‘জেকিল’ বাটলার, ‘হাইড’ বাটলার

জস বাটলার। কাল কলকাতার বিপক্ষে শতকের পরছবি: আইপিএল

রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের কালজয়ী ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ বইটি কি পড়েছেন জস বাটলার ?

সেই যে চিকিৎসক জেকিল এমন এক ওষুধ আবিষ্কার করলেন, যার প্রভাবে একই মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই ধরনের চরিত্র ফুটে ওঠে। ওষুধের প্রভাবে হয়ে ওঠেন নেতিবাচক চরিত্রের হাইড, আবার প্রয়োজনমতো অন্য ওষুধ নিয়ে শান্ত মেজাজের জেকিল হয়ে ফিরে আসেন।

জস বাটলার মোটেও মন্দ চরিত্রের কেউ নন। তবে বোলারদের জন্য ব্যাটসম্যান বাটলার তো ‘মন্দ’ কিছুরই সমার্থক, যেমন খুনে মেজাজ! আবার প্রতিটি ডেলিভারির পর সেই বাটলারই সদাহাস্য শান্তশিষ্ট, যেন ডক্টর জেকিল!

আইপিএলে কাল দেখা গেল এমন দ্বৈত চরিত্রের বাটলারকে। প্যাট কামিন্স, উমেশ যাদবদের মেরে সীমানাছাড়া করার সময় শক্ত চোয়ালের বাটলার যেন এডওয়ার্ড হাইড; ভেতরকার দানবীয় শক্তি বেরিয়ে এসেছে। ঠিক তারপরই আবার অন্য মানুষ। কখনো হেলমেট খুলে হাসছেন, অন্য প্রান্তের সতীর্থের সঙ্গে ঠাট্টামশকরা করছেন, উইকেটে বেশির ভাগ সময় হাঁটাচলাও করলেন অবনতমস্তকে। যেন এমন ভালো মানুষ জগতে দ্বিতীয়টি নেই!

ব্যাট হাতে বাটলারকে এমন খুনে মেজাজেই দেখা যায়
ছবি: আইপিএল

কতটা ভালো, তা উমেশ-কামিন্সদের কাছে জানতে না চাওয়াই ভালো। রাতের আঁধারে ডক্টর জেকিল যেমন মিস্টার হাইড হয়ে উঠতেন আর সে চরিত্রের প্রভাবে খুনও করে বসেন, মুম্বাইয়ে লেডি ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে বাটলারও তেমনি ‘খুন’ করেছেন আন্দ্রে রাসেল, বরুণ চক্রবর্তী, শিবম মাভি কিংবা উমেশ-কামিন্সদের বোলিং ফিগার। হিসাব-নিকাশ করে দেখে খেললেন শুধু সুনীল নারাইনকে। তাঁর ৯ বলে করেছেন মাত্র ৫ রান।

শতক তুলে নেওয়ার পথে এই হিসাব-নিকাশটুকুও ডক্টর জেকিলের সঙ্গে মিলে যায়।
নিজের আবিষ্কার করা ওষুধের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখতে সেই চিকিৎসককেও খুব সাবধানে সময় নির্বাচন করতে হতো—দিনে ভালো মানুষ জেকিল রাতে যারপরনাই খারাপ হাইড।

বুদ্ধি খাটিয়ে এই হিসাবটুকু না করলে ডক্টর জেকিলের যেমন আর মিস্টার হাইড হয়ে ওঠা হতো না, তেমনি বাটলারও নারাইনকে দেখে না খেললে হয়তো এবার আইপিএলে নিজের দ্বিতীয় শতকের দেখা পেতেন না।

বইয়ে খুনের অনুশোচনায় জেকিল শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। ক্রিকেটে বাটলারের ক্ষেত্রে এমন কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। বরং ক্রিজে হাইডের রূপে ধরা দেওয়া বাটলারকেই দেখার মজাটা বেশি। খেলার মাঠে এমন সত্তায় বীরত্বের ছটা থাকে বলেই তো লোকে তা পছন্দ করে।

ব্যাটিংয়ের বাইরে বাটলারকে এমন হাসিখুশি দেখা যায়। কাল যুজবেন্দ্র চাহালের সঙ্গে ম্যাচ শেষে
ছবি: আইপিএল

কাল কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে বাটলার ও সঞ্জু স্যামসনকে মারমুখী মেজাজে দেখে কেভিন পিটারসেন যেমন টুইটে অনুরোধ করেন, ‘বাটলার ও স্যামসন, সারা দিন ব্যাট করলে কী হয়? অন্তত তিন বছর ধরে প্রতিদিন? ধন্যবাদ।’

পিটারসেনের এই ধন্যবাদের সিংহভাগ প্রাপ্য বাটলারের। কেন, তা বলার আগে কিছু পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখা ভালো। এবার আইপিএলে এখন পর্যন্ত রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ৬ ম্যাচ খেলা বাটলার টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৩৭৫), চার-ছক্কার তালিকায়ও শীর্ষে, টুর্নামেন্টে তিন শতকের দুটিই তাঁর—সবই করেছেন ভেতরকার ‘মিস্টার হাইড’কে জাগিয়ে তুলে। এই দানবীয় চরিত্রকে ম্যাচে প্রয়োজনমতো শান্ত করেছে বাটলারের ‘ডক্টর জেকিল’রূপী সত্তা।

বলা হয়, ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে টাইমিং খুব গুরুত্বপূর্ণ, টি-টোয়েন্টিতে তো বটেই। তেমনি ব্যাটিংয়েও কখন মারব, কখন থামব, বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাল বাটলার এই কাজটা এত ভালোভাবে করেছেন যে হার্শা ভোগলে টুইটে বলে দেন, ‘...টি-টোয়েন্টিতে সেরা ওপেনার।’

বাটলারের এই হিসাব-নিকাশের পক্ষে কথা বলছে পরিসংখ্যান। তাঁর খেলা প্রথম চার ম্যাচে দেখা গেছে প্রতিপক্ষ দলের অনভিজ্ঞ কিংবা দুর্বল বোলারদের কাছ থেকে বেশি রান তুলে নিচ্ছেন বাটলার। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের তরুণ পেসার উমরান মালিকের ৮ বলে তুলেছেন ২০, কিন্তু একই দলের বাকি বোলারদের কাছ থেকে নিয়েছেন ২০ বলে ১৫ রান। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের থাম্পি ও পোলার্ডের ১৬ বলে তুলেছেন ৪২, বাকিদের ৫২ বলে ৫৮।

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। দলটির অনভিজ্ঞ পেসার আকাশ দীপের ১২ বলে তুলেছেন ২৯, কিন্তু বাকিদের ৩৫ বলে তুলেছেন ৪১ রান। গুজরাট টাইটানসের যশ দয়ালের ১১ বলে ৩৩ রান নিলেও দলটির বাকি বোলারদের দেখে খেলে ১৩ বলে তুলেছেন ২১। টি-টোয়েন্টিতে দেড় শ প্লাস স্ট্রাইক রেটে ধারাবাহিক রান তুলতে সব বোলারকে যে মারার দরকার পড়ে না, শুধু সময় বুঝে ভেতরকার চরিত্রটা পাল্টে সাহস ও দক্ষতার ‘ওষুধে’র মিশেলে যে সফল হওয়া সম্ভব, তা বাটলারের ব্যাটিংয়েই পরিষ্কার।

ধারাবাহিকতার কথা যখন উঠল, তখন জানিয়ে রাখা ভালো, আইপিএলে নিজের সর্বশেষ ৭ ইনিংসে তিনটি শতক আছে বাটলারের। আর সর্বশেষ ২৩টি টি-টোয়েন্টি ইনিংসে শতক আছে চারটি। এবার আইপিএলে তাঁর ছয়টি ইনিংস দেখুন—৩৫, ১০০, ৭০*, ১৩, ৫৪ ও ১০৩। ‘অপয়া ১৩’ বাদ দিলে পুরোটাই পয়া, আর ১৫৬.৯০ স্ট্রাইক রেট হতে পারে বাটলারে এই পয়া সময়ের জ্বলজ্বলে সাইনবোর্ড—সাবধান, সময়টা এখন এডওয়ার্ড-বাটলার-হাইডের!

তাতে আপত্তি তুলতে পারেন ডক্টর হেনরি-বাটলার-জেকিল। সময়টা যে তাঁরও কম না! কাল মাইক্রোফোনের সামনে বাটলার নরম গলায় যেভাবে কথা বলছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরস আলোচনা উঠেছে, এই ছেলে জিনিয়াস! খুনে মেজাজে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে নরম গলায় কথা বলার কোনো মিল নেই। মাইক্রোফোনের সামনে যেন লাজুক লতা!

গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে ম্যাচে হার্দিক পান্ডিয়া ২০তম ওভারে টুর্নামেন্টে রানের হিসাবে বাটলারকে পেছনে ফেলার পর সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ‘কমলা টুপি’টা (টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের পরিচয়সূচক টুপি) খুলে ফেলেন বাটলার। সেটি আবার তাঁর মাথা উঠছে তাঁর খুনে-শান্ত ব্যাটিংয়েই!

ইংরেজ উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান এর মধ্যে প্রমাণ করেছেন, হাতে ব্যাট না থাকলে তাঁর মধ্যে জেকিলের সত্তাই বসত করে। ২০১৯ আইপিএলে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের কাছে ‘মানকাড’ আউট হয়েছিলেন বাটলার। তারপর দুজনের মধ্যে সেকি বৈরী সম্পর্ক। কিন্তু এবার রাজস্থানে তাঁরা সতীর্থ, অশ্বিনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের সময় এই বাটলারকেই মনে হয় ডক্টর জেকিল, অথচ ব্যাট হাতে কিনা হাইড!

এ কী মধুর বিভ্রম!