ক্রাইস্টচার্চে নতুন গল্প লিখবেন মাশরাফি-মিরাজরা?

সংবাদ সম্মেলনে আত্মবিশ্বাসী মেহেদী হাসান মিরাজ। ছবি: লেখক
সংবাদ সম্মেলনে আত্মবিশ্বাসী মেহেদী হাসান মিরাজ। ছবি: লেখক
>

ক্রাইস্টচার্চে কাল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। সিরিজ বাঁচানোর এই ম্যাচটিতে বাংলাদেশ কী নতুন কোনো ইতিহাস রচনা করবে? নাকি অতীতের নিউজিল্যান্ড সফর গুলির মতো দ্বিতীয় ম্যাচেই নিউজিল্যান্ড জিতে নেবে সিরিজ?


দুজনের নামের আদ্যক্ষর একই। এর বাইরে মাশরাফি বিন মুর্তজা আর মেহেদী হাসান মিরাজের কোনো মিল নেই। একজন পেস বোলার, আরেকজন অফ স্পিনার। একজন ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অংশ হয়ে থাকার পর এখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। আরেকজনের সোয়া দুই বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, সামনে পড়ে আছে আরও অনেক দিন।
এত সব অমিলের মধ্যেও চাইলে দুজনের মধ্যে বড় একটা মিল ঠিকই খুঁজে পাওয়া যায়। সেই মিল ইতিবাচকতায়। সাকিব আল হাসানের চোখে মাশরাফির সবচেয়ে বড় গুণ, যেকোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচ জেতা সম্ভব বলে মনে করার আশ্চর্য মানসিকতা। এদিক থেকে মাশরাফির আদর্শ শিষ্য বলতে পারেন মিরাজকে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং—সবকিছুতেই একটা চনমনে ব্যাপার আছে মিরাজের মধ্যে। আছে ‘একটা কিছু করবই’ প্রতিজ্ঞাও। মাঠের বাইরেও একই রকম সপ্রতিভ। সারল্য আছে, কখনো কখনো ছেলেমানুষীও, সবকিছু ছাপিয়ে ইতিবাচকতা। এর সবকিছুই ফুটে বেরোল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে।
নেপিয়ারে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ বিনা প্রতিরোধেই আত্মসমর্পণ করেছে—কোনো ব্যাপার নয়, এটা এখন অতীত। সামনে নতুন দিন, নতুন ম্যাচ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১টি ওয়ানডে খেলে সব কটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ, তাতে কী? সেটি তো আরও দূর অতীত। বাকি দুই ম্যাচে জিতে এখনো সিরিজ জেতা সম্ভব। তা তো সম্ভবই। কাগজে-কলমের এই হিসাব কে না জানে! মিরাজের আশাবাদের ভিত্তি শুধু এটিই নয়। গত কিছুদিন বাংলাদেশের পারফরম্যান্স এবং একই রকম পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস মনে রেখেই মিরাজ বলছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এই সিরিজটা জেতা সম্ভব। বাকি দুইটা ম্যাচ জিততে হবে। কালকের ম্যাচটা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাল যদি আমরা জিততে পারি, তাহলে পরের ম্যাচটায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামতে পারব। ’
বাংলাদেশের অন্য সব সিরিজের তুলনায় এই সিরিজে দেশ থেকে আসা সাংবাদিকের সংখ্যা বিস্ময়কর রকম কম—মাত্র পাঁচজন। নিউজিল্যান্ডে অবশ্য এটাই সংখ্যাগুরু হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। কাল দুপুরে হ্যাগলি ওভাল মাঠে সংবাদ সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি যে মাত্র একজন। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলায় প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে প্রবীণ কিউই সাংবাদিকের দুই/তিনটি প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দিয়ে নিলেন মিরাজ। ভাষা বদলাল, কিন্তু আশাবাদ বলুন বা আত্মবিশ্বাস সেখানে কোনো পরিবর্তন নেই। যা শুনে নিউজিল্যান্ডের ওই সাংবাদিক একটু চমকে গেছেন বলেই মনে হলো। যাঁর সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করেই মিরাজের মুখে পরিচিত সেই সারল্যের হাসি, ‘কেমন করলাম, বলুন তো?’ হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত করে বললেন, ‘বাবা রে, ইংরেজিতে কথা বলা!’
একটু আগে টিম মিটিং সেরে এসেছেন। সেখানে মূল আলোচনাটা যে বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম ১০ ওভার নিয়েই হয়েছে, মিরাজের কথা শুনে সেটি বুঝতে কোনো সমস্যাই হলো না। আগের দিন প্রথম আলোকে বলা তামিমের কথাটাই যেন প্রতিধ্বনিত হলো তাঁর কণ্ঠে, ‘প্রথম ম্যাচে প্রথম ১০ ওভারেই ৪টা উইকেট পড়ে গেছে। আমরা এ নিয়ে কথা বলেছি। প্রথম ১০ ওভারে রান যদি অল্পও হয়, কোনো সমস্যা নেই। আমাদের টপ অর্ডার প্রথম ১০টা ওভার খেলে দিতে পারলে আমাদের ভালো সুযোগ থাকবে।’
নিউজিল্যান্ডের নতুন বলের দুই বোলার ট্রেন্ট বোল্ট আর ম্যাট হেনরির প্রথম স্পেল দুটি পার করে দেওয়াটাকেই দ্বিতীয় ম্যাচে নামার আগে মন্ত্রের মতো জপ করছে বাংলাদেশ দল। যেটি আরও ভালোভাবে বোঝা গেল, প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের ধারহীন বোলিংয়ের প্রসঙ্গেও যখন মিরাজ আবারও ব্যাটিংয়ের কথা বলতে শুরু করলেন, ‘প্রথম ১০ ওভারের পাওয়ার প্লেটাই আসল। গত ম্যাচে দেখেন, উইকেট পড়ার পরও রান কিন্তু ঠিকই হয়ে যাচ্ছিল।’ বোলিংয়ের কথা এল এরপর, ‘একটা বড় রান দরকার। ব্যাটসম্যানরা বড় স্কোর দিতে পারলে বোলারদের কাজটা একটু সহজ হয়। তখন আমরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বোলিং করতে পারব।’

ক্রাইস্টচার্চে দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে ফুরফুরে বাংলাদেশ দল। অনুশীলনের সময় খুনসুটি করতে দেখা গেল রুবেল হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজকে। কালকের ম্যাচে রুবেল খেলবেন কিনা, সেটি নিয়ে আলোচনা কিন্তু আছেই। ছবি: লেখক
ক্রাইস্টচার্চে দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে ফুরফুরে বাংলাদেশ দল। অনুশীলনের সময় খুনসুটি করতে দেখা গেল রুবেল হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজকে। কালকের ম্যাচে রুবেল খেলবেন কিনা, সেটি নিয়ে আলোচনা কিন্তু আছেই। ছবি: লেখক

পুরো কথাবার্তার সুরটাই এমন যেন প্রথম ম্যাচের মতো দ্বিতীয়টিতেও বাংলাদেশই প্রথমে ব্যাটিং করবে! যদি তা না করে! যদি নিউজিল্যান্ড আগে ব্যাটিং করে তিন শ-সাড়ে তিন শ রান করে ফেলে! এর আগে এই মাঠে দুই দেশের একমাত্র ওয়ানডেটিতে তা-ই হয়েছিল। ২০১৬ সালের বক্সিং ডের সেই ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করেই ম্যাচ একরকম শেষ করে দিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। টম ল্যাথামের সেঞ্চুরিতে ৭ উইকেটে ৩৪১ রান হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ইনিংস শুরুর আগেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল, জয় নয়, এটি হতে যাচ্ছে পরাজয়ের ব্যবধান যতটা সম্ভব কমানোর লড়াই। ৪৪.৫ ওভারেই অলআউট হয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ করতে পেরেছিল ২৬৪ রান। হ্যাগলি ওভালের বাদামি রঙের উইকেট দেখে মনে হচ্ছে, এবারও সেটি রানে ভরা। টস জিতলে চোখ বুঁজে ব্যাটিং নেবে নিউজিল্যান্ড। সুযোগ পেলে বাংলাদেশেরও তা-ই নেওয়ার কথা। তা সকাল ১১টায় খেলা শুরু বলে যতই বোল্ট আর হেনরির বাড়তি সুইং পাওয়ার ভয় থাকুক না কেন।
আগে বোলিং করতে হোক বা পরে, নিউজল্যান্ডে নিজের ভূমিকা সম্পর্কেও খুব পরিষ্কার মিরাজ। দেশে খেলা হলে যেমন উইকেটের জন্য ঝাঁপান, নিউজিল্যান্ডে তাঁর মূল কাজ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে রান আটকানো। তাতে অন্য প্রান্ত থেকে পেসারদের উইকেট পাওয়ার সুযোগটা বাড়বে। দেশে স্পিনার যে কাজটা করে, এখানে তা করতে হবে পেসারদের। বাংলাদেশ দলে কোনো পরিবর্তন হলে সেটি পেস ডিপার্টমেন্টেই হবে। প্রথম ওয়ানডেতে বোলিংয়ে তেমন কিছু করতে না পারলেও ব্যাটিংয়ে ৪১ রানের মান বাঁচানো ইনিংস খেলেছেন সাইফউদ্দিন। সেই বিবেচনায় তাঁর টিকে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সামান্য চোট আছে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা একটু ঝুলে আছে। ঝুলে আছে বিপিএলে দারুণ বোলিং করেও প্রথম ম্যাচে সুযোগ না পাওয়া রুবেল হোসেনের ভাগ্যও। সাইফউদ্দিন না রুবেল—ম্যাচের আগের রাতে একাদশ নির্বাচনে প্রশ্ন ছিল এই একটাই। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অবশ্যই এটা নয়। সেটি হলো, নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের আগের সব সিরিজের মতো দ্বিতীয় ম্যাচেই কি সিরিজের মীমাংসা হয়ে যাবে, নাকি বাংলাদেশ লিখবে নতুন গল্প?