কোহলিকে ভারতের খেলোয়াড়েরাই ভয় পান

কোহলির আগ্রাসী ধরন তাঁর অধিনায়কত্বে প্রভাব ফেলবে?ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ায় ঐতিহাসিক জয়টা যে ভারতের ক্রিকেটকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, এ নিয়ে দ্বিমত করার মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিন্তু পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ভারতের সিরিজটা জেতা কি বিরাট কোহলির জন্য কিছুটা ক্ষতিও করে দিয়ে গেছে?

ইতিউতি আলোচনা আর ফিসফাস শুনে তেমন মনে হতেই পারে! অজিঙ্কা রাহানের অধীনে শেষ তিন টেস্টে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিরিজটা জিতেছে ভারত, এরপর থেকে অনেকেই বলছেন, কোহলি নয়, রাহানেকেই পাকাপাকিভাবে ভারতের টেস্ট দলের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া উচিত। সিরিজের পর থেকে রাহানের প্রশংসা তো চলছেই, কোহলি আর রাহানের নেতৃত্বের ধরনের পার্থক্য নিয়েও আলোচনা হচ্ছে অনেক।

এর মধ্যে আলোচনাটা যেন আরেকটু জাগিয়ে দিতে চাইছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অলরাউন্ডার শেন লি। কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ব্রেট লির বড় ভাইয়ের চোখে, ভারতের ক্রিকেটাররাই নাকি কোহলিকে ভয় পান! কোহলির অধিনায়কত্বে তাঁরা ভয়ে ভয়ে খেলেন। তুলনায় রাহানের অধীনে অনেক নির্ভার হয়ে খেলতে পারেন ভারতীয়রা, এমনটাই মনে হচ্ছে শেন লির।

অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে ৪৫টি ওয়ানডে খেলা শেন লি পাশাপাশি এ-ও জানিয়েছেন, তিনি ভারতীয় দলের নির্বাচক হলে কোহলিকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে শুধু ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে বলতেন!

রাহানের অধিনায়কত্ব মুগ্ধ করেছে অনেককে।
ছবি: এএফপি

একদিক থেকে দেখলে ভারতের টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক এই তর্কটা যথাযথই! অ্যাডিলেডে সিরিজের প্রথম টেস্টে কোহলির অধীনে যেখানে লজ্জার হার জুটেছিল ভারতের কপালে, দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয়েছিল নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে সর্বনিম্ন ৩৬ রানে; সেখানে পরের তিন টেস্টে রাহানের অধীনে কী দারুণ লড়া-ই না করল ভারত!

প্রথম সন্তান জন্মের সময়ে বলিউড অভিনেত্রী স্ত্রী আনুশকা শর্মার পাশে থাকতে সিরিজের প্রথম টেস্টের পরই অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে ভারতে ফিরে আসবেন কোহলি, পরের তিন টেস্টে দলের নেতৃত্ব দেবেন রাহানে—সেটা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। যা ঠিক করা ছিল না, ঠিক করা সম্ভবও হতো না—সেটি হলো, দলকে কোন অবস্থায় রেখে যাবেন কোহলি! অধিনায়ক ভারতকে রেখে গেছেন খুবই নাজুক অবস্থায়। সিরিজের মাঝপথে কোহলির দল ছেড়ে ভারতে ফেরা নিয়ে তো ভারতের সাবেক অনেক ক্রিকেটার শুরু থেকেই সমালোচনায় মুখর ছিলেন, প্রথম টেস্টের ওই ‘৩৬’ লজ্জার পর কোহলির দল ছেড়ে আসায় সমালোচনা আরও বেড়েছে।

কিন্তু সেখান থেকে রাহানের ঠান্ডা মাথার নেতৃত্বে দ্বিতীয় টেস্টে জিতে সিরিজে সমতা ফিরিয়েছে ভারত, সে টেস্টে রাহানে নিজেই অনবদ্য সেঞ্চুরি করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরপর সিডনিতে তৃতীয় টেস্টে চেতেশ্বর পূজারা-হনুমা বিহারির দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে এল ড্র, আর অনেক বিতর্কের পর শুরু হওয়া ব্রিসবেন টেস্টে ভারত গড়ল ইতিহাস। শেষ দিনের তিন ওভার বাকি থাকার সময়ে শেষ হওয়া ম্যাচে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে জিতল, টানা দ্বিতীয়বারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়ও হলো। পাশাপাশি ব্রিসবেনে ১৯৮৮ সালের পর অস্ট্রেলিয়ার অজেয় থাকার রেকর্ডও গুঁড়িয়ে দিয়ে এল রাহানের দল!

কোহলি না থাকলেও রাহানের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ জিতেছে ভারত।
ছবি: এএফপি

এরপর রাহানের পাকাপাকিভাবে ভারতের টেস্ট দলের নেতৃত্ব পাওয়ার আলোচনা ওঠাই স্বাভাবিক। অবশ্য কোহলির পক্ষেও এ ক্ষেত্রে কথা বলবে রেকর্ড। মহেন্দ্র সিং ধোনির কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত কোহলির অধীনে ৫৬ টেস্টের ৩৩টি জিতেছে ভারত, ধোনিকেই (২৭ জয়) টপকে কোহলি হয়ে গেছেন ভারতের টেস্ট ইতিহাসে সফলতম অধিনায়ক!

কিন্তু শেন লির কাছে এসব রেকর্ড-টেকর্ড পাত্তা পাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান সাবেক অলরাউন্ডার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোহলি আর রাহানের অধীনে টেস্টে দুই ভিন্ন ভারতকে দেখেই তাঁর রায় দিয়েছেন। কোহলির কাছ থেকে রাহানের অধিনায়কত্ব পাওয়া উচিত কি না—প্রশ্নে শেন লির উত্তর, ‘দেখুন, আমি মনে করি (ভারতীয়) দলের জন্য সেটা ভালো হবে। আমি ওকেই অধিনায়ক রাখতে চাইব। কোহলি সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় দলের ভেতরেই খেলোয়াড়েরা ওকে একটু বেশিই সম্মান দেখায়। দেখে মনে হয়, সীমার বাইরে এক পা পড়ে গেলেও ওরা ওকে (কোহলি) ভয় পায়।’

কোহলির অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষাই কোহলিকে ঘিরে ভারতের ক্রিকেটারদের এই ভয়ের কারণ বলে মনে হচ্ছে শেন লি-র, ‘ভারতীয় দলের কাছ থেকে ও একেবারে নিখুঁত পেশাদারি চায়। খেলোয়াড়দের চূড়ান্ত ফিট হতে হবে, মাঠে ফিল্ডিংয়ে, ক্যাচ ধরায় দুর্দান্ত হতে হবে...সবই ঠিক আছে, কিন্তু ওদের দেখে মনে হয় ওরা কোহলির ভয়ে থাকে। রাহানের অধীনে আমি নির্ভার একটা দলকেই দেখেছি।’

রাহানের অধীনে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা নির্ভার থাকেন বলেই মনে হচ্ছে অনেকের।
ছবি: এএফপি

তিনি ভারতীয় দলের নির্বাচক হলে রাহানেই অধিনায়ক থাকতেন বলে জানিয়েছেন শেন লি, ‘কোহলি কি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবে? আমার তা মনে হয় না। কিন্তু আমি যদি ভারতীয় দলের নির্বাচক হতাম, আমি নির্বাচক নই আমি জানি, যদি হতাম আর কি; আমি রাহানেকে দলের অধিনায়ক করতাম। আর কোহলিকে স্বাধীন করে দিতাম যাতে ও ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে পারে। আমার মনে হয় এমন হলে দলও আরও ভালো খেলত।’

দুদিন আগে ভারতের বোলিং কোচ ভরত অরুণও কোহলি আর রাহানের অধিনায়কত্বের পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে ভারতের ক্রিকেটারদের ভয়ের কথা বলেছেন। ভারতের অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ইউটিউব চ্যানেলে ভরত অরুণ বলেছেন, ‘অজিঙ্কার ক্ষেত্রে বলব ও অনেক শান্ত স্বভাবের। খেলোয়াড়দের সাহস দিয়ে যায়। একজন বোলার ভুল করলেও সে হয়তো অধিনায়কের ভয়ে থাকবে না। জানবে ওর ওপর অধিনায়কের ভরসা আছে।’

কিন্তু কোহলির ক্ষেত্রে কী হয়? ভরত অরুণ জানিয়েছেন, ‘বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে আপনি যদি দুটি বল খারাপ করেন, দেখে মনে হবে ও রেগে গেছে। কিন্তু আসলে ওর ভেতরের খেলোয়াড়ি তেজটাই এমন।’

কোহলির আগ্রাসী, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাবটাই কি শেষ পর্যন্ত তাঁর অধিনায়কত্বের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে?