একটি বই এবং টাইম মেশিনে ৫০ বছর

মোড়ক উন্মোচন শেষে অতিথিদের সঙ্গে শাকিল কাসেম।
ছবি: প্রথম আলো

বইটা তখনো সবার হাতে হাতে পৌঁছায়নি। তবে বইয়ের চরিত্রদের অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন স্যামসন হলে। ১৯৭০-৮০–এর দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের উপস্থিতি, তাঁদের হাসি-কান্নার স্মৃতিচারণায় ঢাকা ক্লাবের সুসজ্জিত মিলনায়তন যেন টাইম মেশিনের গতি পেল। ঘণ্টা দু-একের যাত্রায় সেই টাইম মেশিন সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটের অতীতে।

‘ক্রিকেট রিভিজিটেড’—সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম এক মলাটের মধ্যেই তুলে এনেছেন সত্তর-আশির দশকের বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ১২৭ পৃষ্ঠার বইয়ে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে তখনকার ক্রিকেটের অনেক ঘটনা, চরিত্র, হাসি, কান্না। স্যামসন হলে সেই বইয়েরই মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠান হয়ে গেল আজ বিকেলে। মোড়ক উম্মোচন করেন দুই সাবেক ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সাবেক প্রধান সৈয়দ আশরাফুল হক এবং ইউসুফ রহমান।

খেলোয়াড়ি জীবনে শাকিল কাসেম অনেক ক্লাবেরই অধিনায়ক ছিলেন। আবার অনেকের অধিনায়কত্বে খেলেছেনও। সে রকমই দুজন সৈয়দ আশরাফুল হক ও ইউসুফ রহমান। তবে আজ টাইম মেশিনের ককপিটে পাইলট হিসেবে বসেছিলেন শাকিল কাসেম নিজেই। তাঁর সময়ের বাকি সবাই কো-পাইলট। সাধারণ যাত্রী হয়ে অন্যরা দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে মোহাবিষ্টের মতো উড়ে বেড়ালেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ফেলে আসা দিনগুলোতে।

ক্রিকেট রিভিজিটেড বইয়ের মোড়ক।
ছবি: প্রথম আলো

মঞ্চে উঠে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আজাদ বয়েজে শাকিল কাসেমের অধিনায়ক সৈয়দ আশরাফুল হক। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়ে তাঁকে কান্নার দমক আটকাতে হলো, যখন তিনি বলছিলেন তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর কথা, ‘আমার স্ত্রী সাবেরার মৃত্যুর পর শাকিল আমাকে চার পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখেছিল। আমরা একসঙ্গে খেলেছি, খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাদের। সাবেরার মৃত্যুর পর শাকিল আমার সঙ্গে কথা বলেই সান্ত্বনা দিতে পারত। কিন্তু সে লিখল চিঠি, যেখানে ও সুন্দর ভাষায় বর্ণনা করে, আমার স্ত্রী তাদের কতটা আপন ছিলেন। চিঠিটা এখনো আমার কাছে আছে। মাঝেমধ্যেই সেটা পড়ি।’

সৈয়দ আশরাফুল হকের চোখে শাকিল কাসেম ছিলেন অনেক বড়মাপের ক্রিকেটার। যে পর্যায়ে তিনি খেলেছেন, তার চেয়ে অনেক ওপরের পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা তাঁর ছিল। সাবেক ক্রিকেটার, কোচ ও ক্রীড়া লেখক জালাল আহমেদ চৌধুরী সেই বক্তব্যই অল্প কথায় আরও জীবন্ত করে তুললেন, ‘ক্রিকেট শুধু হাত–পা নয়, মনেরও খেলা। ওই সময় যারা মন দিয়ে ক্রিকেট খেলত, শাকিল ছিল তাদেরই একজন।’

নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন শাকিল কাসেম।
ছবি: প্রথম আলো

সুযোগ পেয়ে অনেক পুরোনো এক উপকারের জন্য শাকিল কাসেমকে ধন্যবাদও জানান জালাল আহমেদ চৌধুরী। ব্যাটসম্যান হিসেবে ছক্কা মারার দক্ষতা তাঁর খুব একটা ছিল না। তবু একবার পল্টন আউটার স্টেডিয়ামে ধানমন্ডির হয়ে ওয়ারীর বিপক্ষে ম্যাচে অনভ্যস্ত ব্যাটে ছক্কাই হাঁকাতে গেলেন। কিন্তু বলটা উড়তে উড়তে গিয়ে পড়ল শাকিল কাসেমের হাতে। আউট হওয়ার হতাশায় জালাল আহমেদ চৌধুরী যেই মাঠ ছাড়তে যাবেন, বাউন্ডারি থেকে শাকিল কাসেম জানালেন, আউট নয়, ওটা ছক্কাই হয়ে গেছে। ‘শাকিলকে ধন্যবাদ, তার কারণেই আমি সেদিন ছক্কাটা মারতে পেরেছিলাম’—কৃতজ্ঞতা জালাল আহমেদ চৌধুরীর।

ইউসুফ রহমানের স্মৃতিতে এখনো অম্লান সেই সময়ের ক্লাব ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকা বন্ধুর মতো সম্পর্ক, ‘মাঠে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও মাঠের বাইরে আমরা ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ক্লাব হারলেও আমরা অনেক সময় পার্টি করতাম। খেলাটা আমাদের কাছে ছিল উপভোগের।’

ওই সময় যারা মন দিয়ে ক্রিকেট খেলত, শাকিল ছিল তাদেরই একজন।
জালাল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক ক্রিকেটার, কোচ ও ক্রীড়া লেখক

‘সেন্টিমেন্টাল জার্নি’ নামে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ইউসুফ রহমানেরও আছে একটা বই। এ দেশের ক্রিকেট সাহিত্যে এবার যোগ হলো শাকিল কাসেমের ‘ক্রিকেট রিভিজিটেড’। এই প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই পথনির্দেশিকা হতে পারে এসব বই। বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম যেমন বলছিলেন, ‘এই বইগুলো আমাদের ক্রিকেট সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করবে।’

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভেবে ইউসুফ রহমানের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুটে ওঠে। টেস্ট–পূর্ব যুগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই ‘সুপারস্টার’ যেন খুঁজে পাচ্ছেন না আগামীর তারকা, ‘আগামী তিন-চার বছর পর যখন আমাদের জাতীয় দলের অভিজ্ঞ চার-পাঁচজন ক্রিকেটার আর খেলবেন না, তখন দলটার কী হবে? নতুনরা কি দায়িত্ব নেওয়ার মতো পরিণত হয়ে উঠছে? আমরা যে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলাম, এই ক্রিকেটারদের নিয়েই–বা আমাদের পরিকল্পনা কী?’

সাবেক সতীর্থদের সঙ্গে লেখক শাকিল কাসেমও ডুব দিয়েছেন স্মৃতির সাগরে। জানালেন সেই দিনটির কথা, যেদিন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ফারজানা শাকিলকে হাসপাতালে রেখেই মাঠে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সন্তানের জন্মের দিনে খেলা ছিল তাঁর। মাঠের ডাকে সেদিনও সাড়া না দিয়ে পারেননি।

অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, মাঈনুল হক, ইশতিয়াক আহমেদ, সেলিম শাহেদ, মাহমুদুর রহমানের মতো সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট ব্যক্তিত্বরা। ঘণ্টা দু-একের ইতিহাস পরিভ্রমণে তাঁদের স্মৃতির জানালায়ও হয়েছে আবেগের দাপাদাপি। গল্প, আড্ডা আর স্মৃতিচারণার টাইম মেশিন জীবন্ত করে তোলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ৫০ বছরের ইতিহাসকে।