ইংল্যান্ডকে এবার এক দিন ছুটি কম দিল ভারত

ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ভারতের জয় সহজ করে দিয়েছে।ছবি: এএফপি

তৃতীয় দিনের খেলা দেখে স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। একদিকে ছুটির ঘণ্টার অপেক্ষায় ছাত্ররা, ওদিকে প্রতি সেকেন্ডকে অনন্তকাল মনে করিয়ে দিয়ে ক্লাসের সময় শুধু যেন বাড়িয়েই যাচ্ছেন শিক্ষক। আহমেদাবাদে আগের টেস্টেই পৌনে দুই দিনে ছুটি মিলেছিল ইংল্যান্ডের। সিরিজের শেষ টেস্ট চলছে। এ ম্যাচ শেষ হলেই ছুটি। আর ছুটির আগে অপেক্ষা করতে কারই-বা ভালো লাগে? ইংল্যান্ডেরও যেন ভালো লাগছিল না।

গতকালই প্রথম ইনিংসে ভারত ৮৯ রানের লিড নিয়ে ফেলার পর এই টেস্টের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচটা কত দিনে গড়ায়, সেটা জানারই শুধু অপেক্ষা। সকালের সেশন প্রায় পুরোটা কাটিয়ে দিয়ে ম্যাচটাকে চার দিনে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল ভারতের টেলএন্ডাররা। কিন্তু ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের অত দেরি সহ্য হচ্ছিল না। মোটামুটি এক উইকেটকে মাইনফিল্ড বানিয়ে সবাই তাড়াহুড়া করে ফিরেছেন ড্রেসিংরুমে।

১৬০ রানে পিছিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছিল ইংল্যান্ড। ড্যান লরেন্সের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক ইনিংসও তাদের ১৩৫ রানে অলআউট হওয়া আটকাতে পারেনি। ইনিংস ও ২৫ রানের ব্যবধানে তিন দিনেই চতুর্থ টেস্ট হেরে বসেছে ইংল্যান্ড। ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে চলে গিয়েছে ভারত।

অক্ষরকে সামলাতেই পারেনি ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার।
ছবি: বিসিসিআই

আহমেদাবাদে আগের টেস্টের উইকেট নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। স্পিন উইকেটে ইংল্যান্ড দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৯৩ রান করেছিল। আলোচনায় ইন্ধন দিয়েছে ভারতের ১৪৫ রানে গুটিয়ে যাওয়াও। গুটিকয় বিশ্লেষক ছাড়া সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটারদের সবাই ভারতের উইকেট নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। নিজেদের ব্যাটসম্যানদের দক্ষতা বা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যর্থতা আলোচনায় খুব কমই এসেছে। শেষ টেস্টে উত্তরসূরিরা মাইকেল ভন, মন্টি প্যানেসারদের এমন আস্থা জলে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছেন।

আহমেদাবাদের উইকেট ব্যাটিংস্বর্গ না হলেও অন্তত ২০৫ রানে গুটিয়ে যাওয়ার মতো ছিল না। কাল ঋষভ পন্তের আগ্রাসী ব্যাটিং সেটা প্রমাণ করে দিয়েছিল। তবু চাইলে পন্তের ভিন্ন ঢংয়ের ব্যাটিংকে উদাহরণ মানতে ইচ্ছা না–ও হতে পারে অনেকের। তাঁদের সব সন্দেহ দূর করে দিয়েছেন ওয়াশিংটন সুন্দর ও অক্ষর প্যাটেল। টেস্ট অভিষেকের পর থেকেই সুন্দরের বোলার সত্তা হারিয়ে গেছে। আটে নেমে প্রতিনিয়ত যেসব ইনিংস খেলছেন, তাতে কদিন পর শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ঢোকার দাবি জানানোর সময় এসে যাচ্ছে।

সুন্দরের সেই ব্যাটিং থেকে ইংল্যান্ড শিক্ষা নিতে পারেনি। প্রথম চার ওভারে কিছু হয়নি। পঞ্চম ওভারেই শুরু হলো ধস। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের প্রথম ওভারেই বল বুঝতে না পেরে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন জ্যাক ক্রলি। পরের বলেই সিরিজে নিজের চতুর্থ শূন্য বুঝে নিয়ে ফিরে গেলেন জনি বেয়ারস্টো! প্রথমে বোলিং শুরু করেও অশ্বিনের উইকেট উৎসব দেখে অন্য প্রান্তে অক্ষরও খেপে উঠলেন। ১০ রানে প্রথম দুই উইকেট হারানো ইংল্যান্ড ১০ রান বিরতি দিয়ে দিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ উইকেট হারাল। অধিনায়ক জো রুট কিছুক্ষণ থিতু হওয়ার চেষ্টা করলেন ওলি পোপকে নিয়ে।

অশ্বিনও যোগ দিয়েছেন উইকেট উৎসবে।
ছবি: বিসিসিআই

৩৫ রানের জুটি শেষ হলো পোপের (১৫) স্টাম্পড হওয়ার মধ্য দিয়ে। অক্ষরের তিন উইকেট প্রাপ্তির দুই বল পরই অশ্বিন পেয়ে গেলেন তাঁর তৃতীয় উইকেট। অশ্বিনের বলে এলবিডব্লু হয়ে গেলেন অধিনায়ক রুট (৩০)। রিভিউ নিয়ে অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে একটু পেছাতে চেয়েছিলেন রুট। লাভ হয়নি। ৬৫ রানেই ষষ্ঠ উইকেট হারাল ইংল্যান্ড। এরপরই যা একটু লড়াই দেখালেন সফরকারীরা। ৪৪ রানের জুটিতে ১০০ পেরোল ইংল্যান্ড। দুই রানের মধ্যে বেন ফোকস ও ডম বেসকে ফিরিয়ে দিয়ে ইনিংসে পাঁচ উইকেটও পেয়ে গেলেন অক্ষর।

ইনিংসের বাকি সময়টা শুধু ব্যক্তিগত অর্জনের। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে ড্যান লরেন্স ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি পেয়েছেন। আর তাঁকে আউট করে ক্যারিয়ারে ৩০ বারের মতো ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেলেন অশ্বিন। ৪৮ রানে ৫ উইকেট তাঁর। আর অক্ষরের ৫ উইকেট ৪৭ রানে। ৩ টেস্টে ২৭ উইকেট পেয়েছেন অক্ষর। আর ৪ টেস্টে ৩২ উইকেট নিয়ে সিরিজ শেষ করলেন অশ্বিন। ভারতের হয়ে প্রথম কোনো বোলার হয়ে একাধিক সিরিজে ৩০ উইকেট পেলেন অশ্বিন।

একটুর আক্ষেপ রয়ে গেল সুন্দরের।
ছবি: এএফপি

দিনের প্রথম সেশনটা অবশ্য কীর্তিতে নয়, আক্ষেপে শেষ হয়েছে। কাল পন্ত যখন আগ্রাসনের রোলার চালাচ্ছিলেন ইংলিশ বোলিং লাইনআপে, তখন অন্য প্রান্তে এর সুফল ভোগ করেছেন সুন্দর। পন্ত ফেরার পরও অক্ষর প্যাটেলকে নিয়ে ১০ ওভার কাটিয়ে দিয়েছেন। আজ তো প্রায় প্রথম সেশনটাই কাটিয়ে দেওয়ার পথে ছিলেন দুজন। সকালে প্রথম ২০ ওভারে ইংল্যান্ডকে কোনো সুযোগ দেননি দুজন। এই সিরিজেই সঙ্গীর অভাবে ৮৫ রানে অপরাজিত থাকতে হয়েছিল সুন্দরকে। আজ সে দুঃখ ঘুচবে বলেই মনে হয়েছিল। অক্ষরের সঙ্গে ১০৬ রানের জুটি গড়ে ৯৬ রানে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুন্দর। ইংলিশ স্পিনারদের এত দারুণ সামলাচ্ছিলেন যে এ উইকেট স্পিনারদের সাহায্য করছে, এমন কথা বলার সুযোগই হচ্ছিল না।

এমন সময় ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নিল সুন্দরের দিক থেকে। রুটের এক বল মিড অনে ঠেলে দিয়েছিলেন সুন্দর। তা দেখে নন স্ট্রাইক প্রান্ত থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অক্ষর। সুন্দর বিপদ দেখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অক্ষরের আর ফেরা হয়নি। ১০৬ রানের অষ্টম উইকেট জুটি ভাঙল। ওভারের শেষ বল হওয়ায় নন-স্ট্রাইকে আটকা পড়লেন সুন্দর। সর্বনাশটা হলো তখনই। বেন স্টোকস প্রথম বলেই এলবিডব্লু করে দিলেন ইশান্ত শর্মাকে। দুই বল বিরতি দিয়েই সুন্দরের মন ভাঙলেন স্টোকস, মোহাম্মদ সিরাজের স্টাম্প উপড়ে নিলেন। ৯৬ রানে অপরাজিত থাকলেন সুন্দর! ভারত ৩৬৫ রানে অলআউট হয়েছে, কিংবা ১৬০ রানের লিড নিয়েছে সেটা নয়, সবার মুখে শুধু এই আক্ষেপের গল্প তখন।

দুই দিন আগে ম্যাচ শেষ হওয়ার দুঃখটা বাড়িতে গিয়েই হয়তো ভুলতে পারবেন অক্ষর।