এবার আমরা শিঙাড়া খাব না

>
নিউজিল্যান্ড অভিযানে বাংলাদেশের দুই অধিনায়ক। প্রথম পর্ব সীমিত ওভারে মাশরাফি, দ্বিতীয় পর্ব টেস্ট সিরিজে মুশফিক l প্রথম আলো
নিউজিল্যান্ড অভিযানে বাংলাদেশের দুই অধিনায়ক। প্রথম পর্ব সীমিত ওভারে মাশরাফি, দ্বিতীয় পর্ব টেস্ট সিরিজে মুশফিক l প্রথম আলো
নিউজিল্যান্ড সফরের স্মৃতি মনে হলে কুইন্সটাউনে ভয়াল সেই ম্যাচের স্মৃতিও ফিরে আসে। সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশে এত পার্থক্য যে এবার আর সেটির পুনরাবৃত্তি হবে বলে মনে হয় না। লিখেছেন তারেক মাহমুদ

কুইন্সটাউনে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে ম্যাচ চলছে। বাংলাদেশ ৯৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ায় ম্যাচের আকর্ষণ বলতে আর কিছুই বাকি থাকল না। এই ম্যাচ তো নিউজিল্যান্ড হেসেখেলে জিতবে!

বেদনাময় সম্ভাবনার সামনে দাঁড়ানো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে গেল শিঙাড়ার ম–ম গন্ধ। মাঠের পাশে মাটির ঢিবির মতো উঁচু জায়গা। ওটার ও পাশেই এক দোকানে শিঙাড়া ভাজা হচ্ছে। একেবারে ‘বাঙালি’ শিঙাড়া। বাংলাদেশ দলের ম্যাড়মেড়ে ব্যাটিং, ঠান্ডায় নেতানো দিন—চাঙা হতে এর চেয়ে বড় ওষুধ আর কী আছে!
সেই শিঙাড়াই করল সর্বনাশ! কে জানত, মাটির ঢিবির ওপারে গিয়ে ফিরে আসতে আসতেই খেলা শেষ দৃশ্যে গিয়ে ঠেকবে! ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন। আর ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ব্যাটের তাণ্ডব ম্যাচ শেষ করে দিল মাত্র ৬ ওভারে! বাংলাদেশের হারের বেদনার চেয়েও বড় দুঃখ যেন ম্যাককালামের ২৮ বলে অপরাজিত ৮০ রানের ঝড় মিস করে ফেলা। যাঁরা শিঙাড়া খেতে গিয়েছিলেন, তাঁরা জীবনের সবচেয়ে ‘দামি’ শিঙাড়াই বোধ হয় খেলেন সেদিন। নয়তো এখনো আফসোস করবেন কেন?
শিঙাড়া খাওয়ার এই গল্প ২০০৭ সালে বছরের শেষ দিনের। সেবার নিউজিল্যান্ড সফর কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের কাছ থেকেই শোনা। নিউজিল্যান্ড যাচ্ছি শুনে এবার অনেকেই সতর্ক করতে চাইলেন, ‘ভাই, শিঙাড়া খেতে যাইয়েন না কিন্তু...।’
না, আমরা আসলেই শিঙাড়া খাব না। কুইন্সটাউনে এবার খেলা নেই বলে মাটির ঢিবির ওপারে যাওয়ার প্রলোভনও নেই। তার ওপর শিঙাড়া খেতে গিয়ে এবার তো আরও বড় আফসোসের মধ্যে পড়তে হতে পারে। দেখা গেল, একদিকে সবাই ধোঁয়া ওঠা গরম শিঙাড়ায় ফুঁ দিচ্ছে, অন্যদিকে ইতিহাস গড়ে ফেললেন বাংলাদেশেরই কেউ! সেটা হতে পারে তামিম, সাকিব, মুশফিকদের দুর্দান্ত কোনো ইনিংস। কিংবা মোস্তাফিজের একটা জাদুকরি স্পেল।
২০০৭ মানে নয় বছর আগের কথা। সেই দিন অনেক আগেই বাঘের পেটে চলে গেছে। নিউজিল্যান্ড এর মধ্যে দেখেছে ‘বাংলাওয়াশের’ স্বাদ দেওয়া ২০১০ আর ২০১৩-এর বাংলাদেশকে। তারা জানে, দলটা এখন যে কারও ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে পারে। বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার শুরুটাও কিউইরাই সবার আগে কাছ থেকে দেখেছে। নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই তো খোলস থেকে বের হতে লাগল অন্য বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে দেশে ফিরে একের পর এক চমক–জাগানিয়া সাফল্য। নিউজিল্যান্ডে গিয়েও এই দল সে রকম কিছু করে ফেলবে না, তার কী নিশ্চয়তা!
শিঙাড়া খেতে যাওয়ার তাই প্রশ্নই ওঠে না। বরং অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ জেতা দেখতে সবাই মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকব। কী সেই চ্যালেঞ্জ, তা সবারই জানা। মাশরাফি বলেছেন, মুশফিক বলেছেন। তার পরও বলি। চ্যালেঞ্জটা বিদেশের মাটিতে ভালো দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের। সেটা যে নিউজিল্যান্ডকে আবারও ‘বাংলাওয়াশ’ করে করতে হবে, তা নয়। এ জন্য সিরিজ জিতে আসারও বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু ভালো খেলতে হবে। বিরুদ্ধ কন্ডিশনেও চাই ভালো ব্যাটিং। বড় জুটি, ঝকঝকে লম্বা ইনিংস চাই ব্যাটসম্যানদের কাছে। পেসাররা সিমিং কন্ডিশনের সুবিধা নিয়ে চমকে দেবেন। স্পিনাররা কারও তাণ্ডবে ঘাবড়ে যাবেন না। হঠাৎ আসা ঠান্ডা হাওয়ার কাঁপুনি ফিল্ডারদের হাত থেকে ফেলবে না কোনো ক্যাচ।
ক্রিকেটের সেই শুরু থেকে আজও ভালো খেলার মৌলিক শর্ত এসবই। দেশে কিংবা বিদেশে, কোথাও আজ পর্যন্ত বাজে ব্যাটিং, নির্বিষ বোলিং আর পিচ্ছিল ফিল্ডিং করে কোনো দল ভালো খেলেছে বলে শোনা যায়নি। দেশের বাইরে ভালো দল হিসেবে মাথা তুলতে বাংলাদেশ দলকেও কোনো রকেট বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে হবে না। যেটা করতে হবে, সেটা তারা আগেও অনেকবার করে দেখিয়েছে। প্রতিপক্ষ, স্থান-কাল ভুলে নিজেদের সামর্থ্য উজাড় করে দেওয়া।
বাংলাদেশ সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছে গেলে নিউজিল্যান্ডও যে এমন কোনো দল নয়, সেটা দুই দলের সর্বশেষ দুটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজেই প্রমাণ হয়েছে। দুটিতেই ওয়ানডে সিরিজে সব ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ড্র হয়েছে টেস্ট সিরিজও। এবার বাড়তি বাধা হতে পারে শুধু নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন। কিন্তু সেটা যেন শেষ পর্যন্ত বাধা না হয়, সে জন্যই তো নয়–দশ দিন আগে থেকে সিডনিতে ক্যাম্প করা। সিডনির অনুশীলন ক্যাম্পের উইকেট অনেকটা নিউজিল্যান্ডের উইকেটের মতোই ছিল বলে মানিয়ে নেওয়ার কাজটাও সহজ হওয়ার কথা বাংলাদেশের জন্য। নিউজিল্যান্ড একাদশের বিপক্ষে ওয়াঙ্গেরির প্রস্তুতি ম্যাচের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগার কথা। বাংলাদেশ ম্যাচটা হারলেও নিউজিল্যান্ডের জল-হাওয়া বোঝার ম্যাচে সৌম্যর রানে আর সাকিবের উইকেটে ফেরাও আশায় বুক বাঁধতে বলে। দীর্ঘ চোট বিরতির পর মাঠে ফিরেই মোস্তাফিজের ৭ ওভার বল করাই যথেষ্ট ছিল। সঙ্গে বোনাস হিসেবে আসা ২ উইকেট যেন এটিই জানিয়ে দিল যে নতুন চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য পূর্ণ শক্তির দলই দাঁড়াচ্ছে নিউজিল্যান্ডের সামনে।
এ লেখা যখন পড়ছেন, ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশ দল তখন সিরিজের প্রথম ওয়ানডে খেলার অপেক্ষায়। ঘরের মাঠের বাঘের সামনে বিদেশেও লড়াকু হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ সিরিজ সামনে রেখে কুইন্সটাউনের সেই শিঙাড়াওয়ালা এবার ক্রাইস্টচার্চ, নেপিয়ার, নেলসেনেও শাখা খুলে বসলে নিজ দায়িত্বে বসতে পারেন।
আমাদের এবার শিঙাড়া খাওয়ার সময় থাকবে না।