কাল সামনে থাকতে হবে সাকিবকেই

টেস্টের মেজাজে আজ ব্যাট করেছেন সাকিব আল হাসানছবি: শামসুল হক

প্রথম সেশন শেষে ২ উইকেটে ৬৯। মধ্যাহ্নভোজটা পুরো স্বস্তি নিয়ে কি করা গেছে? চা-বিরতির আগে দ্বিতীয় সেশনেও পড়েছে ২ উইকেট। রান উঠেছে ৭১। চায়ের স্বাদ কি ঠিকঠাক লেগেছে?

আহামরি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন নয়। মাথাকুটে মরার দরকার নেই। বছরখানেক পর ধৈর্যের (টেস্ট) পরীক্ষায় নেমেছে বাংলাদেশ। মানিয়ে নেওয়ারও তো একটা বিষয় থাকে।

সে বিচারে প্রথম দুই সেশনে এমন রানের বিপরীতে ‍২টি করে উইকেট হারানো মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শেষ সেশনে গিয়ে পাল্টেছে দৃশ্য। শুধু মুশফিকুর রহিমের উইকেট হারিয়ে উঠেছে ১০২ রান।

চট্টগ্রাম টেস্টে আজ প্রথম দিনের খেলা শেষে তাই জলখাবারই সবচেয়ে ভালো লাগার কথা বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের। আর হ্যাঁ, সাকিব আল হাসানের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার কথা তামিম ইকবালদের।

নিষেধাজ্ঞা শেষে এ ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেটের কুলীন সংস্করণে ফিরলেন সাকিব। এর আগে ওয়ানডে সিরিজ খেললেও টেস্টের প্রস্তুতি ও ধরনটা তো আলাদা। সাকিব বড় মাপের ক্রিকেটার বলেই প্রথম দিন শেষে অস্বস্তিতে ভুগতে দেননি বাংলাদেশকে। লিটন দাস থাকলেও কাল তিনিই মূল ভরসা।

চা-বিরতির খানিক আগে ব্যাটিংয়ে নামেন সাকিব। শেষ সেশনে বাংলাদেশের শতরান ও মাত্র ১ উইকেট হারানোর পেছনে তাঁর ভূমিকাই বেশি। তাঁর ৯২ বলে অপরাজিত ৩৯ রানের ইনিংসটির সবচেয়ে বড় অবদান হলো, পুরো টেস্ট মেজাজের ব্যাটিংয়ে ধরে রেখেছিলেন এক প্রান্ত।

শেষ সেশনের শেষ আধঘণ্টায় সাকিবকে লোভ দেখান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা। লেগে বাউন্ডারিতে ফিল্ডার রেখে বাউন্সার মেরে গেছেন শ্যানন গ্যাব্রিয়েল। সাকিব একবার হুক করলেও সেটা বাতাসে ভাসেনি।

রাকিম কর্নওয়াল ও ওয়ারিক্যানরা বাঁক পেলেও তা দেখেশুনে দেরিতে খেলেছেন সাকিব। এ ক্ষেত্রে মুশফিকুর রহিমের আউট মনে পড়তে পারে। ওয়াক্যানের বলটি আগেভাগে সামনে পা না নিয়ে দেরিতে খেললে হয়তো দিন শেষে সাকিবের সঙ্গে মুশফিকও অপরাজিত থাকতেন।

জোর করে কোনো শট খেলেননি সাকিব। চট্টগ্রাম টেস্টে আজ তাঁর সুইপ করার একটি মুহূর্ত
ছবি: শামসুল হক

কিন্তু স্পিনে দেশের সেরা ব্যাটসম্যানের চেয়েও আজ স্পিনবান্ধব উইকেটে স্পিনারদের ভালো খেলেছেন সাকিব। একেবারে বাজে বল ছাড়া বেশির ভাগ ডেলিভারি ‘সফট হ্যান্ড’-এ খেলায় বল তাঁর ব্যাটে লেগে পড়ছে উইকেটেই। সামনে ফিল্ডার রেখেও তাই লাভ হয়নি ক্যারিবীয় স্পিনারদের।

সাকিবের শটে তাঁর এমন নিয়ন্ত্রণ চলে আসার পেছনে ‘বিকেএসপিতে প্রায় এক মাসের নিবিড় অনুশীলন কাজে দিয়েছে’ বলছিলেন টিভি ধারাভাষ্যকার। খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার আতহার আলী তো শেষ আধঘণ্টায় ভূয়সী প্রশংসা করলেন সাকিবের।

‘পাথরের মতো জমাট ব্যাটিং’—কথাটা বেশ কয়েকবার ফুটেছে তাঁর মুখে। আসলে সাকিব যে ভালো করার ক্ষুধা নিয়েই নেমেছেন, তা বোঝা গেছে তাঁর শরীরী ভাষাতেই।

পঞ্চম উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে ১০৮ বলে ৫৯ রানের জুটি গড়েন সাকিব। শেষ সেশনে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে এ জুটির পাশাপাশি ভূমিকা রেখেছে লিটনের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছিন্ন ৪৯ রানের জুটি।

এ দুটি জুটিতেই অনেক সময় অপর প্রান্তে গিয়ে সতীর্থের সঙ্গে কথা বলেছেন সাকিব। স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো ছিল ব্যাটিং নিয়ে এবং তাঁর এই মনোযোগের পুরস্কারই প্রথম দিনের খেলা শেষে টেস্টে এগিয়ে থাকার নিক্তিতে দুই দলের প্রায় সমান অবস্থান। ৫ উইকেটে ২৪২ রানে প্রথম দিনের খেলা শেষ করেছে বাংলাদেশ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫ উইকেট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু উইকেটে আছেন সাকিব ও লিটন। প্রথম দিনেই উইকেটের চরিত্র দুজনের বুঝে ফেলার কথা। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ২২ গজ তাঁদের হাতের তালুর মতো চেনা।

দিনের খেলা শেষে অপরাজিত সাকিব-লিটন
ছবি: শামসুল হক

৫৮ বলে ৩৪ রানে অপরাজিত লিটনকে অনেকবারই কাছে গিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে সাকিবকে। স্ট্রোক খেলার বল পেলে পারতপক্ষে না ছাড়া এবং বাতাসে খেলতে সিদ্ধহস্ত লিটনকে আজ বেশির ভাগ সময় ‘নিরাপদ’ শট খেলতে দেখা গেছে, সেটা কি সাকিবের কথা শুনে?

তা না হলেও অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার, সাকিব-লিটন আজ যেভাবে ব্যাট করেছেন, তাতে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম হওয়ার কথা নয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্রেগ ব্রাফেটের। কালও দুজনের ব্যাটিং একই রকম থাকলে নিজেদের প্রথম ইনিংসেই যে ভীষণ চাপ পড়বে!

সাকিব-মুশফিকের জুটি দিন শেষ করতে পারলে সমর্থকদের হয়তো আরও ভালো লাগত। ঠান্ডা মাথায় দারুণ খেলছিলেন দুজন। মুশফিক স্লিপে ক্যাচ দেওয়ায় ভেঙে যায় তাঁদের জুটি।

ততক্ষণে অবশ্য নিজেদের একটি রেকর্ডের সঙ্গে বাকিদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন সাকিব-মুশফিক। টেস্টে পঞ্চম থেকে তাঁর নিচে সর্বোচ্চসংখ্যকবার পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়ার রেকর্ড তাঁদের।

টেস্টে আজ নিজেদের ২০তম ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়েছেন দুজন। ১৬ ইনিংস পর্যন্ত তা গড়ে দুইয়ে মিসবাহ-উল-হক ও আসাদ শফিকের জুটি। স্টিভ ওয়াহ ও রিকি পন্টিং ১২ ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়ে তিনে।

মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ব্যাটিং জমে ওঠে সাকিবের। আজও পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়েন দুজন
ছবি: শামসুল হক

তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটিকে শতরানে রূপান্তরিত করায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান থেকে পিছিয়ে সাকিব-মুশফিক। ১৬ বার পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়ার পাশাপাশি তাঁরা সেটি শতরানে রূপ দিতে পেরেছেন মাত্র ৪ বার।

আসাদ শফিক-মিসবাহদের জুটি থেকে এসেছে ৭টি শতরানের জুটি, পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি ৯টি। ওয়াহ-পন্টিংয়ের জুটিতে আবার তা সমান ভাগে করা, ৬ বার করে ন্যূনতম শতরান ও পঞ্চাশ রান।

মুশফিক আজ দিনের শেষ পর্যন্ত থাকলে আরও একটি শতরানের জুটি হয়ে যেত। তা না হলেও অন্য প্রান্তে আশা হয়ে আছেন লিটন।

দিনের খেলা শেষে ওপেনার সাদমান ইসলামের ভাষায়, ‘সাকিব ও লিটন ভালো ব্যাট করেছে।’ সে তো বটেই। কিন্তু কাল যে আরও বড় দায়িত্ব সেটাও ভুলে গেলে চলবে না, আর তাতে নেতৃত্ব দিতে হবে সাকিবকে।