এবার অস্ট্রেলিয়াও ‘বাংলাদেশ’ দেখবে

অস্ট্রেলিয়া কাল বাংলাদেশকে অল্প রানে আটকে দিলেও সেটি তাড়া করতে পারেনিছবি: প্রথম আলো

‘সঙ্গে জামাকাপড় যা আছে সব পরে দুই কম্বলের নিচে শুয়ে আছি। তাও কাঁপছি।’

হারারেতে এক সন্ধ্যায় তাপমাত্রা নেমে এসেছিল ৪ ডিগ্রিতে। মুঠোফোনের ওয়েদার অ্যাপে দেখাচ্ছিল ‘ফিল লাইক ০ ডিগ্রি’। অর্থাৎ তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি হলেও অনুভূতি শূন্য ডিগ্রির। সেই সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা বিনিময়ের একপর্যায়ে কথাটা বলেছিলেন বাংলাদেশ দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটার।

দিনে সর্বোচ্চ ১৪-১৫ ডিগ্রি, রাতে সেটা নেমে আসত ৪-৫ ডিগ্রিতে। হারারেতে প্রায় এক মাসের সফরে তাই কাঁপাকাঁপির মধ্যেই ছিলেন ক্রিকেটারেরা। মাঠে তবু রোদের মধ্যে থাকায় একটু আরাম হতো। নইলে গরম কাপড় ছাড়া থাকা সেখানে কল্পনাই করা যায়নি।

দেশে ফিরে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মিরপুরে কাল সেই ক্রিকেটাররাই যখন ৩২-৩৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খেলতে নামলেন, অবস্থাটা কেমন হয়েছিল নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

বাংলাদেশে ৩২-৩৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা হয়তো তেমন কিছুই নয়। তারওপর খেলা হয়েছে সন্ধ্যায়। তবু অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল, সেটা বাংলাদেশ দলের এক ক্রিকেটারের মুখেই শোনা যাক, ‘এটা ঠিক যে খেলা হয়েছে সন্ধ্যায়। তারপরও গরমে আমাদের বেশ সমস্যাই হচ্ছিল। জিম্বাবুয়ে থেকে এসে ঢাকায় মাত্র দুটি সেশন অনুশীলন করেছি। ঠান্ডার দেশে খেলে এসে এত অল্প সময়ে দেশের গরমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কিন্তু সহজ নয়।’

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছে মাত্র পাঁচবার
ছবি: প্রথম আলো

ম্যাচে কখনো কখনো অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছিল অস্বস্তিকর গরম। অবশ্য আবহাওয়া যে রকমই হোক, ভিনদেশি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ঘরের মাঠের খেলায় সেটা কখনোই অজুহাত হতে পারে না। আবহাওয়া যদি স্বাগতিক ক্রিকেটারদেরই সমস্যায় ফেলে, তাহলে অতিথিদের জন্য সেটা আরও বেশি প্রতিকূলই হওয়ার কথা। অস্ট্রেলিয়া দলের এক ক্রিকেটারকে তো কাল মাঠে বমিও করতে দেখা গেছে!

গরমের অস্বস্তি বাদ দিলে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জিতে ফেরাটাকে অনেকে হয়তো বলবেন দুর্বলের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে আসা, কিন্তু খেলাধুলায় একটা কথা সব সময়ই চরম সত্য যে জয় যাদের বিপক্ষেই আসুক না কেন, সেটা আত্মবিশ্বাসে সঞ্জীবনীসুধা ঢালবেই। পরের ম্যাচে সেই জয়ের সুখানুভূতি অদৃশ্যভাবে হলেও আপনার কলারটা উঁচু করে রাখবে।

আর এই অস্ট্রেলিয়া তো কিছুটা হলেও দুর্বল। অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নাররা আসেননি। উইকেটও যে বাংলাদেশের স্পিনারদের হয়ে কথা বলবে, সেটা তো ব্যাটিংয়ের সময়ই বোঝা হয়ে গেছে। ১৩১ রান করেও তাই বাংলাদেশ ছিল জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এত কম রান করে এর আগে টি-টোয়েন্টি জেতেনি বাংলাদেশ। তবু ইনিংস শেষে ড্রেসিংরুমের আবহে অমঙ্গলের বাতাস অনুভব করেনি কেউ। সবাই বলছেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ম্যাচটা আমরা জিততে যাচ্ছি।’

কথাটা সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বলা পুরোনো একটা উক্তিই মনে করিয়ে দিল। বাংলাদেশ যখন হঠাৎ হঠাৎ বড় জয় পাওয়া শুরু করল, তখন মাশরাফি একদিন বলেছিলেন, যেদিন বাংলাদেশ জিতবে, সেদিন নাকি সেটা ড্রেসিংরুমে আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় জয়ের গন্ধ।

বাংলাদেশ কাল মিরপুরে এমন উইকেটের আনন্দে মেতেছে বারবার
ছবি: প্রথম আলো

ব্যাপারটা অলৌকিক কিছু ছিল না। আসলে সেটাও ছিল একধরনের আত্মবিশ্বাস, তবে অনেক বেশি আবেগনির্ভর ছিল সেটি। যেটা মাঝেমধ্যেই ভর করত দলটার মধ্যে। কিন্তু এখন ‘মাঝেমধ্যে’ নয়, বড় দলের বিপক্ষে জয়ের আত্মবিশ্বাস, বড় ম্যাচে জয় নিয়ে ফেরার লক্ষ্য সব সময়ই সঙ্গী বাংলাদেশ দলের। কখনো সেই লক্ষ্য পূরণ হয়, কখনো হয় না।

আবেগের দিন পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন যুক্তিতর্ক দিয়েই হিসাব করে নেয়, কোন ম্যাচটা জেতা সম্ভব আর কোনটা জেতা সহজ হবে না। সে চিন্তায় ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের প্রভাব যেমন থাকে, থাকে প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা, কন্ডিশন এবং অবশ্যই নিজেদের ওপর নিজেদের আস্থা।

একটা সময় ছিল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা মানেই ধরে নেওয়া হতো বাংলাদেশ হারবে। তার মধ্যেই চমক হয়ে এসেছে কার্ডিফ জয়, ঢাকায় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ও। শক্তি আর সামর্থ্যের বিচারে দলটা এখনো অনেক এগিয়ে থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হারার আগে হেরে যাওয়ার দিন ধীরে ধীরে অতীত হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে।

হতে পারে এখনো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলে বাংলাদেশ বেশির ভাগ ম্যাচে হারবে। কিন্তু এখন অস্ট্রেলিয়াও জয়টা নিশ্চিত ধরে মাঠে নামবে না। বাংলাদেশও ভাববে না, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা মানেই তো হার!

মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট এই জায়গায় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খুব বেশি ম্যাচ না খেলেই! কালকের টি-টোয়েন্টিসহ তিন সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়েই গত ৫ বছরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলার সুযোগ হয়েছে মাত্র ৫টি ম্যাচ।

হিসাবটা শুরু থেকেই দেওয়া যাক। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে এই পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ ম্যাচ খেলেছে মোট ৩২টি। ২০০৫ সালে কার্ডিফে পাওয়া ওয়ানডে, ২০১৭ সালের আগস্টে ঢাকা টেস্ট এবং সর্বশেষ গতকাল পাওয়া টি-টোয়েন্টি জয়সহ তাদের হারানো গেছে মাত্র তিনবার।

বাংলাদেশের স্পিনই সামলাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া
ছবি: প্রথম আলো

একটি ওয়ানডে হয়েছে পরিত্যক্ত। ২০১৭ সালের ওভালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দুই দলের ম্যাচটি শেষ হতে পারেনি বৃষ্টির কারণে। বাংলাদেশের তিন জয় আর পরিত্যক্ত এই ম্যাচ বাদে তিন সংস্করণ মিলিয়ে বাকি ২৮ ম্যাচেই জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। সে তালিকায় তারা সর্বশেষ জয়টি পেয়েছে ২০১৯ বিশ্বকাপে নটিংহামে এবং তার আগের ২৭তমটি তারও দুই বছর আগে বাংলাদেশ সফরে এসে।

আগেরগুলো বাদ দিয়ে ২০১০ সাল থেকেও যদি ধরেন, সে বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলেছে শুধু একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ২০১১ সালে তিনটি ওয়ানডে। মাঝে দুই বছর বিরতি দিয়ে এরপর আবার দুই দলের সাক্ষাৎ ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। এ বছর এই একটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ আবারও অস্ট্রেলিয়ার দেখা পায় ভারতে অনুষ্ঠিত পরবর্তী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে, ২০১৬ সালে। পরের বছর অবশ্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পরিত্যক্ত ম্যাচ ছাড়াও ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এরপর আবার ২০১৮ সালে মাঠে পাওয়া যায়নি অস্ট্রেলিয়ার দেখা।

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার সুযোগটা অনিয়মিতভাবে এলেও এই সময় অন্য দলগুলোর সঙ্গে খেলে বাংলাদেশ বুঝে গেছে বড় ম্যাচ জয়ের সমীকরণ। ছোট দলের বিপক্ষে অনেক সময় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করে বিরুদ্ধ স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশলটাও এখন তাদের জানা। মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে থাকার যে ব্যাপারটা ছিল, খেলতে খেলতে শিখতে শিখতে সেখানেও এসেছে উন্নতি। নিজেদের নিয়ে আসতে পেরেছে অস্ট্রেলিয়ার চোখেও চোখ রেখে কথা বলার জায়গায়।

সবাই-ই এখন সেটা জানে। তবে ‘ছোট’ দল বাংলাদেশের সঙ্গে না খেলার নানা টালবাহানায় হয়তো সেটা অজানা ছিল অস্ট্রেলিয়ারই। সিরিজে এখনো চারটি ম্যাচ বাকি। বাংলাদেশকে নিয়মিত না দেখার ঘাটতিটা এবার নিশ্চয়ই ‘পুষিয়ে’ নেবে তারা।