ইয়র্কারের হুল ও মনুষ্যত্বের ফুল ফোটানো নটরাজন

আইপিএলে এবার নজর কাড়ছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের পেসার নটরাজনছবি: টুইটার

ইয়র্কার? ঠিকঠাক জায়গায় মারতে পারলে ভালো, নইলে কপালে খারাবি। হাফ ভলি লেংথে পড়লে ব্যাটসম্যানের জন্য ‘পোয়াবারো’। বোলাররা ইয়র্কার মারতে গিয়ে এই ভয়টাই পান বেশি।

কিন্তু থাংগারসু নটরাজন যেন অন্য ধাতে গড়া মানুষ। চাইলেই মারতে পারেন ইয়র্কার। শেকল ছিঁড়েছেন দারিদ্র্যের, পরিবারের জন্য এমন কিছু নেই যে করেননি। শুধু পাল্টাতে পারেননি রাস্তায় তাঁর মায়ের মুরগি বিক্রির অভ্যাস। এদিকে পরিবারের ভাগ্য পাল্টেছে। তবু নটরাজনের মায়ের বিশ্বাস, এই চেষ্টাটুকুই বাজে সময়ে কাজে লাগবে—জানিয়েছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদ পেসারের পরামর্শক জয়প্রকাশ।

ইয়র্কার দেওয়ায় নটরাজনের জুড়ি মেলা ভার
ছবি: টুইটার

আইপিএলে কাল দিল্লি-সানরাইজার্স ম্যাচ দেখা থাকলে ইয়র্কারে নটরাজনের মুনশিয়ানা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। সানরাইজার্সের জয়ে ২৯ বছর বয়সী এ পেসারের বোলিং বিশ্লেষণ ৪-০-২৫-১। এই পরিসংখ্যান অবশ্য তাঁকে পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না। ‘ডেথ ওভার’—এ চাপের মুহূর্তে ইয়র্কার মারতে বুকের পাটা লাগে। বাঁহাতি এ পেসার তা দেখিয়েছেন ভালোই। তাঁর ৬টি ইয়র্কার এবার আইপিএলে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ইয়র্কার মারার নজির। ডেথ ওভারে ‘বিশেষজ্ঞ’ তকমাটা নটরাজনের জন্য নতুন কিছু না। আইপিএলে নিজের জাত চেনানোর আগে তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে উত্থান ঘটেছিল তাঁর। ধরে ধরে টানা ইয়র্কার মারতেন ব্যাটসম্যানদের।

তাঁর এই বিদ্যা শেখার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। তামিলনাড়ুর সালেম জেলায় জন্ম নেওয়া নটরাজন শুরুতে ক্রিকেটার হতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাননি। মা ছিলেন দিনমজুর। তবু এর মধ্যেই শান দিয়ে গেছেন নিজের বোলিংয়ে। জোরটা ছিল ইয়র্কার মারায়। তবে এর চেয়েও বেশি জোর ছিল পরিবারের দেখাশোনায়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ভেঙ্কট কৃঞ্চ কাল টুইটারে এক টুইটে ধারাবাহিকভাবে জানিয়েছেন সেসব কথা। নটরাজনের এলাকা থেকেই উঠে আসা এক পেসার পেরিস্বামী। ক্রিকেটার হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। নটরাজন নিজ তাগিদে পেরিস্বামীর বাসায় গিয়ে বুঝিয়েছেন, ক্রিকেটেও ভবিষ্যৎ আছে। টেনিস বলের ক্রিকেট খেলা এমন অনেককেই উঠে আসার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পরিবারের তিন সহোদরকে ভালো মানের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বাবা-মা কে বানিয়ে দিয়েছেন বাড়ি। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—গাড়ি কিনতে ইচ্ছা হয় না? ‘আগে মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে হবে। বিলাসিতা পরেও করা যাবে’—এই ছিল নটরাজনের জবাব, টুইটে জানান ভেঙ্কট কৃঞ্চ।

কাল সানরাইজার্সের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নটরাজনের
ছবি: টুইটার

উঠে আসার সময়ে নটরাজনের আরেকটি কথা কাল টুইটে স্মরণ করেন ভেঙ্কট, ‘বোনদের লেখাপড়া শেখাতে চাই। এটা করতে পারলে তাদের জীবন এমনিতেই এগিয়ে যাবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য করব। বিলাসবহুল গাড়ি চালানোর চেয়ে তাদের লেখাপড়ায় টাকা ঢালা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ আর দশটা পেসারের মতোই চোটের সঙ্গে লড়েছেন নটরাজন। কঠোর পরিশ্রম করেই ফিরেছেন তামিলনাড়ু রাজ্য দলে, এবার আইপিএলে সানরাইজার্সের হয়ে ফুটতে শুরু করেছে তাঁর ইয়র্কারের হুল ফোটানো ফুল। ২০১৭ আইপিএলে তাঁকে ৩ কোটি রুপিতে কিনেছিল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। সে সময় ৬ ম্যাচ খেলে নিজের জাত চেনাতে পারেনি নটরাজন। চেনাচ্ছেন এবার—কাল ১৪তম ও ১৮তম ওভারে ইয়র্কারের হুল ফুটিয়ে দিল্লিকে ধরে রেখেছিলেন মুঠোর মধ্যে।


জয়প্রকাশ জানালেন, নটরাজন শুধু পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বাবা-মা কে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়া শিখিয়েছেন সহোদরদের। এমনকি নিজের গ্রামে তৈরি করেছেন একটি একাডেমি। ক্রিকেটার হওয়ার পথে নটরাজন যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন, যেসব সুবিধা পাননি, এখনকার উঠতি ক্রিকেটাররা যেন সেসব বাধার সম্মুখীন না হন—তা নিশ্চিত করতেই নটরাজনের এই একাডেমি। যে পেরিস্বামীর ক্রিকেট ক্যারিয়ার অকালেই শেষ হয়ে যেত, নটরাজনের পরামর্শে তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে গত বছর নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জয়প্রকাশ জানান, ‘প্রচুর তরুণ ক্রিকেটারকে সাহায্য করেন নটরাজন। টেনিস বল ক্রিকেটের সতীর্থরা সাহায্য পান তার কাছ থেকে।’

তামিলনাড়ু রাজ্য দলের ফিল্ডিং কোচ অভিষেক খান্ডেলাল জানালেন, রাজ্য ক্রিকেটে ইয়র্কার মারাটা সহজাতভাবেই রপ্ত করেছেন নটরাজন। ‘নাট্টু (নটরাজন) ইয়র্কার নিয়ে প্রচুর কাজ করে। এমনিতেই ইয়র্কার মারা কোনো সহজ কাজ নয়, আর চাপের মুহূর্তে তা করা আলাদা বিষয়। সে পারে কারণ এটা নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে। টিএনপিএলে (তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগ) সে এটা নিয়মিতই করে, এখন তো সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখাচ্ছে।’


আইপিএলে নটরাজন তারকা হয়ে ওঠার পথে থাকলেও বদলায়নি তাঁর মানসিকতা। গ্রামে এখনো তিনি নাট্টু, সঙ্গী-সাথি সেই শৈশবের বন্ধু-বান্ধবরাই। খান্ডেলালের ভাষায়, ‘সে অসাধারণ মানুষ। খুব পরিশ্রম করে উঠে এলেও নিজের শেকড় ভোলেনি। গ্রামের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সে এখনো আগের মানুষটাই। প্রচুর তরুণকে সাহায্য করে এবং মুফতেই অনুশীলন করায়।’


নটরাজন মানুষটার এমনই—ইয়র্কারের হুল ফোটাতে পারেন যেমন, তেমনি পারেন মনুষ্যত্বের ফুল ফোটাতেও।