‘গেইলকে অসম্মান করো না’

আইপিএলে ফিরেই ফিফটি পেয়েছেন ক্রিস গেইল।ছবি: আইপিএল

২০১১ সালের আইপিএল নিলাম। অবিশ্বাস্য কাণ্ডই ঘটেছিল সে বছর। কলকাতা নাইট রাইডার্সে দুটি বাজে বছর কাটানোর পর নিলামে কোনো দল ক্রিস গেইলকে নিতে চাচ্ছিল না। টি-টোয়েন্টির রাজা গেইলকে ২০১১ আইপিএল নিলামে শেষ পর্যন্ত অবিক্রীত থেকে যান! চোটেরও অবশ্য একটা ভূমিকা ছিল।

এরপর আসে সেই বিখ্যাত ফোন কল। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর তখনকার মালিক ভারতীয় কোটিপতি বিজয় মালিয়া ফোন করেন গেইলকে। জ্যামাইকার এক পানশালায় গেইল তখন আয়েশ করছিলেন। মালিয়ার ফোন পেয়ে লাফ দিয়ে ওঠেন গেইল। পেসার ডার্ক ন্যানেস চোট পাওয়ায় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছেন। তাঁর বদলি হিসেবে কোনো বোলারকে নয়, একজন ওপেনার চায় বেঙ্গালুরু। গেইল যদি রাজি থাকেন তাহলে এখনই বেঙ্গালুরুর বিমান ধরতে বলা হয় তাঁকে। চোটের কারণে গেইল এর আগের তিন মাস ব্যাট ছুঁয়ে দেখেননি। তবু ‘হ্যাঁ’ বলতে একটুও সময় লাগেনি এই জ্যামাইকানের। এরপর উড়াল দেন ভারতের উদ্দেশে। ভারতে পৌঁছে ৭-৮ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার ম্যাচে নেমে গেলেন পুরোনো দল কলকাতার বিপক্ষে, খেললেন ৫৫ বলে ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস।

বেঙ্গালুরুর সঙ্গে গেইলের প্রাণের সম্পর্কের শুরু সেখান থেকেই। এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা খেলেছেন দলটির হয়ে। প্রায় প্রতি মৌসুমেই অবিশ্বাস্য কিছু ইনিংস খেলেছেন। বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্র্যান্ড।

কিন্তু সবকিছুরই শেষ থাকে। ২০১৮ সালে বেঙ্গালুরুর সঙ্গে গেইলের সম্পর্কও শেষ হয়। ২০১৭ সালে বিপিএলে এসে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল রংপুর রাইডার্সকে অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরিতে ম্যাচ জেতালেও বেঙ্গালুরু তাঁকে দলে রাখেননি। অবাক করার বিষয়, শুধু বেঙ্গালুরু নয়, আইপিএলের কোনো দলই নিলামে গেইলের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। কেউই বিপিএলে গেইলের দুর্দান্ত ফর্ম বিবেচনায় নেয়নি। শেষ মুহূর্তে এসে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব সস্তায় দলে ভেড়ায় গেইলকে।

বঙ্গবন্ধু বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স হয়ে খেলেছেন গেইল।
ছবি: শামসুল হক

গেইলকে তাঁতিয়ে দেওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। ২০১১ সালের মতো সেবারও আইপিএল দলগুলোকে কড়া জবাব দেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচেই চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে খেলেন ম্যাচজয়ী ৩৩ বলে ৬৩ রানের ইনিংস। গেইল ২০১৯ আইপিএলেও নিয়মিত ছিলেন পাঞ্জাব একাদশে।

২০২০ সালে এসে আবার অন্য গল্প। বয়স হয়ে গেছে ৪১, চুলদাড়ি সাদা হতে শুরু করেছে। পা দুটি আগেও খুব বেশি নড়ছে না। যেন পাহাড়ের মতো জমে গেছে। বয়স, ফিল্ডিং ও উইকেটের মাঝে দৌড়ানোর সামর্থ্য দিয়ে গেইলকে বিচার করা শুরু হয়। শুধু বিপণনের জন্যই নাকি গেইলকে দলে রাখা, এমন কথাও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শোনা যাচ্ছিল। অথচ গেইল গত জানুয়ারিতেই বিপিএলের নিজের শেষ ম্যাচে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে মাত্র বলে ৬টি চার ও ৫টি ছক্কায় ২৫০ স্ট্রাইক রেটে ৬০ রান করেন!

গেইল যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘ইউনিভার্স বস’, সেটি আরেকবার ভুলে বসে ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটাকে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা দিতে গেইল কি না করেছেন। আজকের বিগ ব্যাশ এত জনপ্রিয় হতো না যদি না ক্রিস গেইল ও শহীদ আফ্রিদি সেখানে বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে না যেতেন। বিপিএলের জনপ্রিয়তা বাড়ত না যদি না গেইল প্রতি বছর মিরপুর, চট্টগ্রামের মাঠে ছক্কা না মারতেন। পিএসএলকে জনপ্রিয় করতেও গেইল ছিলেন বড় কারণ। কানাডায় গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের টি-টেন লিগ জনপ্রিয়তা পেত না যদি না গেইল ‘৩৩৩’ নম্বর জার্সি পরে মাঠে না নামতেন। করোনাভাইরাসের আগে নেপালে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলার কথা ছিল গেইলের।

কাল ফিফটির পথে গেইল।
ছবি: আইপিএল

তবু আইপিএল দলগুলোর শঙ্কা থাকে গেইলকে নিয়ে। এই বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ টি-টোয়েন্টি লিগে পারবেন তো গেইল আগের ঝলক দেখাতে? তাই পাঞ্জাব এক-দুই-তিন করে সাত ম্যাচ খেলে ফেলে গেইলকে বেঞ্চে বসিয়েই। গেইল অবশ্য মাঝে পেটের পীড়ায় হাসপাতাল থেকেও ঘুরে এসেছেন।

একের পর এক ম্যাচ হারতে থাকলেও গেইলকে দেখা যায় না পাঞ্জাব একাদশে। এরপর দেয়ালে যখন পিঠ যায় ঠেকে, তখন অভিজ্ঞতার কাছে হাত পাতে পাঞ্জাব। প্রথম সাত ম্যাচে এক জয়ের পর অষ্টম ম্যাচে কাল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে একাদশে রাখা হয় গেইলকে। আগের দুইবারের মতো কালও ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে পাঞ্জাবের আইপিএল মিশন বাঁচিয়ে রাখেন তিনি। তাঁর ৫৩ রানের ইনিংসে ভর করে পাঞ্জাব জিতেছে ম্যাচ। ইনিংসটি খেলেছেন গেইলের অপরিচিত তিনে নম্বরে নেমে। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে গেইলকে খেলতে হচ্ছে অচেনা জায়গায়। তবু তেতে থাকা গেইল হয়েছেন সফল।

তোমরা তো দেখতে পেয়েছ আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, নামটার প্রতি সম্মান রেখো
ক্রিস গেইল

কাল শারজায় ফিফটি করে নিজের ব্যাটে লেখা ‘দ্য বস’ চিহ্নে আঙুল দিয়ে কি যেন দেখাচ্ছিলেন। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে কথা বলার সময় গেইল বলেছেন, ‘তোমরা তো দেখতে পেয়েছ আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, নামটার প্রতি সম্মান রেখো (হাসি)।’

গত বিপিএলে বাংলাদেশে এসে গেইল বলেছিলেন, তিনি আরও পাঁচ বছর খেলা চালিয়ে যেতে পারে। ৪১ বছর বয়সী কাল আইপিএলেও মনে করিয়ে দিলেন একই কথা, ‘আজ আমরা ভালো খেলেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা জিতেছি। এটাই দরকার ছিল। এখন থেকেই আমি ২০২১ আইপিএলের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি!’

গেইল ফুরিয়ে যাননি, এই বার্তাটাই যেন আরেকবার দিয়ে গেলেন ক্রিকেট বিশ্বকে।