ছোট করে দেখানোতেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ মাহমুদউল্লাহদের

সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহর মুখ বেশ ভার ছিলছবি: বিসিবি

সমালোচনা কাকে সইতে না হয়েছে! শচীন টেন্ডুলকার বলুন বা বিরাট কোহলি, ইমরান খানই হোক আর ওয়াসিম আকরাম, গ্লেন ম্যাকগ্রা বা শেন ওয়ার্ন, চাই কি ব্রায়ান লারা কিংবা জ্যাক ক্যালিস...যুগে যুগে পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা কাউকেই ছাড়েনি।

কিন্তু অন্য কোনো যুগের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ যুগের পার্থক্যটা এই যে এখন সমালোচনাটা যেকোনো দিক থেকে যখন-তখন, যেকোনোভাবে আসতে পারে। ঝামেলাটা হলো, সে সমালোচনা মাঝেমধ্যে অনেক সময় আগল মানে না। পূর্বাপরের বিবেচনা সেখানে অনেক সময় থাকে না। পার্থক্যটা এটাও যে সে সমালোচনাটা বাতাসে ছড়িয়েও পড়ে দ্রুত। বাংলাদেশ দলকে বুঝিবা বেশ খেপিয়ে তুলেছে এমন অস্বাস্থ্যকর সমালোচনা।

ক্ষোভটা জানানোর জন্য আজকের চেয়ে ভালো মঞ্চও আর হতে পারত না! আজ পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে জয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ নিশ্চিত করে ফেলা বাংলাদেশ দলের হয়ে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও স্মিথভাষ্যে, দারুণ পরিমিতি ধরে রেখে জানিয়ে দিলেন, মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া সমালোচনা তাঁদেরও ছুঁয়ে যায়। তাঁদেরও মনে ক্ষত তৈরি করে।

ব্যাট হাতে আজ দারুণ পারফরম্যান্স ছিল মাহমুদউল্লাহর
ছবি: বিসিবি

ভেতরের ক্ষত তো আর চোখে দেখা যায় না, চোখে দেখা গেল শুধু সংবাদ সম্মেলনে যাওয়া অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর শক্ত হয়ে থাকা চোয়াল, চোখমুখ। দেহভঙ্গি পড়তে পারার বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ না হয়েও যে কেউ বুঝতে পারতেন, মাহমুদউল্লাহর মনে রক্ত ঝরছে। যে দলের প্রতিনিধি তিনি, সে বাংলাদেশ দলের অন্য সবারও অভিন্ন—এ ধরেই নেওয়া যায়। কানে ভেসে আসা মাহমুদউল্লাহর রাগত কণ্ঠস্বরও সে ধারণায় সায় দেয়। অভিমান, হতাশা, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, বিরক্তি সব মিলেমিশে একাকার সে কণ্ঠস্বরে।

কেন এত রাগ? বাংলাদেশ আজ পাপুয়া নিউগিনিকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে। বলে–ব্যাটে ভালো খেলেছে। সমীকরণ মিলিয়ে দিয়ে সুপার টুয়েলভে ওঠার প্রত্যাশা পূরণ করেছে। আজ তো মাহমুদউল্লাহদের মনে স্বস্তি আর আনন্দের অনুভূতি থাকার কথা। কিন্তু জয়ের এই ক্ষণে, নিজেদের প্রথম চ্যালেঞ্জে পাস করে যাওয়ার এই দিনেই মাহমুদউল্লাহ বারবার ফিরে গেলেন দুদিন আগের অন্ধকার মুহূর্তে।

প্রথম রাউন্ডে যে আট দল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার ‘বাছাইয়ে’ নেমেছে, সেখানে এ গ্রুপে শ্রীলঙ্কা আর বি গ্রুপে বাংলাদেশ সবার আগে সুপার টুয়েলভে যাবে—বিশ্বকাপের আগে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। আজ প্রথম রাউন্ডের শেষ মুহূর্তে এসে বলা যায়, প্রত্যাশামাফিকও সব হয়েছে। শ্রীলঙ্কা প্রথম দুই ম্যাচ জিতে গতকালই প্রথম দল হিসেবে প্রথম রাউন্ড থেকে সুপার টুয়েলভে যাওয়া নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ তা করেছে আজ।

পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে আজ দ্বিতীয় পর্বে ওঠা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ
ছবি: বিসিবি

কিন্তু বাংলাদেশের যাত্রাপথের শুরুটাই হয়েছিল একেবারে ধারণার বিপরীতে। স্কটল্যান্ড বিশ্ব ক্রিকেটে একেবারে অপরিচিত নাম নয় ঠিকই, পাপুয়া নিউগিনি কিংবা নামিবিয়ার মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে আসা দল নয় ঠিকই, কিন্তু তাদের কাছে হারবে বাংলাদেশ—এমনটা কজনই–বা ভেবেছিলেন! কিন্তু হলো তা-ই।

হলো বাংলাদেশের হতশ্রী পারফরম্যান্সেই! ৫২ রানে ৬ উইকেট তুলে নেওয়ার পরও স্কটল্যান্ডকে অলআউট করা হলো না সাকিব-মুশফিকদের, ৯ উইকেটে ১৪০ রান করে স্কটল্যান্ড। জবাবে ব্যাট হাতে শুরু থেকেই এলোমেলো বাংলাদেশ ১৩৪ পর্যন্ত যেতে পেরেছে। কিন্তু ৬ রানের হার শুনলে যা মনে হয়, বাংলাদেশের রান তাড়া মোটেও ততটা রুদ্ধশ্বাস জাগানিয়া ছিল না। বাংলাদেশ হারবে, এমন অনুমান বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মাঝামাঝি সময়েই হয়তো করে ফেলেছিলেন অনেকে।

এমন হারের পর বাংলাদেশ দলের সমালোচনা না হওয়াই অস্বাভাবিক। রানখরায় ভুগতে থাকা সৌম্য সরকার কিংবা লিটন দাস, ক্যারিয়ারে অনেক ম্যাচে ক্রিজে অনেকক্ষণ টেকার পরও স্লগ সুইপ বা স্কুপ খেলতে গিয়ে আউট হয়ে ফেরা মুশফিকুর রহিমদের সমালোচনা হারের পর হয়েছেও চারদিকে। মুণ্ডুপাত হয়েছে বিশ্বকাপ ওমান-আমিরাতে জেনেও বিসিবির মিরপুরের কালো পিচে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলারও।

স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মুশফিকের পারফরম্যান্স কুড়িয়েছে কড়া সমালোচনা
ছবি: বিসিবি

প্রথম পর্বের এ ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশ ফেবারিট ছিল বলেই বাংলাদেশের ওপর এত চাপ ছিল কি না, সংবাদ সম্মেলনে আজ এমন প্রশ্নে মাহমুদউল্লাহ বারবার ‘টি-টোয়েন্টির মতো সংস্করণে কোনো দল ফেবারিট থাকে না’ বলে এড়িয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু গ্রুপে বাংলাদেশই যে সবচেয়ে বেশি ধারেভারে এগিয়ে, এ নিয়ে তো সংশয় নেই। সে কারণেই হয়তো বাংলাদেশের হারে সমালোচনা বেশি হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয় ভাঙে।

কিন্তু সেটির সমালোচনা করতে গিয়ে ক্রিকেটারদের হৃদয় কেন ভাঙতে হবে? মাহমুদউল্লাহদের ক্ষোভ এ নিয়েই।

মাহমুদউল্লাহ কিংবা বাংলাদেশ দলের সমালোচনাতে আপত্তি নেই মোটেও। ‘স্বাস্থ্যকর’ সমালোচনাকে সমাদরে স্বাগতই জানাতে চান তাঁরা। পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে আজ সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহ তা-ই বললেন। কিন্তু সমালোচনা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যেখানে তাঁদের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন মন খারাপ হয় মাহমুদউল্লাহদের।

তাঁদের ঘিরে সমালোচনা তো তাঁদের পরিবারের কাছেও পৌঁছে যায়! ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের যুগ বলে কথা! তাঁদের মা–বাবা, সন্তানদেরও ছোঁয়। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়েই আক্ষেপ ঝরেছে মাহমুদউল্লাহর কণ্ঠে। বারবার বলছিলেন, ‘সমালোচনা অবশ্যই হবে, খারাপ খেলেছি। কিন্তু একেবারে ছোট করে ফেলা ঠিক নয়।’

মাহমুদউল্লাহ ভুল কিছু তো বলেননি।