ক্রিকেট–কর্তারা টেস্টকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছেন

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেলফাইল ছবি
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্রমেই আগ্রাসন নিয়ে কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল। ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে লেখা তাঁর কলামের প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে টেস্ট ক্রিকেটকে অবজ্ঞা করার বেদনা।

ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের শেষ দিনে জনি বেয়ারস্টো যখন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডকে জেতাল, তখনই নিজের অধিনায়কত্ব নিয়ে বেন স্টোকসের একটা কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেল। স্টোকস বলেছিল, ইংল্যান্ডকে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হতে হবে। রুটের দ্বিধাগ্রস্ত অধিনায়কত্বের সময়টা ব্যর্থ হলেও, নতুন অধিনায়কের অধীনে ইংল্যান্ডের এমন মানসিকতা বেশ ইতিবাচক ছিল, যে মানসিকতার অভাব ইংল্যান্ড অনুভব করেছে এত দিন।

আরও পড়ুন
টেস্ট জেতানোর পথে টি-টোয়েন্টি খেলেছেন বেয়ারস্টো
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কিছুদিন আগে আইসিসির প্রধান গ্রেগ বার্কলে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টি লিগের ক্রমেই বিস্তার নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আটকাতে আমরা বেশি কিছু করতে পারব না।’ সেদিন ইংল্যান্ড-বেয়ারস্টো যা করল, তাতে বার্কলের কথারই পূর্বাভাস পাওয়া গেল যেন। বোঝা গেল, ভবিষ্যতে ক্রিকেট খেলোয়াড় ও ভক্তরা কী কী জিনিসের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। বার্কলের মতে, টি-টোয়েন্টির ক্রমেই জনপ্রিয়তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দ্বিপক্ষীয় ক্রিকেট। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের জনপ্রিয়তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হুমকির মুখে ফেলবে দীর্ঘতম সংস্করণকে।

বার্কলের এই বক্তব্য ক্রিকেট–কর্তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার ব্যাপারটাই তুলে ধরল যেন। অবসর নেওয়া খেলোয়াড়েরা কী বলছেন না বলছেন, সেটা শুনেই এখনকার ক্রিকেট–কর্তারা তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ে যান। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিবাচক উন্নতির জন্য তাঁদের উচিত ‘ফিকা’র (ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করা। কিন্তু সেটা করছেন না তাঁরা। ওদিকে ভারত, ক্রিকেট বিশ্বে যারা সবচেয়ে বড় জাতি, তাদের কোনো খেলোয়াড়দের সংস্থাই নেই, যা বেশ বিরক্তিকর।

আরও পড়ুন
আইপিএলের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচিতে জায়গা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে
ফাইল ছবি

অস্ট্রেলিয়ার নারী দলের অধিনায়ক মেগ ল্যানিং যেমন, বার্কলের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছিল, ‘আমরা উচ্চাভিলাষী হতে চাই।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্রিকেটাররা উচ্চাভিলাষী হতে চাইলেও ক্রিকেট–কর্তাদের উচ্চাভিলাষী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।

তাঁরা দাসের মতো অর্থের পেছনে পেছনে ছোটেন এবং যেসব কাজ করলে খেলার আসলেই উন্নতি হয়, প্রায়ই সেসব কাজ করেন না। বহু আগেই ক্রিকেটের কর্তাদের উচিত ছিল অভ্যন্তরীণভাবে এমন এক বিতর্কের আয়োজন করা, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কীভাবে ভালোভাবে ক্রিকেটের উন্নতি করা যেতে পারে, তার একটা রূপরেখা পাওয়া যায়। ক্রিকেট কীভাবে খেলা উচিত, সে সিদ্ধান্তটা সব সময় বর্তমান খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে করা উচিত, বয়স্কদের মতকে গুরুত্ব দিয়ে নয়। তুলনামূলকভাবে কম দিন খেলে বেশি আক্রমণাত্মকভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেললে যদি খেলাটাকে বেশি বিনোদনদায়ী বানানো যায়, তাহলে বয়স্ক মানুষদের কান্নাকাটি হা-হুতাশ করা উচিত নয়।

আরও পড়ুন
টেস্ট ক্রিকেটের আবেদন কম, এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে আছেন ক্রিকেট-কর্তারা
ফাইল ছবি

ক্রিকেটে বৈচিত্র্য আনতে হবে, যাতে ভক্তরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী খেলাটা দেখতে পারেন। তবে কীভাবে ক্রিকেট খেললে দর্শকদের কাছে খেলাটা বেশি আনন্দদায়ী হতে পারবে, সে ব্যাপারে খেলোয়াড়দেরও মতামত দেওয়া উচিত। সে অনুযায়ী ক্রিকেট–কর্তাদের উচিত ক্রিকেটের প্রতিটি ধরনকে সঠিকভাবে অর্থকরী হিসেবে গড়ে তোলা। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট একটা পেশাদার খেলা, যা এখনো খুবই অপেশাদারভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ক্রিকেট যেভাবে পরিচালনা করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই এমন মানুষজনের মতামতের ওপর নির্ভর করে, যাঁরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। খেলাটা বহুদিন ধরেই প্রতিক্রিয়াশীলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে।

সমর্থকেরা যে ধরনের খেলা দেখতে চান, তেমনভাবে খেলাটা খেলতে দেওয়া হচ্ছে না।
যে কারণে ক্রিকেটের পরিচালকেরা বেশি বেশি টি-টোয়েন্টি আয়োজন করছেন। যে কারণে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তরুণ ক্রিকেটাররা যেখানে বারবার টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাপারে নিজেদের অনুরাগের কথা প্রকাশ্যে বলছে, সেখানে টেস্টের গুরুত্ব কমানো হচ্ছে ক্রমেই।

আরও পড়ুন
টি-টোয়েন্টি নিয়েই এখন সব পরিকল্পনা
ফাইল ছবি: এএফপি

টেস্ট আর ওয়ানডে, দুটোই খুবই আনন্দদায়ী সংস্করণ—যদি তা ভালোভাবে আধুনিক উপায়ে খেলা হয়। কিন্তু ক্রিকেটের কর্তারা খেলোয়াড়দের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে, আলোচনা না করে ক্রিকেটের উন্নতি করা বাদ দিয়ে শুধু আর্থিক দিকটার কথা চিন্তা করছেন। মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।

যে কারণে অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আয়োজিত হচ্ছে। শক্তিনির্ভর খেলা, ভালো ব্যাট ও ছোট মাঠের কারণে রানও হচ্ছে অনেক। যে কারণে বোলারদের কথা কেউ চিন্তাও করছে না। অনেক ক্ষেত্রেই বোলারদের এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে, ‘মাঠে গিয়ে নিজে চিন্তা করে বের করো কী করা যায়!’

বার্কলেদের বক্তব্য যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে আরও বেশি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আয়োজিত হবে। আর সেটাই যদি হয়, তরুণ ক্রিকেটাররা এমন সব টেকনিক নিয়ে কাজ করবে, যা তাদের লোভনীয় টি-টোয়েন্টি চুক্তি এনে দিতে সাহায্য করে। তখন কেউ সব ফরম্যাটের ব্যাপারে চিন্তা করবে না। সব ফরম্যাটে ভালো খেলার মতো ক্রিকেটারও পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন