করোনা ঠেকাতে বিসিবির 'পঞ্চবটিকা'

করোনা পরীক্ষায় যুব দলের সব ক্রিকেটার ভালোভাবেই উতরে গেছেন। ছবি: বিসিবিছবি: প্রথম আলো


দেশে করোনাপরিস্থিতির উন্নতি নাকি অবনতি হচ্ছে—সেটি বলা কঠিন। সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই। থেমে নেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি), শুরু করেছে ক্রিকেটীয় কার্যক্রম। শুরুটা ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত অনুশীলন দিয়ে হলেও করোনার মধ্যে ক্রিকেটে ফেরাতে বিসিবির প্রথম উদ্যোগ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্প শুরু করা।

বিকেএসপিতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্প শুরুর আগে বিসিবির প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ক্রিকেটারদের কোভিড পরীক্ষা। কদিন আগে বাংলাদেশ ফুটবল দল যেভাবে করোনাধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গেল, স্বাভাবিকভাবেই সংশয় ছিল, ক্রিকেট কি পারবে করোনামুক্ত থাকতে?


প্রথম ধাপটা বিসিবি সফলভাবেই উতরেছে। বিসিবির ডাকা ৪৫ ক্রিকেটারের ৪৪ জনই হয়েছেন নেগেটিভ। যে একজন পজিটিভ হয়েছিলেন, তিনি আবার পরের পরীক্ষায় নেগেটিভ হয়েছেন। সোমবার তাঁর তৃতীয় করোনা পরীক্ষা হয়েছে।

দেশের বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে এত সংখ্যক ক্রিকেটারের 'নেগেটিভ' হওয়া বিস্ময়করই! তারা তো এ সমাজেরই অংশ। সবার মতো তাঁদেরও থাকতে হয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকিতে। তবে এই ক্রিকেটারদের করোনামুক্ত রাখতে ছিল বিসিবির ৫টি বিশেষ উদ্যোগ। কে জানে, হয়তো সেগুলোই যুব ক্রিকেটারদের এখন পর্যন্ত রেখেছে করোনা নেগেটিভ।

করোনা পরীক্ষার আগে–পরে যুবা ক্রিকেটারদের কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হয়েছে।
ছবি: প্রথম আলো

মনিটরিং
জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাই শেষে বিসিবি জুলাইয়ের শেষ দিকে তৈরি করে ৪৫ জনের প্রাথমিক দল। দলের ক্রিকেটারদের কোভিডমুক্ত রাখার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট ও মেডিকেল বিভাগ খেলোয়াড়দের বাসায় মনিটরিং করা শুরু করে। দেখা হয় সবার পারিবারিক সংক্রমণের ইতিহাস। দেখা হয় গত কয়েক মাসে পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা। হলে তাদের সর্বশেষ কী অবস্থা। ক্রিকেটাররা করোনার এ সময়ে অসুস্থ হয়েছিল কিনা, হলে সর্বশেষ কী অবস্থা—সব জানার চেষ্টা করেছে বিসিবি। ক্রিকেটারদের পারিবারিক এ তথ্যগুলো বিসিবি সংগ্রহ করেছে তৃণমূল পর্যায়ের কোচদের কাছ থেকে। স্থানীয় কোচদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন কেন্দ্রে থাকা কোচরা।

যুবা ক্রিকেটারদের মধ্যে মাত্র একজনের করোনা পজিটিভ।
ছবি: প্রথম আলো

হোম কোয়ারেন্টিন
কোভিড-১৯ পরীক্ষার আট দিন আগে প্রত্যেক ক্রিকেটারকে হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যাওয়ার নির্দেশ ছিল বিসিবির। বলা হয়েছিল যেন বাসার বাইরে বের না হয় কেউ। বাসায় যে ফিটনেসের কাজ আছে শুধু সেগুলোই করবে তাঁরা। বিসিবির লক্ষ্য ছিল, এক সপ্তাহে যদি খেলোয়াড়েরা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকে আর বাসায় যদি কেউ অসুস্থ না থাকে তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। আর কারও যদি লক্ষণ থাকেও, এর মধ্যে সেরে ওঠার সুযোগ থাকবে।

ভ্রমণ সতর্কতা
বিকেএসপিতে পাঠানোর আগে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য তিনটি দলে তরুণ ক্রিকেটারদের রাখা হয় মিরপুরের একাডেমি ভবন ও ক্রীড়া পল্লীতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা যুবাদের জন্য ছিল বিশেষ ভ্রমণ সতর্কতা। তাঁরা কোন ধরনের পরিবহন ব্যবহার করবে, পথে বিরতিতে রেস্তোরাঁয় না বসা, যাত্রাপথে খাওয়ার দরকার হলে যেন বাসা থেকে খাবার আনা হয়—এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা
একাডেমি ও ক্রীড়াপল্লীতে প্রবেশের আগে প্রত্যেক ক্রিকেটারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়, করোনার এ সময়ে যে সব পরীক্ষা সাধারণত করা হয়। সে পরীক্ষায় কারও মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। একাডেমি ভবন ও ক্রীড়াপল্লীতে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় খেলোয়াড়দের। কারও সঙ্গে কারও দেখা করার সুযোগ ছিল না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ বরাদ্দ ছিল। খেলোয়াড়েরা যেন বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই বোধ না করেন, সেভাবেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাবার, পানি কিংবা যত ধরনের সহযোগিতা দরকার সব করা হয়।

'আমাদের এই ক্যাম্পকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমে আমরা স্কিল নিয়ে কাজ করছি। নেটে ৮ দিন সময় পাব। যেখানে ব্যাটসম্যান, বোলাররা নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে।'
মেহরাব হোসেন, যুব দলের ব্যাটিং কোচ

কোভিড-১৯ পরীক্ষা
প্রথমদিকে ক্রিকেটারদের নমুনা নেওয়া হয় মিরপুরের একাডেমি ভবনের একটি রুমে ডেকে। পরে সেটি আর করা হয়নি। ক্রিকেটারদের রুমে রুমে গিয়ে সংগ্রহ করা হয় নমুনা। পরীক্ষা দিতে গিয়েও যেন কারও সঙ্গে কারও দেখা-সাক্ষাৎ না হয়, সে কারণেই এ ব্যবস্থা। ফল না আসা পর্যন্ত কেউ রুম থেকে বের হননি। ফল পাওয়ার পর তাদের দ্রুত বিকেএসপিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষায় সবাই নেগেটিভ হওয়ায় বিকেএসপিতে এক রুমে দুজন করে রাখা হচ্ছে। তবে এখনো কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে, যেটা আরও এক সপ্তাহ অব্যাহত রাখবে ক্রিকেট বোর্ড।
কোভিড পরীক্ষায় এই সাফল্য বিস্ময়কর লাগছে বিসিবির সিনিয়র চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীর কাছেই! প্রথম আলোকে তিনি বলেন, 'হয়তো ভয় থেকেই খেলোয়াড়েরা বেশি সতর্ক ছিল। যদি পজিটিভ হয়ে যায়, ক্যাম্পে আসতে পারবে না। ক্যাম্প মিস করা মানে বিশ্বকাপের দলে না থাকা। গত যুব বিশ্বকাপ জেতার পর তারা উপলব্ধি করেছে এই দলে সুযোগ পেতেই হবে। এ কারণে সব নির্দেশনা ভালোভাবে মেনেছে। বাংলাদেশে সংক্রমণের যে চিত্র, এ ফল একটু অন্যরকমই বলতে হবে।'

'এটা অনেক লম্বা ক্যাম্প। আমরা শুরুতে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছি, তাতে আপাতত সফল হয়েছি। আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। আরও সপ্তাহখানেক গেলে বুঝতে পারব কতটা সফল হয়েছি আমরা।'
আবু ইমাম কাওসার, ব্যবস্থাপক, বিসিবি গেম ডেভেলপমেন্ট

তবে এখনই আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চায় না বিসিবির গেম ডেভলেপমেন্ট বিভাগ। বিভাগের ব্যবস্থাপক আবু ইমাম মোহাম্মদ কাওসার বলছেন, 'এটা অনেক লম্বা ক্যাম্প। আমরা শুরুতে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছি, তাতে আপাতত সফল হয়েছি। আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। আরও সপ্তাহখানেক গেলে বুঝতে পারব কতটা সফল হয়েছি আমরা।'

'বড়দের ক্ষেত্রে আমাদের ১০-২০ শতাংশ বেশি ক্রিকেটারকে পরীক্ষা করাতে হবে। যাতে দলটা ভালোভাবে গঠন করা যায়।'
দেবাশীষ চৌধুরী, চিকিৎসক বিসিবি

করোনা পরীক্ষা সফলভাবে উতরে যাওয়ার পর বিকেএসপির বিশাল ইনডোরে ফিটনেস আর দক্ষতার অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটাররা। কাল যুবাদের ব্যাটিং কোচ মেহরাব হোসেন এক ভিডিও বার্তায় বলছিলেন, 'আমাদের এই ক্যাম্পকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমে আমরা স্কিল নিয়ে কাজ করছি। নেটে ৮ দিন সময় পাব। যেখানে ব্যাটসম্যান, বোলাররা নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে।'

করোনাকালে সফলভাবে যুবাদের ক্যাম্প শেষ করাটা বিসিবির জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। এরপর তো আরও বড় পরীক্ষা সামনে। শ্রীলঙ্কা সফরের আগে করোনা পরীক্ষা করা হবে জাতীয় ও এইচপি দল মিলিয়ে ৪৫ ক্রিকেটারের।

যুবাদের সবাই করোনা নেগেটিভ হলেও 'সিনিয়র'রা তা হতে পারবেন কিনা, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে খোদ বিসিবিরই। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটাররা ঘরের বাইরে খুব একটা বের হননি। কিন্তু সিনিয়রদের অনেকের নানা কারণেই বের হতে হয়েছে। দেবাশীষ চৌধুরী তাই বলছেন, 'বড়দের ক্ষেত্রে আমাদের ১০-২০ শতাংশ বেশি ক্রিকেটারকে পরীক্ষা করাতে হবে। যাতে দলটা ভালোভাবে গঠন করা যায়।'