আশার নাম সাকিব–মোস্তাফিজ

সাকিব-মোস্তাফিজ: বাংলাদেশের দুই আশার নামফাইল ছবি : প্রথম আলো

ইএসপিএন ক্রিকইনফোর একটি টুইটের দিকে দৃষ্টি রাখা যাক।

আইপিএলের ‘এলিমিনেটর’ থেকে বিদায় নেওয়ার শঙ্কায় তখন কলকাতা নাইট রাইডার্স। শেষ ওভারে দরকার ৭ রান। কাগজে-কলমে হয়তো অত বড় লক্ষ্য নয়, কিন্তু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর মোহাম্মদ সিরাজ, যুজবেন্দ্র চাহাল, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, হর্ষল প্যাটেল ও জর্জ গারটন যেভাবে আগের পাঁচ ওভারে কলকাতাকে চেপে ধরেছিলেন, সেটি মনে রাখলে উইকেটে থাকা কলকাতার দুই ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসান-এওইন মরগানের কাছে ওই সাত রানই পর্বতসমান মনে হওয়ার কথা।

কিন্তু গলায় শক্ত হয়ে বসে যাওয়া ফাঁসটা কী দুর্দান্তভাবেই না আলগা করলেন সাকিব! ড্যান ক্রিশ্চিয়ানের করা ইনিংসের শেষ ওভারের প্রথম বলটা স্কুপ প্যাডল করে সীমানাছাড়া করলেন, মহামূল্যবান চারটি রান যুক্ত হলো স্কোরবোর্ডে। পরের তিন বলে তিন রান করতে বেগ পেতে হলো না এই জুটির। ম্যাচ শেষে সাকিবের দুশ্চিন্তামুক্তির বাউন্ডারি নিয়ে আলোচনা হলো অনেক। সে কারণেই ইএসপিএন ক্রিকইনফো লিখল, ‘সাকিব আল হাসান, কী দুর্দান্ত স্নায়ু! অসাধারণ!’

টি–টোয়েন্টিতে দুই সেরা ক্রিকেটার বাংলাদেশের
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সাকিবের বরফশীতল স্নায়ুর প্রমাণ এভাবেই বারবার পেয়েছে বিশ্ব। ২০১২ আইপিএলের ফাইনালের দিকে চোখ ফেরানো যাক। বেন হিলফেনহসের করা ১৯তম ওভারে ওই একই কাজ করেছিলেন সাকিব, একই শট মেরে ম্যাচের নাটাইটা এনে দিয়েছিলেন কলকাতার হাতে। চাপে ফেলে দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংসকে। সে চাপ থেকে ধোনিরা আর বের হতে পারেননি। শিরোপা জেতে কলকাতা।

ক্যারিয়ারের পরতে পরতে সাহসিকতার এমন আখ্যান রচনা করেছেন সাকিব। তার অনেকগুলোই মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলাদেশের হয়েও। আর উপলক্ষটা যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, সতীর্থদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছড়ায় দলে সাকিবের মতো একজন অকুতোভয় ক্রিকেটারের উপস্থিতি।

টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটটাই এমন, যেখানে জেতার জন্য সাহসিকতার বিকল্প নেই। কিছুদিন আগেও এই সংস্করণটাই বাংলাদেশ দলের জন্য সবচেয়ে কঠিন মনে হতো। খেলোয়াড়েরা যেন ধরেই নিয়েছিলেন, এই সংস্করণটা তাঁরা ভালো খেলেন না। কিন্তু সেই জায়গা থেকে যে বাংলাদেশ এখন সরে এসেছে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ দুটি হোম সিরিজই তার প্রমাণ।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিব-মোস্তাফিজকেই-বড় ভূমিকা নিতে হবে
ফাইল ছবি

আইপিএলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় নাম সাকিব। কিন্তু কয়েক বছর ধরে যে ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই খেলেছেন, একাদশে নিয়মিত ছিলেন না তিনি। তাই বলে সাকিব আইপিএলটাকে কাজে লাগান না, সেটি বলা যাবে না। এবার যাওয়ার আগেই যেমন বলেছেন, আইপিএলে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে তাঁর একধরনের প্রস্তুতি হয়, না খেললে হয় আরেক রকম।

২০১৯ বিশ্বকাপের আগের আইপিএলের কথাই ধরুন। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি সাকিব। কিন্তু অনুশীলনসুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন পুরোপুরি। বিভিন্ন দলের ফিজিওদের সঙ্গে কথা বলে অন্য দেশের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে নিজের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন।

সাকিবের বুদ্ধিদীপ্ত প্রস্তুতির সুফল ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিয়েছিল দুহাত ভরে। দোরগোড়ায় যখন আরেকটি বিশ্বকাপ, সাকিব এবারও কলকাতার হয়ে তেমন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন, আলো ছড়িয়েছেন। সেটা বল হাতে রান আটকানোর দিক দিয়েই হোক বা ইনিংসের শেষদিকে এসে স্কোরবোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রান যোগ করে। সাবেক দল হায়দরাবাদের অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনকে যে রকম ক্ষীপ্রতায় রানআউট করেছেন, কে বলবেন এই সাকিব বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত নন?

শারজার মন্থর উইকেটে সুযোগ পেলেই সাকিব আটকে দিয়েছেন রানের গতি, এনে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ব্রেক থ্রু। বাংলাদেশি দর্শকেরা উৎফুল্ল হতে পারেন এই ভেবে যে এবারের বিশ্বকাপ তো এসব পিচেই হবে!

বিশ্বকাপের আগে আইপিএলে বাংলাদেশের আরেক প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমানের ম্যাচ প্রস্তুতিটা অবশ্য ভালোই হয়েছে। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ১৪ ম্যাচে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। বিদেশি তারকাদের মধ্যে রশিদ খান, ক্রিস মরিস আর জেসন হোল্ডারের পর সবচেয়ে বেশি উইকেট বাংলাদেশের মোস্তাফিজেরই। বোলিং, ফিল্ডিং মিলিয়ে এই মৌসুমে রাজস্থানের অর্জনের তালিকা করলে এই বাঁহাতি পেসারের নামটা ওপরের দিকেই থাকবে। মোস্তাফিজের ওপর রাজস্থানের অধিনায়কের ভরসা ছিল অনেক, ইনিংসের যেকোনো কঠিন মুহূর্তে সমাধানের আশায় বল তুলে দিয়েছেন তাঁর হাতে।

অথচ মরুর বুকে মোস্তাফিজ খেলতে গিয়েছেন এবারই প্রথম। সেখানকার কন্ডিশনে কীভাবে বল করতে হয়, কীভাবে বোলিংয়ে নিয়মিত বৈচিত্র্য আনতে হয়—মোস্তাফিজের বল করার ধরন দেখেই বোঝা গেছে, সেসব ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়।

পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে থিতু হয়ে যাওয়া দুই ব্যাটসম্যান এইডেন মার্করাম ও নিকোলাস পুরানের বিপক্ষে ১৯তম ওভারে দেন মাত্র চার রান, যা শেষ ওভারে বল করতে আসা কার্তিক ত্যাগির হাতে তুলে দেয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর লাইসেন্স।

ডেথ ওভারে মোস্তাফিজ ওভারপ্রতি গড়ে রান দেন (ইকোনমি রেট) ৮.৮১ করে, যা ম্যাচের ওই পর্যায়ে আইপিএলে সেরা ইকোনমি রেটগুলোর একটি। ডেথ ওভারে মোস্তাফিজের এ ইকোনমি রেট এ মুহূর্তে ভারতের যশপ্রীত বুমরার (৮.৮৭) চেয়েও কম। বিদেশিদের মধ্যে ডেথ ওভারে মোস্তাফিজই সবচেয়ে বেশি ডট বল দিয়েছেন। চাপের মুহূর্তে সাকিবের মতো তিনিও যে স্নায়ু ঠান্ডা রাখতে পারেন বেশ, এসব পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ।

মধ্যপ্রাচ্যের কন্ডিশনে হতে যাওয়া টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আইপিএলে খেলা সাকিব আর মোস্তাফিজের কাছেই তাই বাংলাদেশের প্রত্যাশা থাকছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বকাপের কন্ডিশনে বিশ্বকাপের আগেই খেলে আসার সুযোগ যে আর কারোরই হয়নি!