আলো খুঁজতে গিয়ে অন্ধকারে নির্বাচকেরা

মিরপুর টেস্টের দলে ডাকা হয়েছে প্রায় দুই বছর দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট না খেলা মোহাম্মদ নাঈমকে। এর আগে প্রথম টেস্টের দল নিয়েও হয়েছে নাটক।

সাইফ হাসান, সাদমান ইসলাম, মোহাম্মদ নাঈম

অভিজ্ঞ তামিম ইকবাল চোটে পড়ে মাঠের বাইরে। সাদমান ইসলাম আর সাইফ হাসানও পারছেন না আস্থার প্রতিদান দিতে। এবার তাহলে নতুন কাউকে চাই, যে কিনা টপ অর্ডারের আঁধার-ব্যাটিংয়ে আলো আনবেন।

নির্বাচকেরা ডাকতে পারতেন ফজলে রাব্বিকে। এবারের জাতীয় লিগেই নিজের সর্বশেষ ও ৯৪তম প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তিন নম্বরে নেমে রাব্বি খেলেছেন ১৮৮ ও অপরাজিত ৭১ রানের ইনিংস। লিগে ৬০-এর ওপর গড়ে সর্বোচ্চ ৬০৩ রানও তাঁরই। কাজেই রাব্বির নামটা থাকলেও মিরপুর টেস্টের জন্য ঘোষিত ২০ জনের ব্যাখ্যাতীত লম্বা স্কোয়াডের একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেত।

কিন্তু নির্বাচকেরা ডাকলেন মোহাম্মদ নাঈমকে, যিনি সর্বশেষ জাতীয় লিগে তো খেলেনইনি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের সর্বশেষ ম্যাচটাও খেলেছেন প্রায় দুই বছর আগে। আদতে তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার সেভাবে শুরুই হয়নি এখনো। এত তাড়াতাড়ি টেস্ট দলে ডাক পেয়ে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন নাঈম নিজেও।

ওপেনারদের টানা ব্যর্থতার কারণেই নাঈমকে দলে ডাকা, প্রথম আলোকে এমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন বিসিবির প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন। তাঁর যুক্তি—টি-টোয়েন্টি দলে থাকায় নাঈম তো এই কোচিং স্টাফের অধীনেই একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ব্যর্থতা আসলেই চোখে পড়ার মতো। সাদমান ইসলাম দুই ইনিংসেই হয়েছেন এলবিডব্লু। সাইফ হাসান দুবারই শাহিন শাহ আফ্রিদির শর্ট বল দেখে যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। তিনে নামা নাজমুল হোসেন এমন দুটি বলে শট খেলতে গিয়ে ফিরেছেন, দেখে মনে হয়েছে টেস্টে বল ছাড়াটাও যে শট খেলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি তাঁর অজানা! কিন্তু এই সমস্যার সমাধান নির্বাচকেরা এমন একজনের ব্যাটে খুঁজতে চাইলেন, দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচে এখনো যাঁর ব্যাটিং অভ্যস্ততাই গড়ে ওঠেনি।

চোটের কারণে তামিম দলে না থাকাতেই টপ অর্ডার বেশি অনভিজ্ঞ হয়ে পড়েছে। সাদমান ও নাজমুলের টেস্টে সেঞ্চুরি থাকলেও সেসবকে বিচ্ছিন্ন পারফরম্যান্স বলার মতো পর্যাপ্ত উপাত্তও এখনো হাতে নেই। সাইফ তো সেই ছাপও রাখতে পারেননি। তাঁর ব্যাটিং এ পর্যায়ের উপযুক্ত কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। আর সে কারণেই প্রায় দুই বছর দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট না খেলেও ‘নাঈম কেন টেস্ট দলে’ প্রশ্নটার সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নও চলে আসছে সামনে। ৫০টির ওপরে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা ওই তিনজনও কেন মেলাতে পারছেন না চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ?

সাদমান, সাইফ ও নাজমুল—পাকিস্তান সিরিজের আগে তিনজনই খেলছিলেন জাতীয় লিগে। দীর্ঘ সংস্করণের ক্রিকেট খেলছিলেন বলে টেস্টের প্রস্তুতিটা সবচেয়ে ভালো হওয়ার কথা সেখানেই। অথচ সাইফ ও নাজমুলকে হুট করেই ডেকে পাঠানো হলো টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে। টেস্টের আগে জাতীয় লিগ ফেলে টি-টোয়েন্টি খেলতে চলে এলেন তাঁরা! সাইফকে তো টি-টোয়েন্টি সিরিজে মনে হয়েছে ভিনগ্রহের কেউ।

আসলে চলতি পাকিস্তান সিরিজে দল নির্বাচন নিয়ে বারবারই ‘চমক’ দেখাচ্ছে নির্বাচক কমিটি, যার সর্বশেষ পর্ব মঞ্চস্থ হলো মিরপুর টেস্টের দলে নাঈমকে ডাকার মধ্য দিয়ে। এর আগে প্রথম টেস্টের দলে ডাকা হয়েছিল দুই তরুণ মাহমুদুল হাসান ও পেসার রেজাউর রহমানকে। এরপর টেস্ট শুরুর আগের দিন হুট করেই ডাকা হয় আরও দুই পেসার খালেদ আহমেদ ও শহীদুল ইসলামকে। মাহমুদুল বা রেজাউরের কেউই চট্টগ্রাম টেস্টে সুযোগ পাননি। তাঁদের দলে রেখেই শহীদুল, খালেদ বা নাঈমকে ডেকে পাঠানো আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মান নিয়ে সংশয় আছে খোদ ক্রিকেট বোর্ডেরই? নাকি নির্বাচকেরাও বুঝতে পারছেন না কাকে, কখন, কোন সংস্করণের দলে ডাকতে হবে?

সিনেমার পর্দায় শুধু অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্সই নজরে পড়ে সবার। কিন্তু এর পেছনেও তো কলাকুশলীর অভাব থাকে না! সিনেমা ‘ফ্লপ’ হলে শেষ পর্যন্ত দায়টা শুধুই পর্দার মানুষগুলোর নয়, পেছনের মানুষদেরও নেওয়া উচিত। বিশেষ করে সেই পেছনের মানুষেরা যখন পরিকল্পনাহীনতা রোগে ভোগেন। সাইফ, সাদমান, নাজমুলদের ব্যাটিং আর টপ অর্ডারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি তাই সম্পূরক প্রশ্নও আসে—আলো খুঁজতে গিয়ে আরও বেশি অন্ধকারেই হারিয়ে যাচ্ছেন না তো নির্বাচকেরা!