এক পায়ে লড়ছেন নাফিউর

বিভিন্ন খেলায় আগ্রহ থাকলেও নাফিউর সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন ক্রিকেটছবি: আবদুল আজিজ
অদম্য মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গেই নয়, যেন নিজের সঙ্গেও লড়ছেন নাফিউর। শনিবার জামালপুর পৌর শহরের মিয়াবাড়ি বাজার এলাকায়
ছবি: আবদুল আজিজ

কখনো ক্রিকেট খেলছেন, কখনো ফুটবল। কখনো রাস্তার ধারে হাইজাম্পের ক্রসবার বানিয়ে লাফ দিচ্ছেন। র‌্যাকেট হাতেও দুর্দান্ত ব্যাডমিন্টন কোর্টে। একসময় সাঁতার কাটছেন তো আরেক সময় দুরন্ত গতিতে সাইকেল-মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কী না করছেন খন্দকার নাফিউর রহমান! অদম্য মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির জোরে শারীরিক বাধা ডিঙিয়েও কতটা অজেয় হয়ে ওঠা যায়, জামালপুরের ২২ বছরের যুবক যেন তারই বড় উদাহরণ।

যমজ ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়ে নাফিউরের মা নাজমা বেগম চমকে উঠেছিলেন। মেয়ে মাবিয়া আক্তার যদিও জন্মের পর স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু নাফিউর পৃথিবীতে আসে ডান পা ছাড়াই। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই জামালপুর সদরের হাটচন্ডা গ্রামে মানুষ দেখতে আসতে থাকে নাফিউরকে। প্রতিবেশীরা বলত, ‘এই ছেলে তো দাঁড়াতেই পারবে না! হাঁটাও শিখবে না। সারা জীবন মা-বাবার বোঝা হয়ে থাকবে।’ মা শুনতেন আর কাঁদতেন। কিন্তু নাফিউর শুধু হাঁটাই শেখেননি, ক্রাচে ভর করেই শিখেছেন মাঠের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে।

বাংলাদেশ জাতীয় হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের স্পিনার নাফিউর। খেলেছেন বাফুফে আয়োজিত অ্যামপিউটি ফুটবল টুর্নামেন্টে। জাতীয় প্যারাব্যাডমিন্টন দলের নিয়মিত শাটলার তিনি। আন্তজেলা হাইস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় জিতেছেন রুপা। ২০১৭ সালে ময়মনসিংহ বিভাগে হয়েছিল ‘রবি খোঁজ দ্য নাম্বার ওয়ান স্পিনার’ বাছাই। সেখানে স্বাভাবিক ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোলিং করে জায়গা করে নেন সেরা ২০ জনের মধ্যে। তিনজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারের মধ্যে হয়েছিলেন সেরা। তাঁকে নিয়ে বানানো বিজ্ঞাপনে টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান রবি বলেছিল, ‘নাফিউরের মতো জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে।’

এত অর্জনের পরও মাঝেমধ্যে নাফিউরের নিজেকে দুর্ভাগাই মনে হয়। ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত হুইলচেয়ার টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ ক্রিকেটের দলে ডাক পেয়েও পাসপোর্ট না থাকায় যেতে পারেননি। এখন পাসপোর্ট আছে, তবু যায়নি হতাশা। টেলিভিশনে, পত্রিকায় চলমান টোকিও প্যারালিম্পিকস দেখে আফসোস হয় প্যারাব্যাডমিন্টনের জাতীয় দলের এই শাটলারের। মূল অলিম্পিকের পর গত ২৪ আগস্ট প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিক শুরু হলেও ২০০৮ সালের পর আর এই গেমসে অংশ নিচ্ছে না বাংলাদেশ।

গত বছর ভারতের উত্তরাখন্ডে চার জাতি হুইলচেয়ার ক্রিকেট সিরিজের বাংলাদেশ দলে জায়গা পেয়েছিলেন নাফিউর। কিন্তু ফিরে আসতে হয়েছিল বিমানবন্দর থেকেই। নাফিউর সে কথা মনে করে বলছিলেন, ‘ভারতে তখন দাঙ্গা চলছিল। আমরা বিমানে ওঠার এক ঘণ্টা আগে ভারত থেকে সিরিজ বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।’

২০১৯ সালে প্যারাব্যাডমিন্টনের জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পান নাফিউর। প্রথমবার অংশ নিয়েই ওঠেন জাতীয় প্যারাব্যাডমিন্টনের সেমিফাইনালে। বিভিন্ন ধরনের খেলার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও নাফিউর সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন ক্রিকেটটাই। ক্রিকেটে নাফিউরের হাতেখড়ি এলাকার বড় ভাই মোহাম্মদ মানিকের মাধ্যমে।

প্যারাব্যাডমিন্টনের জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন নাফিউর
ছবি: আবদুল আজিজ

জামালপুর জেলা স্কুল মাঠে সবাই যখন ক্রিকেট খেলত, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতেন নাফিউর। একদিন ‘মানিক ভাই’য়ের কাছে আগ্রহের কথা জানাতেই সুযোগ পেয়ে যান খেলার। সেদিন এক পায়ে দৌড়ে নাফিউর যেভাবে বল করেছিলেন, তা দেখে অবাক হয়ে যায় সবাই। এরপরই ভর্তি হয়ে যান জামালপুরের নতুন আলো ক্রিকেট একাডেমিতে। কিন্তু মুদিদোকানি বাবা মাহবুবুর রহমানের একাডেমির বেতন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। নাফিউরকে তাই বিনা বেতনে অনুশীলনের সুযোগ দেয় একাডেমি কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবন্ধী বলে ছোটবেলা থেকেই অবহেলা, বঞ্চনা নিত্যসঙ্গী নাফিউরের। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় খেলতে চাইলেও শিক্ষকেরা সুযোগ দিতেন না। একবার মোরগ লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার জন্য স্কুলের এক শিক্ষিকাকে অনুরোধ করেন। শিক্ষিকা রাজি হলেও বন্ধুরা বাধা দেয়। একজন বলে, ‘ওর তো এক পা নেই, খেলবে কীভাবে!’ ওই বন্ধুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেদিন জিতেছিলেন নাফিউরই। এরপর তাঁর সুযোগ মেলে আন্তজেলা বার্ষিক ক্রীড়ায়।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে চলতে-ফিরতে অনেকের কাছ থেকেই খোঁচা শুনতে হয়। নাফিউর তবু হাসিমুখে থাকেন। মনের মধ্যে থাকা যন্ত্রণাটা বুঝতে দেন না কাউকে। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলাই যে তাঁর বড় কিছু করার অনুপ্রেরণা!