কিপটেমিতে সাকিব, ছক্কায়ও সাকিব
৪৫ বলে ৫২ রান। বিপিএলের স্বাভাবিক নিক্তিতে মন্দ নয়। তবে দলের রান ১৯৯ রান, এ তথ্য ইনিংস নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। ব্যাটসম্যানের নাম ক্রিস গেইল—শুনলে বিস্ময়ই জাগে। সিলেট সানরাইজার্সের বিপক্ষে ফরচুন বরিশালের সর্বশেষ ম্যাচে মনে হচ্ছিল, এ কোন গেইল! ভুলে গেলে চলবে না, ক্রিস্টেফার হেনরি গেইল বিয়াল্লিশ পার করে তেতাল্লিশ বছরে পা দিয়েছেন। বয়স বেড়ে চলার সঙ্গে তাঁর রিফ্লেক্স এবং বল দেখার ক্ষমতা কমাই স্বাভাবিক। এ বছর আইপিএলের নিলাম থেকেও সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।
একদিক থেকে সেদিন মুনিম শাহরিয়ারের ৫০ এবং সাকিব আল হাসানের ১৯ বলে ৩৮ রানের ঝোড়ো ইনিংসের চেয়েও গেইলের ইনিংসটি একদিক থেকে অনেক মূল্যবান। গেইল এক প্রান্তে থাকায় অন্য প্রান্ত থেকে হাত খুলে খেলার সাহস পেয়েছেন বাকিরা। গেইল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ তুলনামূলক মন্থর ইনিংসেও ২টি ছক্কা ও ৪টি চার মেরেছেন। সতীর্থরাও তাতে যোগ দেওয়ায় রানটা ২০০ ছুঁই ছুঁই হয়।
গেইলের উদাহরণ দেওয়ার কারণটা একটু গভীর—টি-টোয়েন্টিতে কোনো দলের ইনিংসে শুধু ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের তাৎপর্যই বেশি হয় না, কখনো কখনো পরিস্থিতি বুঝে মন্থর ইনিংসও পার্থক্য গড়ে দেয়। এর একটা গালভারি নামও আছে, অ্যাঙ্করিং। একজন ইনিংসের নোঙর ফেলেন, অন্যরা সামাল দেন ঝড়ঝাপটা। তবে এই মন্থর ইনিংস কখনো দলের জন্য ইতিবাচক, কখনো আবার এই ইনিংসই ‘একটুর জন্য’ আক্ষেপের জন্ম দেয়।
তাই ম্যাচ পরিস্থিতি না দেখে যেমন ব্যাটিংয়ের বিচার করা কঠিন, তেমনি এখন পর্যন্ত বিপিএলের সেরা কারা, সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে বলাটা ভুল। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্ব শেষে শীর্ষ পাঁচে থাকা খেলোয়াড়েরাই যে সব ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন, তা বললে সঠিক হবে না।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলামের কথাই ধরুন। ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে শীর্ষ পাঁচে উঠে এসেছেন বরিশাল বিভাগের হয়ে খেলা ২৫ বছর বয়সী। মেহেদী হাসান মিরাজ, নাসুম আহমেদ কিংবা ইবাদত হোসেনদের মতো জাতীয় দলের বোলাররা তাঁর বেশ পেছনে। এমনকি মিনিস্টার ঢাকার ক্যারিবিয়ান তারকা অলরাউন্ডার আন্দ্রে রাসেলও তানভীরের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তানভীরের ৬.৮৪ ইকোনমি রেটও এই তালিকায় নাজমুল ইসলাম (৭.১৫) ও ডোয়াইন ব্রাভোর (৮.৬৬) চেয়ে শ্রেয়তর।
জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়া স্পিনার নাজমুল ইসলাম এবার বিপিএলে ভালো করছেন। উইকেট নেওয়ার তালিকায় চারে থাকলেও শীর্ষ পাঁচে নাজমুল একটি জায়গায় সবার ওপরে—স্ট্রাইকরেট। প্রতি ৯.৪ বল পর সিলেট সানরাইজার্সকে একটি করে উইকেট এনে দিয়েছেন নাজমুল (১৭.২ ওভার)।
তাঁর চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলা মোস্তাফিজুর রহমান ১৫ উইকেট নিয়ে শীর্ষে, কিন্তু স্ট্রাইকরেটে দুইয়ে—প্রতি ১০.২ বল পর কুমিল্লাকে উইকেট এনে দিয়েছেন বাঁহাতি পেসার। তবে শীর্ষ পাঁচে কিপটেমিতে (৪.৯২) সবার চেয়ে ভালো অবস্থানে সাকিব (১৪ উইকেট)। ৭ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে তিনে ব্রাভো। শীর্ষ পাঁচ বোলারদের মধ্যে ব্রাভোর ওভারপ্রতি রান দেওয়ার হারই (৮.৬৬) সবচেয়ে বেশি।
তিন স্পিনার ও দুই পেসার মিলে বোলারদের শীর্ষ পাঁচ। তবে শীর্ষ দশে পেসারসংখ্যা বেশি। ছয় পেসার ও চার স্পিনার জায়গা করে নিয়েছেন বোলারদের শীর্ষ দশে। এই দশজনের মধ্যেও সাকিব ওভারপ্রতি রান দেওয়ায় সবচেয়ে কিপটে। কামরুল ইসলাম ঠিক তাঁর উল্টো অবস্থানে। ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে সাতে থাকা এই পেসার ১০.৫৪ ইকোনমি রেট নিয়ে রান দেওয়ায় সবচেয়ে উদারহস্ত। তবে শীর্ষ দশে স্ট্রাইকরেটে নাজমুলকেও পেছনে ফেলেছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের পেসার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ দলের এই পেসার ৫ ম্যাচে ১০ উইকেটের প্রতিটিতে ৮.৭ বল খরচ করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়—বাংলাদেশের এমন তিন উইকেটের চরিত্র তিন ধরনের। ঢাকার উইকেট এমনিতে স্পিনবান্ধব, চট্টগ্রাম ব্যাটিংবান্ধব এবং সিলেটের উইকেট কিছুটা পেসবান্ধব। তবে এবার তিন ভেন্যুতে বল বেশ নিচু হয়েছে। স্পিন কিংবা পেসে হুট করে বলের নেমে যাওয়া সামাল দিতে হয়েছে ব্যাটসম্যানদের। কাজটা একটু কঠিন হলেও ব্যাটসম্যানরা সামলে নিয়েছেন। তবে সেটা রান তোলার গতিতে প্রভাব ফেলেছে। শীর্ষ পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে স্ট্রাইকরেটে দেশিদের লক্ষণীয় কোনো উন্নতি হয়নি। তামিম ইকবালই শুধু ব্যতিক্রম।
১৩২.৬৮ স্ট্রাইকরেটে একটি শতকসহ ৮ ইনিংসে ৩৪১ রান নিয়ে বিপিএলে এ পর্যন্ত শীর্ষে মিনিস্টার ঢাকার ওপেনার। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তামিমের স্ট্রাইকরেট ১১৬.৯৬ এবং ঘরোয়ায় ১১৯.৫২। এবার অন্তত ক্যারিয়ারের চেয়ে বেশি স্ট্রাইকরেটে রান তুলছেন তামিম। সব সময় স্কুপ কিংবা পেশিশক্তির ওপর নির্ভর না করে সোজা ব্যাট, কবজি এবং পায়ের কাজের ওপর নির্ভর করেও যে দ্রুত রান তোলা যায়, সেটাই দেখাচ্ছেন তামিম।
শীর্ষ দশে তাঁর চেয়ে (১২ ছক্কা) বেশি ছক্কা মেরেছেন সাকিব (১৩) ও উইল জ্যাকস (১৪)। তামিমের (৩৯) চেয়ে বেশি চার আর কেউ মারতে পারেননি। অর্থাৎ শুধু তুলে মারা নয়, নিচে খেলেও দ্রুত রান তোলার মুনশিয়ানা দেখাচ্ছেন তামিম।
শীর্ষ পাঁচে তিনজন দেশি এবং তিনজন বিদেশি। দুই ও তিনে আছেন যথাক্রমে সিলেটের কিউই ব্যাটসম্যান কলিন ইনগ্রাম ও চট্টগ্রামের ইংলিশ ওপেনার উইল জ্যাকস। জ্যাকসের স্ট্রাইকরেটই (১৫২.২৩) শীর্ষ পাঁচের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এরপর ইনগ্রাম (১৩৮.৫৬)। চার মারায় শীর্ষ পাঁচে তামিমের পরই ইনগ্রাম (৩৫) ও জ্যাকস (৩৩)। চারে মাহমুদউল্লাহ ও পাঁচে এনামুল। ৪২.০০ গড়ে ২৫২ রান তোলা মাহমুদউল্লাহর ১২৩.৫২ স্ট্রাইকরেটের ব্যাখ্যা পাওয়া অবশ্য কঠিন।
৮ ম্যাচে ৩১.০০ গড়ে ২৪৮ রান তুলে পাঁচে উঠে আসা এনামুলের স্ট্রাইকরেটও ভ্রুকুটি জাগাবে। জাতীয় দল থেকে বেশ আগেই ছিটকে পড়া এনামুল ব্যাট করেন টপ অর্ডারে। অর্থাৎ পাওয়ার প্লে ব্যবহার করে হাত খুলে খেলার সুযোগ থাকে। এরপরও তাঁর ১২১.৫৬ স্ট্রাইকরেট কিছুটা অবাক করাই। সম্ভবত রানে এবং পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরতেই ব্যাটিংয়ে নেমে কিছুটা সময় নিচ্ছেন এনামুল।
ব্যাটসম্যানদের শীর্ষ দশে ৬-৪ ব্যবধানে এগিয়ে দেশি খেলোয়াড়েরা। ছয়জন দেশি এবং চারজন বিদেশি। শীর্ষ দশে দেশিদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের স্ট্রাইকরেটই সবচেয়ে বেশি (১৪১.৫০)। ৮ ম্যাচে ২২৫ রানে ছয়ে থাকা সাকিবের গড় ২৮.১২ একটু কম। যদিও টি-টোয়েন্টিতে ১৪০–এর ওপরে স্ট্রাইকরেটে এই গড়ও মন্দ নয়।
আটে আফিফ হোসেন এবং নয়ে মুশফিকুর রহিম। মুশফিক বিপিএলের শুরুতে রানখরায় ভুগলেও পরে ধীরে ধীরে চওড়া হয়ে উঠছে তাঁর ব্যাট। ৯ ম্যাচে ২১২ রান তোলা আফিফের স্ট্রাইকরেট (১১৮.৪৩) বেশ হতাশাজনক। ৮ ম্যাচে ২০৮ রান নিয়ে নয়ে থাকা মুশফিকের স্ট্রাইকরেট ১২৯.১৯। শীর্ষ দশে সবার নিচে থাকা বেনি হাওয়েলের স্ট্রাইকরেট সবচেয়ে বেশি—১৫৯.৩২।