এজাজের কাছে হয়তো নিউজিল্যান্ডের চকোলেটও এত মিষ্টি লাগেনি

ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার পরছবি : এএফপি

‘বাহ! আরও চকলেট!’


পুরো পরিবার ভারত ছেড়ে ভাগ্যের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছে নিউজিল্যান্ডে। কত অনিশ্চয়তা, কত দুশ্চিন্তা! ছোট্ট এজাজের তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। ছোট্ট থেকেই দেখে এসেছেন, নিউজিল্যান্ডে থাকা কোনো আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বাড়িতে উপহার এলে তাতে চকলেটই থাকে বেশি। কিউই চকলেট থেকে শুরু করে ললি—আরও কত কী!

আজ ইতিহাস গড়েছেন এজাজ
ছবি : এএফপি

১৯৯৬ সালে বাবা-মা যখন এজাজকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, সকল অনিশ্চয়তা-দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে এজাজের কাছে বড় হয়ে উঠল আরও বেশি চকলেট পাওয়ার বিষয়টা। মুম্বাইয়ের মণ্ডা-মিঠাই পছন্দ করে যে ছেলের শৈশব কেটেছে, ভিনদেশে আরও বেশি চকলেট পাওয়ার আনন্দে সে মেতে উঠবে না-ই বা কেন!


এজাজের ছোটবেলা কেটেছে অনিশ্চয়তার মধ্যেই। মা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, বাবা মোটরের দোকানে কাজ করতেন। প্রথমে অন্যের দোকানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা এজাজের বাবা পরে পশ্চিম অকল্যান্ডে নিজের দোকান দিয়েছিলেন। পরিশ্রম তাতে কমেনি বিন্দুমাত্র। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে চেপে বসেছিল কিউইদের মতো চোস্ত ইংরেজি না বলতে পারার বিষয়টা। এজাজ আর তাঁর মা মোটামুটি ভালো ইংরেজি বলতে পারলেও, বাবা ভিনদেশি ভাষায় তেমন সড়গড় ছিলেন না। সারাদিন খেটে যাওয়া, হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করা এজাজের বাবার আশা ছিল, ছেলে লেখাপড়া করে পরিবারে আনবে সোনালি দিন, আনবে সচ্ছ্বলতার সুবাতাস।

এই স্পিনেই কুপোকাত হয়েছে ভারত
ছবি : এএফপি

কিন্তু লেখাপড়া নয়, এজাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ততদিনে আবাস গেড়েছে ক্রিকেট। বাঁ হাতি পেস বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অত বেশি লম্বা ছিলেন না, তেমন জোরে বলও করতে পারতেন না। গতির অভাবটা ঘুচিয়ে দিতে চাইতেন সুইং দিয়ে। মুম্বাইতে যতদিন ছিলেন, লেখাপড়ার বাইরে যতটুকু সময় পেতেন, মাঠেই কাটাতেন। ধার করা ব্যাট, জুতো নিয়ে নেমে পড়তেন খেলতে। নিউজিল্যান্ডে এসেও সেটার ব্যতিক্রম হলো না। মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলা ছেলেটার প্রতিভা দেখে চাচা-চাচি ভর্তি করিয়ে দিলেন স্থানীয় এক ক্রিকেট একাডেমিতে। স্কুল ক্রিকেটে ‘ওয়েস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টস’-এর হয়ে ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগটাও হুট করে সেখানেই পেয়ে গেলেন।

নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে গেলেন প্রথম ওভারেই। নতুন বলে প্রথম দুই ডেলিভারিতে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বেশ ভালোই ভোগালেন। ব্যাটসম্যান খাবি খাচ্ছে দেখেই কি না, সাহস একটু বেড়ে গেল এজাজের। এবার চেষ্টা করলেন বাউন্সার দিয়ে পরাস্ত করার। কিন্তু কীসের কী! সজোরে ছক্কা মারলেন সেই ব্যাটসম্যান। নিজের ছোট্ট ক্যারিয়ারে অত বড় ছক্কা এজাজ কখনও খাননি, পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছেন।

আগে পেস বোলিং করতেন এজাজ
ছবি : এএফপি

ছক্কা হজম করে মন-মেজাজ স্বাভাবিকভাবেই খারাপ, এর মধ্যেই ফরমান এল, বল খুঁজে নিয়ে আসতে হবে! ওভারের মাঝখানে বল করা বাদ দিয়ে এজাজ খুঁজতে চলে গেলেন বল—খুঁজতে খুঁজতেই হয়তো মনে হয়েছিল, পেস বোলিং তাঁর কম্মো নয়! ব্যাটসম্যানের নাম এই পর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

মার্টিন গাপটিল।

পেস বোলিং যে খুব খারাপ করতেন, তা নয়। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে নিজের দ্বিতীয় টুর্নামেন্টেই টিম সাউদির সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর বোলিংয়ে বেশ কিছু ঘাটতি দেখতে পেয়েছিলেন কোচেরা। বেশি জোরে বল করতে পারেন না, বল বেশি শক্তি দিয়ে পিচ করতে পারেন না—অনুযোগ ছিল এসব নিয়ে। এজাজকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে এর চেয়ে কতই বা জোরে বল করা যায়!

শেষমেশ ওই ঘাটতিগুলোই কাল হলো, যুবদলে সুযোগ পাওয়া হলো না। ততদিনে টুকটাক স্পিন করাও শুরু করে দিয়েছিলেন এজাজ। যুবদলে সুযোগ না পাওয়ার কারণে পেস বোলার থেকে স্পিনার হওয়ার সিদ্ধান্তটা পাকাপাকিভাবে নিয়ে নিলেন। কে জানতেন, ওই সিদ্ধান্তটাই কয়েক বছর পর জাতীয় দলের দুয়ার খুলে দেবে তাঁর জন্য? আনবে বৈশ্বিক পরিচিতি ও সম্মান?

একেক উইকেট পাওয়ার পর এভাবেই সতীর্থদের অভিনন্দনে সিক্ত হচ্ছিলেন এজাজ প্যাটেল
ছবি : এএফপি

কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেই তো আর হবে না, পেসার থেকে স্পিনার হওয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—আবারও সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। আরেকটা নতুন শিল্পকে শুরু থেকে আয়ত্ত করতে হবে। এ লড়াইয়ে ‘অর্জুন’ এজাজের ‘দ্রোণাচার্য’ হলেন আরেক প্যাটেল—দীপক। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে কিউইদের হয়ে ৩৭ টেস্ট আর ৭৫ ওয়ানডে খেলেছেন যে স্পিনার। প্রতিদিন যে এজাজকে দীপক নতুন নতুন টোটকা শেখাতেন, তা নয়। কয়েক সপ্তাহ অন্তর অন্তর ছোটখাটো জিনিস শেখাতেন, সেটাই সপ্তাহভর আয়ত্ত করতেন এজাজ।

এর মধ্যেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অকল্যান্ডের হয়ে খেলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। অকল্যান্ডে তখন ভূপিন্দর সিং আর ব্রুস মার্টিনের মতো স্পিনার খেলছেন। ফলে জায়গা হলো না এজাজের। পাড়ি জমালেন সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অন্তত আর পেছনে ফিরে তাকাতে হলো না তাঁকে। পরপর দুই মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হলেন।

তবুও জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। এর মধ্যে বয়স হয়ে গেছে ৩০। ততদিনে হয়তো নিজেও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ফেলেছিলেন, ‘ব্ল্যাক ক্যাপ’টা হয়তো আর মাথায় চড়ানো হবে না। কিন্তু আজ হোক বা কাল, পরিশ্রম আর প্রতিভার মূল্য যে অবশ্যই পাওয়া যায়! ক্রিকেটের মজা এখানেই। চেষ্টা ও নিবেদন ধরে রেখে খেলতে থাকলে সাফল্য সুনিশ্চিত।

সেটাই হলো এজাজের ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ডাক পেলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তখন। নির্বাচকের ফোন যখন এল, ভেবেছিলেন আর দশবারের মতো এবারও হয়তো হতাশার কোনো খবরই শুনতে হবে। হয়তো শুনতে হবে, অন্য কোনো স্পিনারকে তাঁর চেয়েও বেশি মনে ধরেছে নির্বাচকদের। কিন্তু নির্বাচকের কথা শুনে রাস্তার ধারে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলেন এজাজ। এতদিনের স্বপ্ন যে অবশেষে পূরণ হচ্ছে তাঁর!

খবর শুনে কাউকে ফোন করলেন না। বাসায়ও জানালেন না সুসংবাদ। শুধু একটা কেক কিনলেন বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, পরিবারের সঙ্গে উদযাপন করার জন্য। কেকের ওপরে লেখা হলো, ‘আমি একজন ব্ল্যাক ক্যাপ’—যেটা বলার জন্য এত দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন!

পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা হলেও মনের কোণে একটা আশা ছিল, জন্মভূমির ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষেই খেলার। এককালে বাড়তি চকলেট পাওয়ার আশায় নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা এজাজ এখন আর ছোট্টটি নেই, রসনার পরিধিও বেড়েছে আগের চেয়ে। ভারতের মাটিতে ভারতীয় খাবার চেখে দেখার স্বপ্ন দেখেন এখন। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সম্প্রতি। পূরণ হয়েছে জন্মভূমি মুম্বাইতে ফিরে টেস্ট ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটাও। সেই ফিরে আসাটাও কী রাজকীয়ই না হলো!

পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক সিরিজেই ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাওয়ার কীর্তি গড়েছিলেন এজাজ প্যাটেল
ছবি : টুইটার

নিজেদের মাটিতে দেশীয় বংশোদ্ভূত এক প্রতিপক্ষের দাপট দেখে মোহাম্মদ সিরাজের হয়তো ভালো লাগছিল না। প্রথম বল থেকেই এজাজকে মেরে খেলতে চাইছিলেন। দ্বিতীয় বলেই ফাইন লেগ দিয়ে এক রকম ভাগ্যের জোরে কাঙ্ক্ষিত বাউন্ডারিটা পেয়ে গেলেন।

ততক্ষণে নয় উইকেট পেয়ে যাওয়া এজাজের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে বুঝি এক চিলতে হাসি দেখা গেল! এক সেন্টিমিটার এদিক-ওদিক হলেই যে আউট হয়ে যান সিরাজ! আর সেটা হলেই জিম লেকার আর অনিল কুম্বলের পর তৃতীয় টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে অমূল্য সেই রেকর্ডটা নিজের হয়ে যায়। ইনিংসে দশ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড। দুনিয়ার বাঘা-বাঘা সব বোলাররা যে রেকর্ডটা নিজের না করতে পারার অতৃপ্তি নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন।একটু হেসেই আবার ফিরে গেলেন নিজের বোলিং লাইনে। একটু আগে হাত ফসকে বেরোতে চাওয়া রেকর্ডটাকে মুঠোয় পুরতে হবেই। স্টাম্প বরাবর স্পিনের বিপরীতে আসা বলটাকে আবারও তেড়েফুঁড়ে স্লগ সুইপ করতে চাইলেন সিরাজ। এবার আর রক্ষে হলো না। বল রকেটের গতিতে চলল উর্ধ্বপানে, বলের নিচে রাচিন রবীন্দ্র।

এই স্কোরকার্ডটাই এখন ইতিহাসের অংশ
ছবি : টুইটার

গোটা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সময় যেন থেমে গেল। হ্যাঁ, সেই রাচিন রবীন্দ্র, এই এজাজ প্যাটেলের সঙ্গে কানপুরে হওয়া আগের টেস্টেই ভারতীয়দের মুঠোয় ঢুকে যাওয়া ম্যাচটাকে বের করে ড্র করেছিলেন যিনি। আবারও এজাজ-রাচিন জুটির ইতিহাস গড়ার অপেক্ষা। পারবেন রাচিন?

বন্ধুকে হতাশ করলেন না তিনি। স্নায়ুচাপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সহজ ক্যাচটা সহজভাবেই ধরলেন মিড অফে। ততক্ষণে মুষ্টিবদ্ধ করে সতীর্থদের সঙ্গে ক্রিজেই উল্লাস শুরু করে দিয়েছেন এজাজ। আর করবেন না-ই বা কেন? ২২ বছর যে রেকর্ডটা বিশ্বের সব বোলারের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, সে রেকর্ডটাকে বশে আনার উল্লাস তো এমনই হওয়া উচিৎ! এত বছরের পরিশ্রম আর ত্যাগের ফল সবচেয়ে মিষ্টি হয়ে যে আজই ধরা দিল! নিউজিল্যান্ডের চকোলেটও হয়তো কখনো এত মিষ্টি লাগেনি এজাজের কাছে!

আগের দিনেই চার উইকেট নেওয়া এই স্পিনার জানিয়েছিলেন, কাজ এখনও বাকি আছে। প্রথম দিনের খেলার শেষে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের অনার্স বোর্ডের সামনে চুপচাপ দেখছিলেন পূর্বসূরিদের কীর্তির কথা। যারা এর আগে এই মাঠে ইনিংসে ন্যূনতম পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। যে ছবিটা নিজেদের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে আবার পোস্টও করেছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট। মনে মনে গতকালই কি তবে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার?

হয়তো!