুটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।’

মেলবোর্নে আজ ‘বক্সিং ডে’ টেস্টেও ব্যতিক্রম হলো না। আরও একবার সেই ‘রুট ও বাকি দশজন’ই হয়ে থাকল ইংল্যান্ডের ব্যাটিং। তবে এবার আর রুটও ইংল্যান্ডকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেননি।

রুট অর্ধশতক করেই আউট হয়ে গেছেন, বাকি দশজন মিলে করেছেন ১৩৫ রান। ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে গেছে ১৮৫ রানে! প্রথম দিনটিকে পুরোপুরি নিজেদের করে নেওয়ার পথে অস্ট্রেলিয়া দিন শেষ করেছে ১ উইকেটে ৬১ রান নিয়ে। দিন শেষ হওয়ার ১১ বল আগে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নারকে হারানোই যা একটু অতৃপ্তি হয়ে থাকবে অস্ট্রেলিয়ার!

ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টের পর অ্যাডিলেডে দিবা-রাত্রির টেস্টেও অস্ট্রেলিয়ার দাপটের সামনে খুঁজে পাওয়া যায়নি ইংল্যান্ডকে। কোন কোন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে ইংলিশদের, সে ব্যাখ্যায় খুব সহজেই উত্তরটা দিয়ে দেওয়া যায়। ব্যাটিংয়ে রান পাচ্ছে না ইংল্যান্ড—বিশেষ করে টপ অর্ডার, বোলিংয়ে উইকেট ফেলতে পারছে না, ফিল্ডিংয়েও মাঝেমধ্যে হাত ফসকে যাচ্ছে ক্যাচ।

সব মিলিয়েই আজ পাঁচ টেস্টের সিরিজের তৃতীয় টেস্ট হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের জন্য বাঁচা-মরার। সর্বশেষ অ্যাশেজে জেতা অস্ট্রেলিয়া এই ম্যাচ ড্র করলেই যে অ্যাশেজের ‘ছাইদানি’ ঘরে রেখে দেওয়ার অধিকার পেয়ে যাবে! সেই টেস্টের প্রথম দিন শেষে ইংল্যান্ডের পালানোর পথ খোঁজার দশা।

রুটের মতো স্টোকসও উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন
ছবি: রয়টার্স

এই টেস্টের জন্য অনেক ভেবেচিন্তে দলে চার বদল এনেছে ইংল্যান্ড। রানখরায় ভুগতে থাকা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ররি বার্নসের বদলে এসেছেন জ্যাক ক্রলি, ইনিংসের মাঝে ভরসা দিতে ওলি পোপের বদলে ডাকা হয়েছে জনি বেয়ারস্টোকে, পেসার ক্রিস ওকসের বদলে এসেছেন স্পিনার জ্যাক লিচ আর স্টুয়ার্ট ব্রডকে বসিয়ে রেখে ইংল্যান্ড খেলিয়েছে ক্রিস উডকে। ব্যাটিংয়ে বদলগুলো কোনো কাজেই এল না!

১৮৫ রানে অলআউট হওয়ার পর ব্যাটিংয়ে বিশেষ বিশ্লেষণের কিছু আর থাকে না। করোনার আইসোলেশনের কারণে দ্বিতীয় টেস্টে না খেলা অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক ও পেসার প্যাট কামিন্স এই টেস্টে ফিরেছেন, তাঁর পাশাপাশি লায়ন-গ্রিনরা দারুণ বোলিং করেছেন। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের ছন্নছাড়া ব্যাটিং তাঁদের কাজটা আরও সহজ করে দিয়েছে।

টপ অর্ডার আরও একবার ব্যর্থ ইংল্যান্ডের। রুট-স্টোকস-বেয়ারস্টোর মিডল অর্ডার উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছে অর্থহীন শটে। উইকেটকিপার জস বাটলার নিচের সারির ব্যাটসম্যানদের নিয়ে লড়বেন কি, নিজেই আউট ৩ রানে!

১৩ রানেই দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারানো ইংল্যান্ড তৃতীয় ব্যাটসম্যান ডেভিড ম্যালানকে হারিয়েছে ৬১ রানে। তিনজনই কামিন্সের শিকার। এর মধ্যে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হাসিব হামিদ রানের খাতাই খুলতে পারেননি, ‘হাঁস’ নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন।

বোল্যান্ডের প্রথম টেস্ট উইকেটের উদ্‌যাপন
ছবি: রয়টার্স

ক্রলি ও ম্যালান দুই অঙ্কে গেলেও ১৫ পেরোতে পারেননি। ইনিংস গড়ার দায়িত্ব চাপে সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে অন্তত একবার অর্ধশতকের দেখা পাওয়া দুই ব্যাটসম্যান ম্যালান ও রুটের কাঁধে। কিন্তু ম্যালানও কিছুক্ষণ পর ফিরে গেলে দায়িত্বটা রুটের কাঁধেই চাপে।

দায়িত্বটা একেবারে সামলাতে পারেননি ইংল্যান্ড অধিনায়ক, এমন বলা যাবে না। ৫০ রান করা এক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে এমন কিছু বলতে গেলে স্কোরবোর্ড চোখ পাকিয়ে তাকায়। কিন্তু উইকেটে সেট হয়ে, টেস্টে ৫৩তম অর্ধশতক পেয়ে গিয়ে যেভাবে আউট হলেন রুট, সেটি তাঁর ব্যাটিং নিয়ে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনাই বেশি করতে বাধ্য করে।

মিচেল স্টার্কের বল ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে, চতুর্থ স্টাম্পে। সেটিকে তাড়া করতে গিয়ে পেছনের পায়ের ভরে খেললেন রুট (৫০ রান)। অলস শট! পরিণতি, ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটের পেছনে ক্যাচ। ইংল্যান্ডের রান তখন ৮২, রুটসহ চার ব্যাটসম্যান আউট। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শতকে না পৌঁছাতে পারা সবচেয়ে বেশি অর্ধশতকের ‘রেকর্ড’ গড়েই ফিরলেন রুট।

অধিনায়কের দেখানো পথে ফিরেছেন ইংল্যান্ড ইনিংসে ২৫-এর ঘরে যাওয়া অন্য দুই ব্যাটসম্যান বেন স্টোকস (২৫) আর জনি বেয়ারস্টোও (৩৫)। বিশাল এক ছক্কায় পাল্টা আক্রমণের আশা জাগিয়েছিলেন স্টোকস, কিন্তু নাথান লায়নের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে পেছনের পায়ে খেলতে গিয়েই ক্যাচ দিলেন পয়েন্টে। কিছুক্ষণ পর জস বাটলারও ফিরে গেলে ৬ উইকেটে ১২৮ রান নিয়ে চা বিরতিতে যায় ইংল্যান্ড।

ওয়ার্নার ও হ্যারিস অস্ট্রেলিয়াকে উদ্বোধনী জুটিতে এনে দিয়েছেন ৫৭ রান
ছবি: রয়টার্স

চা খেয়েও আড়মোড়া ভাঙেনি তাঁদের। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষিক্ত স্কট বোল্যান্ডের প্রথম টেস্ট উইকেট হয়ে মার্ক উড ফিরলেন। এর কিছুক্ষণ পর রুট-স্টোকসের মতো সেট হয়েও উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার দোষে দুষ্ট বেয়ারস্টো আউট! স্টার্কের গায়ের দিকে ধেয়ে আসা বাউন্সারে পা ঠিকমতো সামলে নিতে পারেননি, বল তাঁর গ্লাভসে লেগে গালিতে ক্যাচ। দলের রান তখন ৮ উইকেটে ১৫৯, ইংল্যান্ডের সম্মানজনক স্কোরের আশা সেখানেই শেষ।

শেষ পর্যন্ত ওলি রবিনসনের ২২ রানে ইংল্যান্ড দুই শ-র কাছাকাছি যেতে পেরেছে, কিন্তু পেরোতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার কামিন্স ও লায়ন দুজনই ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন ৩৬ রান দিয়ে।

অল্প রানেই গুটিয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডের যদি শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে ধাক্কা দেওয়ার আশা থেকেও থাকে, সেটি হতে দিলেন না দুই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার মার্কাস হ্যারিস ও ডেভিড ওয়ার্নার। ৪২ বলে ৩৮ রান করে অ্যান্ডারসনের বলে ওয়ার্নার ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন, তবে সেটি দিনের একেবারে শেষভাগে এসে। হাতে ব্যথা পেলেও আরেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মার্কাস হ্যারিস ২০ রানে অপরাজিত, নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামা লায়ন রানের খাতা খুলতে পারেননি।