টেস্ট পরীক্ষায় ‘হাসিখুশি’ ছেলেটি

মাহমুদুলকে টেস্ট টুপি পরিয়ে দিচ্ছেন সাকিব আল হাসানছবি: শামসুল হক

মাহমুদুল হাসানের নিষ্পাপ চেহারায় একটা স্মিত হাসি সব সময় লেগেই থাকে। শরীরী ভাষায় মোলায়েম ভাবটা বোঝা যায়। ব্যাটিংটাও ঠিক তাঁর দেহভঙ্গিমার মতো। কাভার ড্রাইভটা খেলেন খুব আলতো করে, যেন বল টের না পায়!

অনড্রাইভে ব্যাটে–বলে সংযোগের সময় কবজির মোচড়ে বল দৌড়ে যায় সীমানায়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, হেলমেটের ভেতরে হাসিটা তখনো জ্বলজ্বল করছে।

কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললে মাহমুদুলের শটের ভিডিও জোড়া লাগিয়ে কেউ ‘মাহমুদুলের সেরা দশ শট’ শিরোনামে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট টুপি পরতে দেখে অবাক হননি মাহমুদুলের ছোটবেলার কোচ শামীম ফারুকী। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পরই মাহমুদুলকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি।

কাল প্রথম আলোকে তিনি বলছিলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, জয়ের (মাহমুদুল হাসান) অভিষেক হবে টেস্ট দিয়ে। সে টেস্টের জন্য আদর্শ ক্রিকেটার। একদম ঠান্ডা মাথার ছেলে। কাল সে আমাকে ফোন করেছিল খবরটা জানাতে। খুব খুশি হয়েছি তার অভিষেকের খবর শুনে। আমি বলেছি একদম ফুরফুরে থাকতে। আর দশটা ম্যাচ যেভাবে খেলে, ঠিক সেভাবেই খেলতে বলেছি।’

পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো মাহমুদুলের
ছবি: প্রথম আলো

১৩ বছর বয়স থেকেই মাহমুদুলকে দেখছেন চাঁদপুরের একটি ক্রিকেট একাডেমির কোচ শামীম। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে আর দশটা ছেলের মতো এলাকায় টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলতেন মাহমুদুল। কিন্তু বড় ভাইদের ভিড়ে ব্যাটিংয়ের সুযোগ খুব একটা পেতেন না লিকলিকে গড়নের কিশোর মাহমুদুল। তবে খেলার নেশা তাতে কমনি। বরং বেড়েছে। এ জন্য ব্যাংকার বাবার বকাঝকাও শুনতে হতো।

কিন্তু খেলার নেশা কি আর দমিয়ে রাখা যায়? এরপর মাহমুদুলের চাচার পরামর্শে বিকেএসপিতে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেয় মাহমুদুলের বাবা।

তার আগে ক্রিকেট শেখানোর জন্য মাহমুদুলকে চাঁদপুরের একাডেমিতে ভর্তি করানো হয়। ‘জয়ের আব্বার তাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করানোর ইচ্ছে ছিল। তাই আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিল এক-দেড় বছরের জন্য।

এরপর তো বিকেএসপিতেই চলে গেল। তখনো সে শান্তশিষ্ট ছিল। আমি ওর নাম দিয়েছিলাম ‘হাসিখুশি’। সব সময় মুখে একটা হাসি লেগে থাকে। যা বলতাম, ঠিক তাই করত। যে যা–ই বলুক, খুব মন দিয়ে শোনে’—বলছিলেন চাঁদপুরের কোচ শামীম।

মাহমুদুলকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আদর্শ মনে করেন তাঁর কোচেরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

২০১৪ সালের শেষের দিকে চাঁদপুর ছেড়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হন মাহমুদুল। সেখানকার কোচ মন্টু কুমার দত্তর সবার আগে নজরে পড়ে মাহমুদুলের প্রথম স্লিপ থেকে নেমে আসা সোজা ব্যাট।

প্রথম দেখায় মন্টু কুমার দত্ত নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, লিকলিকে গড়নের ছেলেটির ব্যাট থেকে বল এত দ্রুত যায় কীভাবে? ছেলেটা খুব পাতলা গড়নের ছিল। কিন্তু ব্যাট সোজা নামত। এটা চোখে লেগেছিল।

প্রথম বছর অতটা ভালো না করলেও পরের বছর থেকেই দ্রুত উন্নতি করতে থাকে।
উন্নতিটা ধরে রাখেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের প্রতিটি ধাপে।

সে জন্যই মাহমুদুলের প্রথম কোচ শামীমের মতো মন্টু কুমার দত্তও একই কথা বলেছিলেন, ‘আমার অনেক ছাত্রই টেস্ট ক্রিকেটার হয়েছে। জয় যে একদিন টেস্ট খেলবে সেটা আমি অনেক আগেই বলেছিলাম। এখন তো ঠিক তা–ই হলো।’

বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে মাহমুদুল
ছবি: প্রথম আলো

বিসিবি হাই পারফরম্যান্স বিভাগের কোচ টবি রেডফোর্ডও মাহমুদুলের ব্যাটিং কৌশলের বিরাট ভক্ত। তবে টেস্ট অভিষেকটা একটু দ্রুত হয়ে গেল কি না, এ নিয়ে একটু সন্দেহ আছে এই ইংলিশ কোচের, ‘মাহমুদুল দারুণ প্রতিভা। বিশেষ করে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের জন্য তাঁর খেলাটা বেশ মানানসই। কিন্তু এখনই টেস্ট ক্রিকেট, সেটাও আবার পাকিস্তানের মতো বড় দলের বিপক্ষে—এটা হয়তো চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে আমার মনে হয় তাঁর সেই সামর্থ্য আছে। হয়তো মানিয়ে নিতে কয়েকটি ইনিংস লাগবে মাহমুদুলের।’

তবে চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক, সেটা যে হাসিমুখেই পাড়ি দেবেন মাহমুদুল, সেটি নিশ্চিত।