আরও ‘কষ্ট’ দিয়ে যাক অস্ট্রেলিয়া

ড্রেসিং রুম থেকে একাডেমি মাঠে যাওয়ার সময় জার্সি দিয়ে নাক ও মুখ ঢাকছেন অ্যাগার। সংবাদকর্মীরা তখন তাঁর থেকে যথেষ্ট দূরত্বে ছিলেনছবি: প্রথম আলো

অতিথি ঘরের অলংকার। অতিথির বিদায়বেলায় মুখ ভার করে ‘আর কটা দিন থেকে যান’ বলাটা বাঙালির রীতি। বিদায়বেলায় অতিথিও রীতি মেনে বলে যান, ‘কষ্ট দিয়ে গেলাম। কিছু মনে রাখবেন না।’ এসবই অতিথির বিনয়। সব অতিথি কি কষ্ট দেন?

মোটেই না। কিছু অতিথিকে ধরে রাখতে পারলে—তা যত কষ্টই হোক, মনে শান্তি লাগে। এই করোনায়, নানা পদের ঝামেলায়, সেই অতিথি-সৎকারসহযোগে আরও কিছুদিন হেসেখেলে বাঁচতে ইচ্ছা করে।

বাংলাদেশ বহুদিন পর এমন এক অতিথি পেয়েছে, যাদের আপ্যায়নে সব সময় দুয়ার খোলাই ছিল। কিন্তু গরিবের দুয়ার খোলা থাকলেই কি অভিজাতরা পা রাখেন? রাখেন না। তাঁদের তো আর ‘উঠল বাই, জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কা যাই’-এর অভ্যাস নেই। এই অতিথির নাম যে অস্ট্রেলিয়া!

অভিজাত অতিথিদের হাজারো হিসাব-নিকাশ থাকে। চাইলেই তো গরিবের চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে পা রাখা যায় না! নিরাপত্তা দেবে কে! আর দিলেই-বা কতটুকু? তাই মাঝেমধ্যেই এই অতিথিরা রাজি হয়নি বাংলাদেশে পায়ের ধুলো দিতে। এবার ধুলো ছিটানো প্রয়োজনেই, সামনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। হাত পাকাতে হাতের তালুতে রেখেই খেলা যায়, এমন প্রতিপক্ষ তো লাগে!

বাংলাদেশ সফরে এসে বিমান থেকে নামার সময়ই সাবধানতা অবলম্বন করে অস্ট্রেলিয়া দল
ছবি: বিসিবি

কিন্তু এই অভিজাত অতিথিরা একে তো ক্রিকেটের কুলীন দেশ, যেতে হচ্ছে কুলীন-কাতারের বাইরের দেশে, আতিথেয়তা কেমন হবে কে জানে! এই দুশ্চিন্তার ‘দোসর’ হিসেবে যোগ হয়েছে মহামারি করোনা। এই সময়ে পরের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গেলে একটু ছ্যা ছ্যা করতেই হয়। অস্ট্রেলিয়া দলকে তাই দোষ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে সবাই-ই তো নিজের মান আর নিরাপত্তা বজায় রেখে চলে।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের তীব্রতার এ সময়ে অস্ট্রেলিয়া সিরিজটি বাতিলও করতে পারত। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) দয়া, তারা সেটা করেনি। আর চাহিদাপত্রেও তো ‘বাঘের দুধ’ এনে দেওয়ার মতো কিছু নেই! অসমর্থিত সূত্রমতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ সফরে সংক্রমণের ঝুঁকি না নিতে অস্ট্রেলিয়ার খরচ ২০-২২ কোটি টাকার বেশি। আতিথেয়তা দেওয়া দেশের কাছে এই মান ধরে রাখার দাবিটা মোটেও অযৌক্তিক নয়।

ঢাকায় পা দিয়ে অস্ট্রেলিয়া দলকে তাই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সাধারণ অতিথিদের প্রবেশ নিষেধ করে দিয়ে তাদের অস্বস্তি দূর করা হয়েছে।

যদিও আগের দুই সিরিজে হোটেলের নির্দিষ্ট কোনো তলায় খেলোয়াড়েরা থেকেছেন, অন্য তলাগুলোতে সাধারণ অতিথিরা—তখন সফরকারী দলগুলোর সমস্যা হয়নি। কিন্তু এটা তো যেনতেন যদু-মধুদের দল নয়! বুঝতে হবে দলটা অস্ট্রেলিয়া; যারা গল্পের সেই কুলীন অতিথির মতো, গরিবের বাড়িতে পা রেখে পয়পরিষ্কার ও নিরাপত্তা নিয়ে ভ্রুকুটির পর ভ্রুকুটির জন্ম দেয়। তাতে মন খারাপ করলে চলে না।আর অতিথিকে বাড়তি সেবা দিয়ে বাঙালিও কখনো মন খারাপ করে না।

টিম বাসে মুখে মাস্ক পরা অস্ট্রেলিয়া দলের ক্রিকেটার
ছবি: প্রথম আলো

অস্ট্রেলিয়া দলকে একটু শান্তিতে ও নিরাপদে থাকার জায়গা করে দিতে এই সিরিজে বিসিবি নাকি হোটেলের ২১৫টি কামরা ভাড়া নিয়েছে। মাঠে ক্যাটারিংয়ের খাবার আনা যাবে না—অস্ট্রেলিয়ার এই দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছে করোনা প্রটোকলের অংশ হিসেবে। গরিবের রসুইঘর ও রাঁধুনির অবস্থা সম্পর্কে সংগত কারণেই অস্ট্রেলিয়া বিশেষ নিশ্চিত হতে পারেনি, তাই সঙ্গে করে নিজেদের ‘শেফ’ এনেছে। হোটেলে জিম, সুইমিংপুলের আলাদা ব্যবস্থা—এসব তো আছেই, সঙ্গে আরও আছে বল। গায়ের বল নয়, খেলার বল।

বল গ্যালারিতে পড়লে পাল্টাতে হবে। গ্যালারিতে দর্শক নেই, খাঁ খাঁ বিরানভূমি। তবু সতর্কতার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার এই দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে ঝাঁকে ঝাঁকে বল গ্যালারিতে যাবে, আর বারবার বল পাল্টে একই কন্ডিশনের অন্য বল দেওয়া হবে—অতিথি সৎকারে এই ঝামেলার মালাও নির্বিবাদ গলায় পরেছে বিসিবি।

এমনকি দুই দলই জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকলেও মাঠে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতেও আপত্তি অতিথিদের। প্রথম ম্যাচে ‘হিট উইকেট’ হয়েছেন অ্যাশটন অ্যাগার। স্টাম্পে বুট লাগায় সে বুট অ্যাগার পরে স্যানিটাইজ করে নিয়েছেন কি না, সে খবর অবশ্য পাওয়া যায়নি।

অস্ট্রেলিয়া দলের অনুশীলনের সময় সংবাদকর্মীদের ধারে–কাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হয় না
ছবি: প্রথম আলো

এই সিরিজে আরও একটি নিয়ম সংযোজন করে নিলে অতিথিদের পুরোপুরিই চিন্তামুক্ত রাখা যেত। বল শরীরে লাগানো যাবে না! লাগলে বল পাল্টে দিতে হবে। যেহেতু অস্ট্রেলিয়া কঠোর জৈব সুরক্ষাবলয় পালন করছে, সে হিসেবে মাঠে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের গায়ে বল লাগলে সেই বল আর অস্ট্রেলিয়ান বোলার ধরবেন না।

সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে তাতে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা করোনার ভয় থেকেই তো বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন না। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের গায়ে লাগা বলটাও তাই তাঁদের না ধরাই উচিত।

শুধু স্পর্শ নয়, অনেকটা দৃষ্টিসীমায় থাকলেও বোধ হয় সমস্যা। মিরপুরে প্রথম টি-টোয়েন্টির আগের দিন ড্রেসিং রুম থেকে একাডেমি মাঠে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার অ্যাশটন অ্যাগার। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় তলায় ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সংবাদকর্মীরা।

ওপর থেকে নিচে প্রায় ২০ ফুটের বেশি দূরত্ব থাকলেও অ্যাগার সংবাদকর্মীদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জার্সি দিয়ে মুখ-নাক ঢেকেছেন। এই যদি হয় অতিথির সাবধানতা, তাহলে ‘মানীর মান’ ধরে রাখতে বাংলাদেশ কেন ব্যগ্র চেষ্টা করবে না?

সিরিজে প্রথম দুই ম্যাচে মোটেও ভালো খেলতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া
ছবি: প্রথম আলো

এখনো সময় আছে। সিরিজে আরও তিন ম্যাচ বাকি। অতিথিদের মান রাখতে সম্ভাব্য যা যা করা সম্ভব, তা এর মধ্যেই করতে হবে। আতিথেয়তায় তৃপ্ত হয়ে অতিথিরা যাওয়ার সময় যেন বলে যেতে পারেন, ‘কষ্ট দিয়ে গেলাম, কিছু মনে রাখবেন না।’ আর আমরাও যেন তখন বলতে পারি, ‘নাহ, এ আর এমন কী! আরও কটা দিন যদি থেকে যেতেন...।’

অস্ট্রেলিয়া দলের বিদায়টা এমন আবেগঘন হওয়ার আগে অবশ্য বাংলাদেশের চাই অন্তত আরও একটি জয়।