ওয়াসিম আকরামকে খেলতে টেনিস বলে অনুশীলন!

১৯৯৫ সালের মার্চে মোহামেডানের বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর ওয়াসিম আকরাম। তাঁর দুই পাশে মিনহাজুল আবেদীন ও নাঈমুর রহমান। ছবি: শামসুল হক
১৯৯৫ সালের মার্চে মোহামেডানের বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর ওয়াসিম আকরাম। তাঁর দুই পাশে মিনহাজুল আবেদীন ও নাঈমুর রহমান। ছবি: শামসুল হক

এই তো সেদিন তামিম ইকবালের ফেসবুক লাইভে এসে ওয়াসিম আকরাম নস্টালজিয়ায় মাতলেন। ২৫ বছর আগে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে খেলা তাঁর সেই ম্যাচটি যেন এতদিনেও ভোলেননি তিনি। ভুলবেন কীভাবে, সে ম্যাচে যে হেরে গিয়েছিল তাঁর আবাহনী। তামিমের লাইভে সে ম্যাচে তাঁর দুই সতীর্থ মিনহাজুল আবেদীন ও আকরাম খানও হয়ে উঠেছিলেন স্মৃতি মেদুর।

কিন্তু ১৯৯৫ সালের ১১ মার্চ, সে ম্যাচে আকরাম তথা আবাহনীর প্রতিপক্ষ মোহামেডান শিবিরের গল্পটাও কিন্তু চমকপ্রদ। বিশ্বসেরা বোলারকে সামলানোর প্রস্তুতিটা সেদিন তাঁরা নিয়েছিলেন টেনিস বলে অনুশীলন করে! এই গল্পটা অবশ্য আকরামের জানার কথা নয়। এত বছর সেই গল্পটা বললেন সে ম্যাচে ব্যাট হাতে মোহামেডানের অন্যতম সেরা পারফরমার সাজ্জাদ আহমেদ। এই প্রজন্মের কাছে তিনি যে খুব পরিচিত, সেটি নয়। অমিত সম্ভাবনা জাগিয়েও ২টি ওয়ানডে খেলেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। অথচ, ২৫ বছর আগে এই সাজ্জাদ আহমেদকেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিত অনেকের চেয়েই বেশি প্রতিভাবান ক্রিকেটার হিসেবে ধরা হতো।

১৯৯৫ সালের লিগে আবাহনীর বিপক্ষে সে ম্যাচে ওয়াসিম আকরামের মতো বিশ্বসেরা ফাস্ট বোলারকে দারুণভাবে সামলেছিলেন সে সময়ের তরুণ সাজ্জাদ। 'শিপন' নামেই সে সময় ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশি পরিচিতি ছিল তাঁর। সে ম্যাচে ৪২ রান করা সাজ্জাদ আকরামের বিপক্ষে দারুণ দৃষ্টিনন্দন দুটি বাউন্ডারি মেরেই হয়ে গিয়েছিলেন 'টক অব দ্য টাউন'। সে ম্যাচের স্মৃতি এতটুকু ফিকে হয়নি সাজ্জাদের, 'সে সময় আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচ মানেই তো বাড়তি উত্তেজনা, বাড়তি চাপ। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের সামনে খেলা। এমন একটা ম্যাচেই প্রতিপক্ষ দলে ছিলেন ওয়াসিম আকরামের মতো ফাস্ট বোলার। সে ম্যাচ ভুলি কীভাবে!'

আকরামকে ভালোভাবে মোকাবিলা করার বাড়তি প্রস্তুতিটা মোহামেডানের ব্যাটসম্যানেরা নিয়েছিল টেনিস বলে অনুশীলন করে, 'মোহামেডানে তিন পাকিস্তানি ক্রিকেটার খেলতেন। নাদিম ইউনুস, আমির মালিক। ওয়াসিম আকরামের তুলনায় কিছুই নন তাঁরা।  আমরা তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলাম আকরামকে কীভাবে মোকাবিলা করব। মনে আছে ম্যাচের দুই–তিনদিন আগে থেকে প্রচুর টেনিস বল কিনে নিয়ে এসে তার একদিকে টেপ প্যাঁচানো হলো। আকরামের সুইং মোকাবিলা করার জন্য এ বুদ্ধি পাকিস্তানিদেরই। খুব কাছ থেকে টেনিস বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাঁরা আমাদের অনুশীলনে সাহায্য করতেন।'

অনুশীলন বিফলে যায়নি সেদিন মোহামেডানের ব্যাটসম্যানদের। ওয়াসিম আকরাম সেদিন খুব বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেননি। নাদিম ইউনুসের সঙ্গে ১২১ রানের এক জুটি গড়েছিলেন সাজ্জাদ আহমেদ। মূলত সে জুটিটিই মোহামেডানের জয় সেদিন সহজ করে তুলেছিল। সাজ্জাদের কাছে সে স্মৃতি মধুরই, 'ওয়াসিম আকরামের বল বেশ সহজেই খেলেছিলাম। তাঁর ইয়র্কার লেংথের একটা বলে চার মেরেছিলাম। মোহামেডানের সমর্থকেরা খুব আনন্দ পেয়েছিল সেটিতে। আসলে মূল ইনিংসটা খেলেছিলেন নাদিম ইউনুস। তাঁর ৮৪ রানের ইনিংসটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মনে আছে ওয়াসিম আকরাম নাদিম ইউনুসের ক্যাচ ছেড়েছিলেন। রফিক ভাই নিয়েছিলেন আকরামের উইকেট।'

সাজ্জাদ আহমেদ সেদিন ওয়াসিম আকরামকে খেলেছিলেন কর্তৃত্ব নিয়েই। ফাইল ছবি
সাজ্জাদ আহমেদ সেদিন ওয়াসিম আকরামকে খেলেছিলেন কর্তৃত্ব নিয়েই। ফাইল ছবি

সে ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তটিই বেশি নাটকীয়। আর সেই নাটকীয় ঘটনা মনে করে যেন আরও বেশি রোমাঞ্চিত হন সাজ্জাদ, 'শেষ দুই ওভারে জিততে মোহামেডানের প্রয়োজন ছিল ৯ রান হাতে ৩ উইকেট। আকরাম এসেই খুব সম্ভবত শান্তকে (হাসিবুল হোসেন) বোল্ড করেছিল। ভয়ংকর ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার। আমরা খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। নাসু ভাই (নাসির আহমেদ, জাতীয় দলের সাবেক উইকেটরক্ষক ও পরবর্তীতে কম্পিউটার অ্যানালিস্ট), লিটু ভাই (মুস্তাদির লিটু, বাঁ হাতি স্পিনার ছিলেন) ও ইকবাল সিকান্দার। আকরাম ওই পরিস্থিতিতে সে সময় কত ম্যাচ যে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন; লিটু ভাইকে বোল্ডও করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটি নো বল কল করেন আম্পায়ার। টার্নিং পয়েন্ট ছিল সেটিই। আবাহনীর ফিল্ডার সাইফুল ভাই বুঝতে পারেননি যে নো বল। বল থার্ড ম্যানের দিকে চলে গেলেও সাইফুল ভাই মনে মনে করেছিলেন ম্যাচ জিতে গেছে আবাহনী। তিনি উল্লাস করা শুরু করেছিলেন। এই ফাঁকে বল বাউন্ডারি পার হয়ে যায়। মোহামেডানও যায় জিতে। ওই মুহূর্তটা দারুণ স্মরণীয়।'

সে ম্যাচের আরও একটা মজার মুহূর্ত এখনো ভোলেননি সাজ্জাদ। আর সেটি হচ্ছে আবাহনীর ক্রিকেটারদের দেওয়া উৎসাহ। চরম প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে উৎসাহ, ব্যাপারটা একটু কেমন নয়! সাজ্জাদ ঘটনাটা খুলেই বললেন, '১৯৯৫ সালের ওই সময়টায় বাংলাদেশের ক্রিকেট নতুন উচ্চতায় উঠছে। আমার বয়স তখন অনেক কম। একজন তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে ওয়াসিম আকরামের মতো বোলারকে আমি আরাম করে খেলছি, সেটা বোধহয় উপভোগ করছিলেন আকরাম ভাই, নান্নুভাই, লিপু ভাইরা। আমি ব্যাটিং করার সময় আকরাম ভাই, নান্নু ভাই, লিপু ভাইরা বেশ কয়েকবার কাছে এসে বলেছেন, “ভালো হচ্ছে, খেলে যাও”। এটা সত্যিই দারুণ ব্যাপার ছিল।'

ওয়াসিম আকরাম সে ম্যাচে কথার ফুলঝুড়ি ছোটাননি। সেটা বললেন সাজ্জাদ, 'আমার মনে পড়ে না ওয়াসিম আকরাম আমাদেরকে সেদিন স্লেজ করেছিলেন কিনা। করলে মনে থাকত। আসলে স্লেজিং সংস্কৃতিটা সে সময় আমাদের ক্রিকেটে তেমন একটা ছিল না। আমি যে বলটাতে আকরামকে চার মেরেছিলাম, সেটিতে একবার আমার দিকে দেখেই বোলিং মার্কের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলেন তিনি। আরেকটা ঘটনা আছে, বোলিং মার্কের দিকে তিন–চার স্টেপ হেঁটেই তিনি ঘুরে বোলিংয়ের দৌড় শুরু করেছিলেন। হয়তো আমাকে চমকে দিতেই। আমিও স্টান্স ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। এটাতেও তিনি বিরক্ত হননি। এ যুগ হলে নির্ঘাত আমি বোলারের গালি খেতাম।'

আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে 'আক্ষেপ' হয়ে আছেন যে কজন ক্রিকেটার, তাদের অন্যতম সাজ্জাদ। ওয়াসিম আকরামকে মোকাবিলা করার এক মাসের মাথাতেই শারজায় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলে সুযোগ পান তিনি। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেকও হয় তাঁর তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে। ভালো করতে পারেননি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরের ম্যাচেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। শেষ ম্যাচে ওয়াসিম আকরামকে (পাকিস্তানের বিপক্ষে) আরেকবার খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর। একাদশ থেকে বাদ পড়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে সাজ্জাদ আহমেদ, শারজা এশিয়া কাপ, ১৯৯৫। ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে সাজ্জাদ আহমেদ, শারজা এশিয়া কাপ, ১৯৯৫। ছবি: সংগৃহীত

এরপর দেশের ক্রিকেটে কত ঘটনা! '৯৬ সালে এসিসি ট্রফি জয়, এরপর ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি—বিশ্বকাপে নাম লেখানো, ওয়ানডে ও পরবর্তী সময়ে টেস্ট স্ট্যাটাস। 'সাজ্জাদ আহমেদ' নামটি নেই কোথাও। ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর নিজেরও যে আক্ষেপ আছে সেটি বোঝা যায় তাঁর কথাতেই, 'আসলে ক্রিকেটে বড় কিছু করতে হবে, বিশেষ অর্জনের খাতায় নাম লেখাতে হবে, সেসব কখনো ভাবিনি। মনের আনন্দে খেলেছি, ভালো হলে ভালো, খারাপ হলে খারাপ। হ্যাঁ, আফসোস তো হয়ই। দেশের ক্রিকেটের পরের অর্জনগুলোর সঙ্গে আমার নামও লেখা থাকতে পারত। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমি সময়ের আগে অনেক কিছুই পেয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই হয়তো কাল হয়েছে। ভাবতে পারেন ওই সময় নোবেল ভাই (নূরুল আবেদীন নোবেল) মাসুম ভাই (জাহিদ রাজ্জাক মাসুম), সেলিম শাহেদ ভাইদের টপকে আমি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলাম! ওনারা তখন নিজেদের পজিশনে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান। এত বছর পর এখন আর এসব নিয়ে ভাবিনা।'

সাজ্জাদ অবশ্য পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে জড়িয়ে থেকেছেন নির্বাচকের ভূমিকায়। ২০১৬–১৭ সালের দিকে বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক ছিলেন। জাতীয় ক্রিকেট দলেরও নির্বাচক ছিলেন কিছু দিন।প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ৩৩টি। লিস্ট 'এ' ৩৯টি। প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৬টি ফিফটির সঙ্গে একটি সেঞ্চুরিও আছে তাঁর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে রাঙাতে হয়তো পারেননি। কিন্তু ২৫ বছর আগের প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচের জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সাজ্জাদ আহমেদ। সে ম্যাচে যে ওয়াসিম আকরামকে কর্তৃত্ব নিয়েই খেলেছিলেন তিনি!