‘করোনা ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’–এ বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট

‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট।’ কাউকে অনুসরণ না করে সম্পূর্ণ নিজেদের ধরনের ক্রিকেট খেলা। যে ক্রিকেটটাকে দেখে মানুষ বলবে, ‘ওই যে দেখ, ওরা বাংলাদেশের মতো খেলছে।’ এখন যেমন কেউ খুব ভালো খেললে অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সঙ্গে তুলনা হয়। তখন তুলনা হবে বাংলাদেশের সঙ্গে। আজ থেকে শুরু ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে অধিনায়কত্বের নবযাত্রায় এটাই তামিম ইকবালের লক্ষ্য। ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’ প্রতিষ্ঠা করা।

তার আগে অন্য একধরনের ক্রিকেটের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশ দলকে। তামিমের কাছ থেকে শব্দ ধার করে সেটাকে বলা যায়, ‘করোনা ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট।’ গত জুলাইয়ে এই ‘ব্র্যান্ডে’র ক্রিকেট প্রথম খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড। ক্রিকেট তো নয়, যেন করোনাকে হার মানানোর খেলা! আপনি ক্রিকেট খেলবেন, খেলাসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মিশবেন। কিন্তু আপনার করোনা হতে পারবে না। অনেকটা সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না জাতীয় ব্যাপার।

ক্রিকেটকে করোনা থেকে নিরাপত্তা দিতে চালু হয়েছে জৈব সুরক্ষাবলয়। যেখানে বাকি দুনিয়া থেকে আলাদা করে ফেলা হয় একটা সিরিজ বা ম্যাচের কোচ-ক্রিকেটার, আম্পায়ার-স্কোরার থেকে শুরু করে খেলাসংশ্লিষ্ট সবাইকে। সবাই একসঙ্গে থাকবেন, খাবেন, মাঠে যাওয়া-আসা করবেন। বাইরের কারও সঙ্গে মিশবেন না। সুরক্ষাবলয়ে ঢোকার আগে সবার করোনা পরীক্ষা হবে, বলয়ে থাকা অবস্থায়ও কয়েক দিন পরপর পরীক্ষা হবে। সেসব পরীক্ষায় নেগেটিভ হলেই কেবল বলয়ে থাকা যাবে। পজিটিভ হলে চলে যেতে হবে সঙ্গনিরোধে। সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হেইডেন ওয়ালশ জুনিয়র যেমন গেছেন।

গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত জৈব সুরক্ষাবলয়ে বিশ্বে যতগুলো সিরিজ হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা ক্রিকেটারদের জন্য তেমন সুখকর নয়। করোনাকে হারাতে যে ‘বন্দিজীবনে’ থাকা, সেটা তাঁদের মনোজগতে চাপ ফেলছে। মাঠে গিয়েও দেখতে হচ্ছে ফাঁকা গ্যালারি। অস্ট্রেলিয়া-ভারত সিরিজে অবশ্য গ্যালারিতে সীমিতসংখ্যক দর্শক ফিরেছে। করোনাকে শুরু থেকেই শক্ত শিকলে বেঁধে ফেলা নিউজিল্যান্ড তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান দুই সিরিজেই দর্শক ঢুকিয়েছে মাঠে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আপাতত সেই ঝুঁকি নিচ্ছে না। আপাতত মাঠে গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ নেই সাধারণ দর্শকদের। বিসিবির বিশেষ আমন্ত্রণে ৩০০-৪০০ অতিথি দর্শকই শুধু সুযোগটা পাবেন।

করোনার কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল দলের অনেক ক্রিকেটারই বাংলাদেশে আসেননি। তাতে জেসন মোহাম্মদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা হয়ে পড়েছে অনভিজ্ঞ। কাগজে-কলমের শক্তিতে বাংলাদেশই এগিয়ে। কিন্তু নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের দর্শন হলো, শক্তিমত্তার তুলনায় না গিয়ে নিজেদের খেলাটা ঠিকঠাক খেলা। কাল সিরিজ–পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই বলেছেন তামিম।

সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে আবারও এসে যাচ্ছে ‘করোনা ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’ প্রসঙ্গ। আন্তর্জাতিক সিরিজে প্রচুর সংবাদ সম্মেলন হয়। এবারও সেসব হচ্ছে, কিন্তু অন্যভাবে। কাল যেমন তামিম ইকবাল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ানডে অধিনায়ক জেসন মোহাম্মদের সংবাদ সম্মেলন হলো জুম ভিডিও কলে। সেখানে জেসন মোহাম্মদ বলেছেন, এই সিরিজে তাঁদের অনুপ্রেরণার নাম ভারত। দুর্বল দল নিয়েও ব্রিসবেন টেস্টে ভারত যে রকম অসাধ্য সাধন করেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ সে রকমই কিছু করে দেখাতে চায়।

শক্তিতে দুর্বল হলেও করোনাকালের ক্রিকেটের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের চেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজই এগিয়ে। জুলাইয়ে ইংল্যান্ড সফরের পর গত মাসে নিউজিল্যান্ডেও দলটা নতুন স্বাভাবিকতায় ক্রিকেট খেলেছে। অন্যদিকে ১০ মাস বিরতি দিয়ে মহামারির সময় এটাই বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ। মাঝে ঘরোয়া দুটি টুর্নামেন্ট খেলে ক্রিকেটারেরা জৈব সুরক্ষাবলয়ের সঙ্গে কিছুটা অভ্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবকিছুই ধরা দেয় ভিন্নভাবে। মাঠে প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেলেও করোনাকালের ক্রিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই হবে তামিমের দলের প্রথম চ্যালেঞ্জ।

তা ছাড়া তারুণ্যনির্ভরতা বাংলাদেশ দলেও আছে। পেস আক্রমণ তো খুবই নবীন। মাশরাফি বিন মুর্তজা নেই। এই সিরিজ দিয়েই প্রথম ওয়ানডে দলে সুযোগ পেয়েছেন দুই পেসার শরিফুল ইসলাম ও হাসান মাহমুদ। স্পিনিং অলরাউন্ডার মেহেদী হাসানেরও এবারই হবে প্রথম ওয়ানডে অভিজ্ঞতা। ২০২৩ বিশ্বকাপ সামনে রেখে কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সেটার বড় এক পরীক্ষাই হয়ে যাবে এই সিরিজে।

দুই দলের সর্বশেষ সাক্ষাৎগুলোর দিকে তাকালে আশাবাদী হওয়াই যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ ৫টি ওয়ানডেতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সর্বশেষ জয়টি আসে ২০১৯ বিশ্বকাপে টন্টনে ৩২২ রান তাড়া করে। সাকিব আল হাসানের অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংস অলংকার হয়ে আছে সেই জয়ে।

সাকিবের সৌভাগ্য, এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজেই সামনে পাচ্ছেন সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ‘করোনা ব্র্যান্ড অব ক্রিকেটে’র প্রথম পরীক্ষা এবং অধিনায়ক তামিমের ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেটে’র দিকে যাত্রাটা কি তবে সাকিবের তুলিতেই রাঙাবে বাংলাদেশ!