ঢাকার ক্রিকেটে কাশ্মীরের তরুণী
জাসিয়ার অন্য রকম যুদ্ধ জয়ের গল্প
মেয়েদের আইপিএলে জাসিয়া এখন নিয়মিত মুখ, খেলেছেন ভারতের ‘এ’ দলেও। মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন মোহামেডানের হয়ে।
‘শোপিয়ান’, ‘কাশ্মীর’—এই শব্দ দুটি লিখে গুগলে সার্চ দিলে বন্দুকযুদ্ধ, বোমা হামলার খবরই সামনে আসবে। কাশ্মীরের প্রথম নারী ক্রিকেটার জাসিয়া আখতার সেই শোপিয়ান অঞ্চলের বাসিন্দা। দক্ষিণ কাশ্মীরের এই অঞ্চলের মানুষের রাত কাটে মৃত্যুর আতঙ্কে। দিনের আলোতেও থাকতে হয় সেই আতঙ্ক নিয়েই। জাসিয়া কাশ্মীরের সেই অংশ থেকেই উঠে এসে আজ ক্রিকেটার, যেখান থেকে উঠে আসাটাও যুদ্ধ জয়ের মতোই।
৩৪ বছর বয়সী ভারতীয় নারী ক্রিকেটার জাসিয়া অবশ্য ভয়, শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, সমাজের কুদৃষ্টি—সবকিছুই উড়িয়েছেন ছক্কায়। মেয়েদের আইপিএলে তিনি এখন নিয়মিত মুখ, খেলেছেন ভারতের মেয়েদের ‘এ’ দলের হয়েও। বর্তমানে মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে খেলছেন মোহামেডানের হয়ে। জাসিয়ার স্বপ্ন—একদিন ভারতের মেয়েদের জাতীয় দলেও খেলবেন। কাল তো মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে মোহামেডানের অনুশীলনেও তাঁর গায়ে দেখা গেল ভারতের জার্সি।
কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব, এরপর রাজস্থান—ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জাসিয়ার দৌড়ঝাঁপ চলছে এক দশক ধরেই। মিরপুরে কাল প্রথম আলোকে জাসিয়া সে যাত্রার কথাই বলছিলেন, ‘বলতে পারেন, খেলার সুযোগের জন্যই আমি কাশ্মীর ছেড়েছি। আমি যে জায়গায় থাকি, সেই দক্ষিণ কাশ্মীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ভারত-পাকিস্তান, দুই দিক থেকেই সেখানে পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমি যখন খেলা শুরু করি, তখন সেখানে জীবনটাই ছিল কঠিন।’
রাজ্য দল, আইপিএল ও ভারতীয় ‘এ’ দলে খেলে জাতীয় দলের দরজায় এখন জোর ধাক্কা দিচ্ছেন অলরাউন্ডার জাসিয়া। ঢাকা লিগে এবার দ্বিতীয়বারের মতো খেলতে এসেছেন। এর আগে ২০১৪-১৫ মৌসুমে খেলেছিলেন রূপালী ব্যাংকের হয়ে। এবার এখন পর্যন্ত চার ম্যাচ খেলে ৫৭ গড়ে রান করেছেন ১৭১। তবে তাঁর খ্যাতি মূলত স্ট্রাইক রেটের কারণে। এই লিগেই যেমন এই ডানহাতি হার্ডহিটারের স্ট্রাইক রেট ১১১। বল দেখো আর মারো—এটাই জাসিয়ার ব্যাটিং দর্শন, ‘আমি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং পছন্দ করি। টুকটুক করার অভ্যাস আমার নেই। কয়েকটা বল দেখার পরই মারা শুরু করি। দ্রুত রান করারই চেষ্টা থাকে আমার।’
জাসিয়ার ধারণা, তাঁর হার্ডহিটিং দক্ষতা এসেছে অ্যাথলেটিকস থেকে। স্কুলে জাসিয়ার খেলাধুলার হাতেখড়ি দৌড় দিয়ে। দৌড়ে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে মেয়েদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সেরা। তবে ক্রিকেটের নেশা ছিল বলে জাসিয়া শেষ পর্যন্ত অ্যাথলেটিকস ছেড়ে এই খেলাটাই বেছে নেন। তবে কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। একজন কাশ্মীরি কিশোরী ক্রিকেট খেলবে, এটাই যে মেনে নিতে পারছিল না জাসিয়ার সমাজ!
শুরুর অভিজ্ঞতাটা তাঁর মুখেই শুনুন, ‘মেয়েদের ক্রিকেটার হওয়ার পথে সামাজিক অনেক বাধা ছিল। নানা প্রশ্ন, নানা মন্তব্য, কটূক্তি শুনতে হয়েছে খেলার জন্য। জার্সি পরে খেলা নিয়ে তো তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যায় মাঝে মাঝে। আমি আবার পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। কাশ্মীরের একটা মুসলিম পরিবারে বড় মেয়ে ক্রিকেট খেলবে, সেটা চিন্তাই করা যায় না। চারপাশে আর্মিদের ভিড়, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, এত কিছু সামলে ক্রিকেট খেলে যাওয়াটা সহজ ছিল না।’
তবে জাসিয়া পরিবারের সমর্থন তিনি পেয়ে এসেছেন শুরু থেকেই। বাবা ছিলেন দিনমজুর। দৈনিক ৪০০-৫০০ রুপি আয়ের মানুষটি মেয়ের খেলার জন্যই প্রতিদিন ৫০ রুপি আলাদা করে রাখতেন। ক্রিকেট খেললে টাকা উপার্জন হবে, স্পনসর আসবে—এসব তখন ছিল অনেক দূরের কল্পনা। জাসিয়ার সেই কল্পনাই আজ বাস্তব, ‘বাবার কষ্টটা আমি কখনো ভুলব না। আইপিএল খেলার পর ইরফান পাঠান ভাই আমাকে স্পনসর এনে দিয়েছিলেন। বিশ্বাসই হচ্ছিল না কী হচ্ছে আমার সঙ্গে। আমি এর আগে উপহার পাওয়া ব্যাট দিয়ে খেলতাম। এখন আমার নিজের ব্যাট থাকবে! সব কল্পনা মনে হচ্ছিল।’
কাশ্মীরের নারী ক্রিকেটের জন্য জাসিয়াই এখন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ‘যদি জাসিয়া পারে, তাহলে আমরা পারব না কেন’—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই কি না কয়েক বছর ধরে কাশ্মীরে নারী ক্রিকেটার বাড়ছে। যুদ্ধের আবহের মধ্যেও ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকির শব্দ আশাবাদী করে তাদের, যে আশার বীজটা বুনে দিয়েছেন জাসিয়া আখতারই।