দুর্দান্ত বাবরকে যেভাবে পেল পাকিস্তান
১৪ এপ্রিল, ২০২১, বুধবার—ক্রিকেটের এ দিনটিকে অবলীলায় যে কেউ বলে দিতে পারেন, বাবর আজমের দিন! দিনের শুরুর দিকে একটা সুখবর পেয়েছেন—বিরাট কোহলিকে সরিয়ে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর ব্যাটসম্যান হয়েছেন বাবর। এ সুখবরে ভূমিকা রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে সিরিজে তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিংই। দিনের শেষ ভাগে সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই সিরিজের তৃতীয় টি–টোয়েন্টিতে ৫৯ বলে ১২২ রানের অসাধারণ একটি ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিয়েছেন বাবর।
পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অবশ্য বেশি ভালো লাগার কথা ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে কোহলিকে পেছনে ফেলে বাবরের শীর্ষে ওঠার বিষয়টিই। তাদের অসামান্য এ ব্যাটিং–রত্ন যে ধীরে ধীরে বয়সের সীমানা পেরিয়ে নিজেকে মহামূল্যবান হিসেবে প্রমাণ করতে শুরু করে দিয়েছে! বিষয়টি যখন এ রকম, পাকিস্তানের ক্রিকেটের গত দশকটায় একটু চোখ বুলিয়ে আসা যায়। একবার দেখে নেওয়া যাক এই এক দশকে পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের। তারপর তাঁদের সঙ্গে তুলনা করা যাক বাবরকে।
মিসবাহ–উল–হক, বর্তমানে পাকিস্তানের কোচের ভূমিকায় থাকা সাবেক এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ে চাকচিক্য বা দেখানদারির চেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবটাই বেশি ছিল। শোয়েব মালিক তো টেস্ট ক্রিকেটে নিজের নামটা সেভাবে লেখাতেই পারলেন না। চিরসবুজ শহীদ আফ্রিদির বেলায়ও সেই একই সত্যি। লম্বা সময় ধরে পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শিরোনাম হয়ে ছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। সেটাও অবশ্য ব্যাটিংয়ের সঙ্গে তাঁর হাত ঘোরানোর সামর্থ্যের কারণে।
সব মিলিয়ে পাকিস্তান একজন নিখুঁত বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের জন্য হাপিত্যেশ অনেক দিন ধরেই করছে। অথচ দুনিয়ার অন্য দলগুলোয় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে পরের প্রজন্মের প্রতিভারা। ভারতের আছে বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মা, এখন তো একজন ঋষভ পন্তও পেয়ে গেছে ভারত। ইংল্যান্ডের ছিলেন একজন অ্যালিস্টার কুক। এখন আছেন জো রুটের মতো অসামান্য প্রতিভা। অস্ট্রেলিয়া স্টিভ স্মিথ, ডেভিড স্মিথ ও মারনাস লাবুশেনের মতো ব্যাটসম্যান পেছে। রস টেলরের এখন পড়ন্ত বেলা, তবে নিউজিল্যান্ড অনেক আগেই পেয়ে গেছে কেইন উইলিয়ামসনের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
অথচ পাকিস্তান ক্রিকেটে সময় যেন থমকেই গিয়েছিল। এই সময়টাতে তাদের লড়াই করতে হয়েছেন ‘নতুন ঘরে’ মানিয়ে নেওয়ার জন্য। আর সেই যুদ্ধ করতে করতেই পাকিস্তানের ক্রিকেটে চলেছে শুধু আনন্দময় স্মৃতির জাবর কেটে! তারা এখনো হাতড়ে বেড়ায় জহির আব্বাসের সেই ব্যাটিং সৌন্দর্য, জাভেদ মিয়াঁদাদের বুদ্ধিদীপ্ত সব শট, সাঈদ আনোয়ারের কবজির মোচর, ইনজামাম–উল–হকের অলস সৌন্দর্য, ইউনিস খানের ইতিবাচকতা। এর মধ্যে আরেকটা বিষয়ও চলতে থাকে পাকিস্তানের ক্রিকেটে। ‘কাঁচা হীরা’ খুঁজে এনে ঘষেমেজে ঝাঁ–চকচক করার চেষ্টা। যেসব হীরার বেশির ভাগই ঝরে পড়ে। তবে বাবর আজম সেসব কাঁচা হীরার একজন, যিনি পাকিস্তানের পরবর্তী ব্যাটিং কিংবদন্তি হওয়ার পথেই আছেন। তিনি এমন একজন, এই সময়ের অন্যতম ব্যাটিং–নায়ক বিরাট কোহলিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে পাকিস্তান যখন শিরোপা জেতে, বাবরের বয়স ছিল ২২ বছর। ২ বছর পর বিশ্বকাপে তিনি ভেঙে দেন মিয়াঁদাদের একটি পাকিস্তানি রেকর্ড। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৬৭.৬১ গড়ে ৪৭৪ রান করেন বাবর। এই রান করে তিনি মিয়াঁদাদের ১৯৯২ বিশ্বকাপের রেকর্ড ভেঙে হয়ে যান এক বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটসম্যান। ২০১৯ বিশ্বকাপে অবশ্য সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। তবে সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা অন্তত এটা দেখতে পেয়েছেন যে বয়সের গণ্ডি পেরিয়ে বাবর নিজেকে পুরোদস্তুর একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের রান তাড়া করে জেতা ম্যাচে পূর্ণ বিকশিত ফুল হয়ে ফুটেছিলেন বাবর। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সেই মেঘলা আকাশের নিচে ট্রেন্ট বোল্টের সুইং ছোবল মারছিল সাপের মতো। লকি ফার্গুসনের গতিময় বলগুলো কানে হিশহিশ শব্দ তুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল সাঁইসাঁই করে। আর সেদিন যেন নিখুঁত বোলিংয়ের অনুপম এক পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন মিচেল স্যান্টনার। বিপরীতে বাবর ছিলেন ঋষিমুনির মতো স্থিতধী। সময় নিয়ে খেলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছেন নিজের খোলস থেকে। ১০১ রানে অপরাজিত থেকে দলকে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন তিনি। ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, এটি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস!
বাবরনামার কিছু অংশ তো শোনানো গেল। এখন আসা যাক বাবর কীভাবে নিজেকে এমন একজন ব্যাটসম্যানে পরিণত করতে পেরেছেন, সেই গল্পে। গল্পের শুরুতে টেনিস বলের ক্রিকেট। ছোটবেলায় যেটা তিনি খেলতেন লাহোরের অলিগলিতে। কখনো অনুশীলনের ছলে, কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপে। লাহোরের মডেল টাউন পার্ক গাদ্দাফি স্টেডিয়াম থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেই মডেল টাউন পার্কেই বেড়ে উঠেছেন বাবর, ওই যে টেনিস বলের ক্রিকেটে।
আকমল ভাইয়েরা তাঁর খুড়তুতো ভাই হন। কিন্তু আকমলদের মতো বিপথে চলে যাননি বাবর। এর কারণ নিশ্চয়ই বাবা আজম সিদ্দিক। বাবরের যাত্রাপথে দেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপেই যে এ মানুষটার হাত ছিল তাঁর পাশে। বাবরকে এ পর্যায়ে দেখতে আজম সিদ্দিক কতটা কী করেছেন, সেটা স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি পিসিবির পডকাস্টে বাবর ও ইমাম–উল–হকের এক আলোচনায়। অনূর্ধ্ব–১৬ ক্রিকেটের ট্রায়াল দেওয়ার সময় ছেলের জন্য পুরো দিন মাঠেই পড়ে থাকতেন আজম সিদ্দিক। সেটি মনে করিয়ে দিয়ে পডকাস্টের ওই আলোচনায় ইমাম বলেছেন, ‘এমনকি এখনো তুমি যদি ১১টার মধ্যে বাড়ি না ফেরো, তিনি তোমাকে বা আমাকে ফোন করেন।’
ইমাম–উল–হক কথাটা মজা করেই বলেছেন। এর উত্তরে আজম বলেছেন, ‘এখনো আমি যদি কোনো ভুল শট খেলি, বাবা আমাকে বকা দেন।’ ছোটবেলায় বাবর আজমকে কড়া শাসনে রাখতেন তাঁর বাবা আজম সিদ্দিক। সেই সময়ের কথা মনে করে বাবর বলে চলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আমাকে বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। আমি এ বিষয়টি নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলাম না। কিন্তু বাবা সব সময় বলতেন, “তুমি যখন বড় হবে, তখন সব বুঝতে পারবে।” সত্যিই আমি এখন বুঝতে পারছি।’
বাবার শাসন ও সাহায্য আর টেনিস বলের ক্রিকেট খেলে বেড়া ওঠা বাবরের ক্যারিয়ারে ভূমিকা রেখেছে ঠিক, কিন্তু তাঁর এমন নিখুঁত ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার আরেকটা রহস্যও জানিয়েছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। সব কিংবদন্তি আর অসাধারণ ক্রিকেটারদের দেখেই শেখেন বাবর। আর কঠিন অনুশীলন করেন। এটাই নাকি তাঁকে এমন নিখুঁত ব্যাটসম্যান বানাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। কোহলির দেওয়া একটি পরামর্শ বাবরের এখনো মনে আছে, ‘আমার মনে আছে বিরাট কোহলি আমাকে বলত, “তুমি নেটে যেমন খেল, মাঠেও সে রকমই খেলবে।”’
বাবরের সবচেয়ে শক্তির জায়গা কাভার ড্রাইভ। তিনি যখন নিখুঁত কাভার ড্রাইভ খেলেন, সেটা দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। কাভার ড্রাইভে নিখুঁত হতে তিনি এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছেন, ‘একটি কাভার ড্রাইভ খেলার আগ পর্যন্ত আমি ব্যাটিংয়ে নেমে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারি না। অনেকেই আমাকে ইনিংসের শুরুতে এ শটটি না খেলার পরামর্শ দিয়েছে। আমি এটা নিয়ে লড়াই করেছি। কিন্তু এই শটটা আমার স্বভাবজাত। আমি কাভার ড্রাইভ করার মতো বল ছেড়ে দিতে পারি না। তবে এই শটটা আমি এখনো অনেক অনুশীলন করি।’
বাবরের টেকনিকের আরেকটা বড় ব্যাপার বল দেরিতে খেলতে পারার বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে উন্নত করেছেন কেইন উইলিয়ামসনকে দেখে আর ইজাজ আহমেদের পরামর্শ নিয়ে। বাবর বলে চলেন, ‘আপনি বল যত বেশি শরীরের কাছ থেকে খেলতে পারবেন, শটটার ওপর নিয়ন্ত্রণ তত বেশি থাকবে। শুরুর দিকে আমি বল শরীরের চেয়ে দূরে থাকতেই খেলতে চাইতাম। এটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।’
সেই অভ্যাসে পরিবর্তন আসে পাকিস্তানের সাবেক ব্যাটসম্যান ইজাজের পরামর্শে, ‘ইজাজ ভাই আমাকে সব সময় বলতেন, এভাবে খেলতে থাকলে আমাকে লড়াই করতে হবে। তিনি যে ঠিক বলেছিলেন, সেটা আমি ২ থেকে ৩ বছর যেতে না যেতেই বুঝতে পারি। এটা অবশ্য এক রাতের মধ্যে হয়ে যায়নি। এমনকি এক বছরেও না। ব্যর্থ হলে আমি নিজেই থমকে যেতাম আর নেতিবাচক কথা ভাবতে থাকতাম। কিন্তু এখন আমি সেটা কাটিয়ে উঠেছি। আমি নিজের সঙ্গে অনেক কথা বলি।’
ক্রিকেট, ক্রিকেট আর ক্রিকেট—প্রচুর খেলতে হবে, এ মনোভাবটাও বাবরকে এমন পর্যায়ে এনেছে বলে মনে করেন তিনি নিজেই। একটা উদাহরণও দিয়েছেন তিনি—২০১৯ বিশ্বকাপ থেকে পাকিস্তান বাদ পড়ার পর বাবর বসে থাকেননি, সমারসেটের হয়ে খেলতে চলে যান কাউন্টি ক্রিকেট। সমারসেটের হয়ে ৫২.৫৪ গড়ে সেবার ৫৭৮ রান করেছিলেন বাবর। সেবারের কাউন্টি ক্রিকেটে খেলে কতটা উপকৃত হয়েছেন, সেটাও বলেছেন তিনি, ‘আমি সেখানে অনেক শিখেছি। বিশ্বকাপ শেষে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়েই আমি চলে যাই। সেখানে মানসম্পন্ন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আমি ১৪টি ম্যাচ খেলেছি। এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেহাতীতভাবেই পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান বাবর। গত ৫ বছরে ওয়ানডেতে ৫৮.১৮ গড়ে রান তুলেছেন তিনি। একমাত্র কোহলি (৭৫.১০) আর রোহিতেরই (৬০.৮২) গড় এর চেয়ে বেশি। আর আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে এই সময়ে তাঁর চেয়ে বেশি রান কেউ করেনি। ৫০ ম্যাচে ১ হাজার ৯১৬ রান করেছেন বাবর। ৫১ ম্যাচে ১ হাজার ৫৭২ রান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন রোহিত শর্মা। তবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে সেরাদের মধ্যে নিয়ে যেতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বাবরকে।
সম্প্রতি পাকিস্তান দলে বাবরের দায়িত্বের ব্যাপ্তি বেড়েছে। এখন শুধু তিনি পাকিস্তানের সাদা বলের অধিনায়কই নন, দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সব ধরনের ক্রিকেটে। তবে বাড়তি এ দায়িত্ব তাঁর ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলছে না। তবে অধিনায়কত্বে শুধু যে একতরফাভাবে ভালোই করে যাবেন, এমনটা ভাবেন না বাবর, ‘একজন অধিনায়ক হিসেবে আমার জয়ের গ্রাফটা যে শুধু সরলরেখায় এগোবে, তা আমি মনে করি না। উত্থান–পতন থাকবে। কিছু ভুল থাকবে, কখনো কখনো ভালো পারফরম্যান্স থাকবে।’
তবে সময়টা এখন বাবর আজমের পক্ষেই আছে। অস্ট্রেলিয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকায় দুটি ওয়ানডে সিরিজ জিতে আসা দ্বিতীয় দল বাবরের পাকিস্তান। আর কাল তো কোহলির ৪১ মাসের রাজত্ব শেষ করে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছেন বাবর। পাকিস্তানের কোনো ব্যাটসম্যান সর্বশেষ র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছিলেন ২০০৩ সালে, মোহাম্মদ ইউসুফ। পাকিস্তানের লম্বা সময়ের অপেক্ষা ফুরিয়েছে। র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠার, একজন নিখুঁত বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান পাওয়ার। জয়তু বাবর আজম!