দিনে ২৫০ ওভার বাউন্সার খেলিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে গিলকে

ব্রিসবেন আলো ছড়িয়েছেন শুবমান।ছবি: এএফপি

ব্রিসবেনে ফাস্ট বোলাররা রাজত্ব করেন বরাবর। ৩২ বছর ধরে গ্যাবায় না হারার পেছনে অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলাররাই ভূমিকা রেখেছেন। সেই উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার দ্রুততম বোলারের কী হালটাই না করলেন শুবমান গিল! বিশেষ করে বাউন্সারগুলো সামলেছেন কী অনায়াসে!

কীভাবে বাউন্সের বিপক্ষে, ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে এত সাবলীল হলেন গিল? উত্তরটা জানালেন তাঁর বাবা লখিন্দর সিং। ছেলেকে নাকি দিনে ১৫০০ বাউন্সার খেলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করেছেন লখিন্দর। ১৫০০ বল, মানে ২৫০ ওভার!
পঞ্চম দিনে ভারত যখন ৩২৮ রানের লক্ষ্যে নেমেছে, তখন গতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার লক্ষ্যে নেমেছিলেন মিচেল স্টার্ক। ফল হলো উল্টো। স্টার্ককে অনায়াসে সামলেছেন গিল। রীতিমতো পাত্তাই দেননি এই পেসারকে।

স্টার্কের এক ওভারে পুল, হুক, পাঞ্চ আর কাট—নিজের সব ধরনের ক্ষমতাই দেখিয়েছেন গিল। গতিময় বোলারকে সামলানোর সব দক্ষতা দেখিয়ে এক ওভারেই ২০ রান তুলে নিয়েছিলেন এই ওপেনার। ঋষভ পন্তের দারুণ এক ইনিংস ম্যাচ জেতালেও ভারতকে জয়ের স্বপ্নটা দেখিয়েছেন গিলই।

সফরে ভারতের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন চেতেশ্বর পূজারা। প্রায় এক হাজার বল সামাল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের হতাশ করার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু শর্ট বলে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। ১১ বার শরীরে আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু গিল ততটাই যেন স্বচ্ছন্দ পেসারদের বিপক্ষে। পেছনের পায়ে অনায়াসে শট খেলার দক্ষতা দেখিয়ে ব্রিসবেনে ৯১ রান করেছিলেন গিল। সেঞ্চুরি না পেলেও ২১ বছর বয়সী ওপেনার সবার নজর কাড়ায় সফল।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম খেলতে গিয়েই এমন নজরকাড়া ইনিংস, চমক তো জাগেই। বিশেষ করে বাউন্সের বিপক্ষে গিলের স্বচ্ছন্দ ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ সবাই। পেছনের পায়ে বা ব্যাকফুটে গিলের পারফরম্যান্সের পেছনে অবশ্য কৃতিত্বটা দাবি করছেন গিলের বাবা। লখিন্দর সিং বলেছেন, ‘ওর ৯ বছর বয়স থেকে ওকে দিনে ১৫০০ শর্ট বল খেলিয়েছি আমি।’

টেস্ট অভিষেকে জয়ের স্বাদ পেয়েছেন গিল। সে ম্যাচেই দলের জয় নিশ্চিত করে অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন। সিডনিতে নিজের প্রথম ফিফটির দেখা পেয়েছেন। ব্রিসবেনে তো একটুর জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিই হাতছাড়া হলো। তবে যা করেছেন, তাতেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎ ধরা হচ্ছে তাঁকে। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেটা বোঝা যায় লখিন্দরের কথায়।

মা-বাবার সঙ্গে শুবমান গিল।
ছবি: টুইটার

দক্ষিণ এশিয়ায় আয়েশ করার আসবাব হিসেবেই পরিচিত চারপাই বা খাটিয়া। সেই চারপাইকেও ছেলের ক্রিকেট শিক্ষায় ব্যবহার করেছেন গিলের বাবা, ‘ও যেন দ্রুতগতির বল সামলাতে পারে, সেটা শেখাতে আমি চারপাইয়ে বল ছুড়তাম। চারপাইয়ে পড়ার পর বল আরও দ্রুত ছোটে। এ ছাড়া ব্যাটের বদলে স্টাম্প দিয়ে খেলত সে। এতে শুবমানের অধিকাংশ শট ব্যাটের মাঝে খেলার অভ্যাস হয়েছে। ওকে ম্যাট উইকেটে বেশি অনুশীলন করাতাম। ম্যাটে যে বাড়তি বাউন্স পাওয়া যায়, সেটা আপনাকে দ্রুত লাইনে যেতে এবং সঠিক অবস্থানে পৌঁছাতে বাধ্য করে। যে ব্যাটসম্যান ম্যাট উইকেটে খেলে, তারা পেছনের পায়ে খেলে অভ্যস্ত হয়, যেটা শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।’

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট–পাগল শুবমান। বাবা লখিন্দর নিজেও ক্রিকেটপ্রেমী। নিজে উপযুক্ত নির্দেশনার অভাবে স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। সে হতাশা নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। নিজের দক্ষতা কাজে লাগানোর মতো সুবিধা বা সাহস—কোনোটিই হয়ে ওঠেনি বলে পেশাদার ক্রিকেটারের জীবনের স্বাদ পাননি। ছেলের ক্ষেত্রে সে অপূর্ণতা দেখতে চাননি। তাই ছেলেকে পুরোপুরি ক্রিকেটেই মনোযোগ দিতে দিয়েছেন লখিন্দর, ‘কম বয়স থেকেই খেলায় আগ্রহ ছিল শুবমানের। একদম বাচ্চাকাল থেকেই ওর প্রিয় খেলনা ছিল প্লাস্টিকের ব্যাট। খেলায় ওর আগ্রহ দেখে আমি নিজেই ওকে অনুশীলন করিয়েছি।’

নিজের প্রথম জেতা টেস্ট সিরিজের ট্রফির সঙ্গে শুবমান।
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ছেলের জন্য কতটা আত্মত্যাগ করেছেন, সেটা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন লখিন্দর। পাঞ্জাবের ফাজিলকা জেলার ছোট এক গ্রাম চকখেরাওয়ালায় থাকতেন। সেখানে ক্রিকেটার হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি, ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে লখিন্দর পুরো পরিবার নিয়েই চলে এসেছেন শহরে। মোহালিতে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে আবাস গড়েছেন।

কেন? যাতে ক্রিকেটেই দিনরাত পড়ে থাকতে পারেন শুবমান, ‘আমাদের গ্রাম মোহালি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেখানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তাই আমরা ওকে মোহালিতে নিয়ে আসি। আমরা এখানে এসেছি; কারণ, ভেবেছি যে এখানে আরও ভালো সুযোগ পাবে সে।’

মোহালি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলে শুবমানের। সেখানে পাঞ্জাবের সেরা পেসারদের অনুশীলনে খেলাটাও তাঁর কাজে এসেছে। কিন্তু তাঁর বাবাও কড়া নজরদারি রাখতেন। ওই যে দিনে ১৫০০ বল বা ২৫০ ওভার শর্ট বল খেলতে বাধ্য করা। এর বাইরে সাধারণ লেংথ বল খেলা বা অন্যান্য অনুশীলনের হিসাবটা যোগ করলে সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য ঠেকে। প্রায় অকল্পনীয়!