চার পেসার নিয়ে নামাটাই ছিল ইংল্যান্ডের ভুল

পেসাররা দর্শক হয়ে ছিলেন আহমেদবাদ টেস্টে।ছবি: বিসিসিআই

‘...লাড্ডু খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও পস্তাতে হয়।’

শূন্যস্থানের স্থলে চাইলে আহমেদাবাদ কিংবা এসজি বসাতে পারেন—যেখানে খাওয়া না খাওয়ার খেলায় প্রচলিত কথাটির সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। আলো-আঁধারে অতি সাবধানে গোলাপি ‘লাড্ডু’ খেতে (পড়ুন খেলতে) গিয়ে কিংবা না খেতে (ছেড়ে দেওয়া) গিয়েও পস্তাতে হয়েছে জো রুট-বেন স্টোকসদের। গোলাপি লাড্ডুটা কী বস্তু, সেটা তো বোঝা শেষ—দিবারাত্রির টেস্টে এসজির গোলাপি বল। আহমেদাবাদ টেস্টে ১০ উইকেটে হারের পর ইংল্যান্ড দল এই বল হাতে নিয়ে বলে উঠতে পারে, মির জাফর!

কথাটা রূপক—চাইলে প্রশ্নও তোলা যায়। বিশ্বাসঘাতক আসলে কী? উইকেট না বল? নাকি ইংলিশ টিম ম্যানেজমেন্টের কৌশলটাই ভুল? নরেন্দ্র মোদির (স্টেডিয়ামের) বুকের বাইশ গজে এত প্যাঁচ, তা ভাবতে পেরেছিলেন কেউ! তবে ক্রিকেট খেলার মজাটাও তো এখানে। দূরদর্শিতা থাকতে হয় জাতীয় দলের কোচ থেকে ম্যানেজমেন্টের। কিসের মুখোমুখি হতে হবে, কী ঘটতে পারে—এসব ভেবে নিজেদের শক্তি গোছাতে হয়। তাতে ইংল্যান্ড কি বড় ভুল করেছে?

একমাত্র আর্চারই উইকেট পেয়েছেন।
ছবি: বিসিসিআই

ভুলের প্রশ্নটা উঠছে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের ২২ গজের আচরণে। সরদার প্যাটেল স্টেডিয়াম যেমন রাতারাতি পাল্টে হয়ে গেল মোদির নামে, তেমনি গোলাপি বলে টেস্ট শুরুর পর প্রতিষ্ঠিত সত্যটাও পাল্টে গেল সেই মোদির ২২ গজেই মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে। গোলাপি বলে সুইং বেশি, গোধূলিলগ্নে তা আরও ভয়ংকর, এসজি বলের তুলনামূলক মোটা সিমে বল পড়লে অন্তত সুইং না হোক সিম মুভমেন্ট হবেই, একটু দম নিয়ে আরও একটা কথা বলা যায়—টেস্টে প্রথাগত লাল বলের তুলনায় গোলাপি বলের ঔজ্জ্বল্য থাকে বেশি সময়, তাতে পেসাররা সুবিধা পাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর এই প্রতিষ্ঠিত সত্যে বিশ্বাস রেখেই চার পেসার নিয়ে মাঠে নেমেছিল ইংল্যান্ড।

জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, জফরা আর্চার ও বেন স্টোকস—নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের সেরা পেস অ্যাটাক। এর সঙ্গে জ্যাক লিচের বাঁহাতি স্পিন। ক্রিকেটে ‘প্ল্যান বি’ বলেও একটা কথা আছে। লিচ সেই ‘প্ল্যান বি’—কিন্তু মূল পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিলেন চার পেসার, তাঁরা ক্লান্ত হলে কিংবা বৈচিত্র্য আনতে চাইলে এসজির মোটা সিম ব্যবহার করে বাঁক আদায় করবেন লিচ।

কিন্তু ক্রিকেট বরাবরই গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। আহমেদাবাদ টেস্টে সেই ‘গৌরব’ অবশ্যই ভারতের আর অনিশ্চয়তার যূপকাষ্ঠে মার খেয়ে গেল ইংল্যান্ডের কৌশল। ভারতে গত তিন বছরে আর অমন উইকেট দেখা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশ, কিংবা বড়জোর গলের উইকেট ছাড়া টেস্টে প্রথম দিনে স্পিনারদের আক্রমণে আসতে তেমন দেখা যায় না।

লিচই প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন।
ছবি: বিসিসিআই

গোলাপি বলে তো ‘দেখা যায় না’ বললেই চলে। সেখানে কিনা মোদির ২২ গজ প্রতিষ্ঠিত সত্যটাকে মিথ্যে বানিয়ে ছাড়ল! প্রথম দিনেই প্রায় ‘স্কয়ার টার্ন’ পেয়েছেন স্পিনাররা, সঙ্গে বাউন্স। আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা যায়, অক্ষর প্যাটেল কিংবা জ্যাক লিচের বল লেগ স্টাম্পে পড়ে কল্পিত ‘পঞ্চম স্টাম্প’ বরাবর ছোবল মেরে কোমর সমান উচ্চতায় উঠেছে।

আজ দ্বিতীয় দিনে সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো জো রুট। ইংল্যান্ড অধিনায়ক আজ হুট করেই বনে গেলেন বড় বাঁকের স্পিনার। বাউন্সটা বোনাস। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকেও খেলতে পারেননি কেউ। ওদিকে দুই দলের পেসারদের স্কোরকার্ড দেখুন—ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ৪৮.৪ ওভারের মধ্যে ইশান্ত শর্মা (৫ ওভার) ও যশপ্রীত বুমরা মিলে করেছেন মাত্র ১১ ওভার। ১টি উইকেট পেয়েছেন শুধু ইশান্ত। বাকি ৯ উইকেট দুই স্পিনার অক্ষয় ও অশ্বিনের। দুজনে মিলে করেছেন ৩৭.৪ ওভার।

ভারত অধিনায়ক টেস্টের শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলেন, এই উইকেট স্পিনারদের। এ কারণে দুই পেসারকে দিয়ে খুব একটা বল করাননি অধিনায়ক বিরাট কোহলি। এমন নয় যে তারা অকার্যকর ছিলেন, সিম মুভমেন্ট ও বাউন্স ছিল কিন্তু সেই একই ২২ গজে স্পিনাররা যখন গড়ে প্রায় এক হাত করে বাঁক ও বাউন্স পেয়ে থাকেন তখন পেসারদের দিয়ে বেশি বল করানোটা স্রেফ বোকামি। কোহলি আর যা–ই হোক বোকা নন। আর স্বাগতিক অধিনায়ক বলে বাড়তি একটা সুবিধাও তাঁর ছিল—উইকেট কতটা স্পিননির্ভর হবে, সেটির আঁচ পেয়েই হয়তো দলে তিন বিশেষজ্ঞ স্পিনার রেখেছিলেন—অশ্বিন, অক্ষর ও ওয়াশিংটন সুন্দর। মূলত এটাই ছিল ভারতের মূল পরিকল্পনা, পেসাররা ‘প্ল্যান বি’—যেখানে মার খেয়ে গেছে ইংল্যান্ড।

কোনো উইকেট পাননি অ্যান্ডারসন।
ছবি: বিসিসিআই

কিন্তু এই মার খেয়ে যাওয়াকে পুরোপুরি কৌশলের ভুল বলার জো নেই। সম্ভবত পৃথিবীর কেউ ভাববে না, টেস্টে উইকেটে প্রথম দিনেই বল পড়ার পর ধুলো উড়বে। এই ধুলো কিংবা পাউডারের মতো গুঁড়ো মাটিতে বল ফেলে স্পিনাররা রাজ করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক—২০১৬ মিরপুরে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট নিশ্চয়ই মনে আছে? হ্যাঁ, এমন কিছু হতে পারে সেই ভাবনার ছাপটা থাকতে পারত দলে।

পরিসংখ্যানও ইংলিশ কৌশলের পক্ষে। দিবারাত্রির টেস্ট শুরুর পর এ পর্যন্ত পেসারদের উইকেটসংখ্যাই বেশি (৩৫৬ উইকেট)। স্পিনাররা শিকারে (১৪৩ উইকেট) পিছিয়ে। চারটি দিবারাত্রির টেস্ট খেলে ইংলিশ পেসাররা যেখানে ৪০ উইকেট নিয়েছেন সেখানে তাদের স্পিনারদের শিকার মাত্র ১৩ উইকেট। তবে আগের তিন টেস্ট ছিল উপমহাদেশের বাইরে—বার্মিংহাম, অ্যাডিলেড ও অকল্যান্ডে পেসবান্ধব উইকেটে। তাহলে উপমহাদেশের চিরায়ত স্পিনবান্ধব উইকেটে কেন চার পেসার, এই প্রশ্ন তো?

ইংলিশ ম্যানেজমেন্টের কাছে এই প্রশ্নেরও জবাব আছে। ভারতের মাটিতে এ নিয়ে দিবারাত্রির টেস্ট হলো দুটি—সর্বশেষ বা প্রথম টেস্টটি ছিল ইডেন গার্ডেনসে বাংলাদেশের বিপক্ষে। সেই টেস্টের স্কোর দেখলেই পরিষ্কার ব্যাখ্যা মেলে—সোয়া দুই দিনে খেলা হয়েছিল মোট তিন ইনিংস (ভারত জিতেছিল ইনিংস ব্যবধানে)। সেখানে দুই দলের পেসাররা মিলে ৩০ উইকেটের মধ্যে নিয়েছিলেন ২৭টি। আর সেটি ছিল ইডেনের ২২ গজ, যা প্রথাগতভাবেই স্পিনবান্ধব ও ব্যাটিং-স্বর্গ। কিন্তু ২০১৯ সালের নভেম্বরের সেই টেস্টে ইশান্ত-যাদব-শামিদের গতি ও সুইংয়ের সামনে মুশফিক-মুমিনুলদের কাঁপাকাঁপি আর লিটন দাস ও নাঈম হাসানের মাথায় আঘাত পাওয়ার কথা তো মনে থাকার কথা।

এই প্রথম অ্যান্ডারসনের সঙ্গে ব্রডও খালি হাতে ফিরেছেন।
ছবি: বিসিসিআই

ভারতের মাটিতে দিবারাত্রির টেস্ট খেলতে নামার আগে সর্বশেষ এই নজির থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা না করাটাই তো বোকামি! ইংলিশ ম্যানেজমেন্ট হয়তো ইডেনের সেই টেস্ট থেকে শেখা বিদ্যাটা-ই কাজে লাগাতে চেয়েছিল। সেই চাওয়া থেকে পাওয়ার মাঝে যে কুহেলিকা—তার নিখুঁত ব্যাখ্যা দেওয়া কি সম্ভব? যদি কেউ বলতে পারে, সেটি শুধু উইকেট। আহমেদাবাদ টেস্টে ২২ গজের আচরণ দেখেই তো আজ পেসারদের ফেলে স্বয়ং রুট বোলিংয়ে নেমে ৫ উইকেট নিয়েছেন।

ভারত প্রথম ইনিংসে খেলেছে ৫৩.২ ওভার। যেখানে চার পেসার মিলে করেছেন ২৭ ওভার, ৪ উইকেট নেওয়া লিচ একাই করেছেন ২০ ওভার। বাকি ৬.২ ওভার রুটের। অর্থাৎ বাধ্য হয়েই চার পেসার তত্ত্ব যতটা সম্ভব দূরে রেখে কোহলির পথে হেঁটেছেন রুট। তাতে সাফল্য মিললেও ম্যাচের আগের দিনের কথাটা মিথ্যে প্রমাণ হয়েছে—গোধূলিলগ্নে গোলাপি বলে ভারতীয় পেসাররা না জানি কী করে বসেন! ম্যাচের আগে এমন শঙ্কার কথাই জানিয়েছিলেন রুট। সেটাও সম্ভবত বাংলাদেশের ইডেন টেস্টের দুই গোধূলি সময়ে পেসারদের ত্রাস ছড়ানো মাথায় রেখে—ফ্লাডলাইটের আলোতে গোলাপি বল দেখতে সমস্যা, এর সঙ্গে আবার সুইং ও সিম মুভমেন্ট, গতি তো বোনাস-শঙ্কা!

কিন্তু এই দুই দিনে ২২ গজে নেমে কী দেখা গেল? ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বল পড়লেই ধুলো উড়ছে!

ওটা আসলে ইংলিশ পরিকল্পনা মাঠে মারা যাওয়ার ছাইভস্ম, যেখানে রুট আত্মপক্ষ সমর্থন করে শুধু বলতে পারেন, ক্রিকেট সত্যিই গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা—এই বেলা তা ছেলেখেলা!