দূরের সাকিব, কাছের সাকিব

কিছুদিন আগেও সাকিব তাঁদের কাছে ছিলেন দূর আকাশের তারা। জিম্বাবুয়ে সফরে তরুণ ক্রিকেটাররা তঁাকে দেখছেন কাছ থেকে।

সাকিব আল হাসানকে ঘিরে জাতীয় দলের তরুণদের যত আগ্রহ। ম্যাচ, অনুশীলন কিংবা টিম হোটেল, সব সময় দলের তরুণ ক্রিকেটাররা থাকতে চান সাকিবের সান্নিধ্যে।ছবি: প্রথম আলো

রাত তিনটার দিকে দরজায় ঠকঠক শব্দ। এত রাতে কে এল আবার! অবাক হয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রশ্ন।

দরজা খোলার পর উপস্থিত বাকিদের অবাক হওয়ার পালা। ঘুম ভাঙা চোখে সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় দলে তখনো প্রায় নতুন এক খেলোয়াড়। একটু পরই দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরের উদ্দেশে হোটেল ছাড়বেন মাশরাফি। তিনি এসেছেন ওয়ানডে অধিনায়ককে বিদায় জানাতে।

তরুণদের কাছে সাকিব পুরোপুরি আর দশজন সিনিয়র ক্রিকেটারের মতোই একজন।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ঘটনাটা ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর রাতের, দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনের টিম হোটেলে। অত রাতে রুমে এসে তরুণ ক্রিকেটারটি সেদিন মাশরাফিকে শুধু বিদায়ই জানাননি, মাশরাফির বারবার বারণ সত্ত্বেও সুইট রুমের এখানে–ওখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা টুকটাক জিনিসপত্র এক জায়গায় করে গুছিয়ে দিলেন লাগেজ।

মাশরাফির প্রতি সতীর্থদের ভালোবাসার এ রকম উদাহরণ কম নেই। যত দিন দলে ছিলেন, তরুণদের পথপ্রদর্শক হয়েই তো ছিলেন! দলে এখনো যাঁরা সিনিয়র আছেন—তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান বা মুশফিকুর রহিম; তাঁরাও কম–বেশি নিজেদের মতো করে তরুণ ক্রিকেটারদের পাশে থাকেন, উৎসাহ দেন। তবে এই জায়গায় সাকিবের ধরন কিছুটা ব্যতিক্রমই বলতে হয়।

আবার একটু পেছন ফিরে যাওয়া যাক। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সাকিবকে বহিষ্কার করে আইসিসি। পরের এক বছর তিনি দলের বাইরে। এই সময়ে বাংলাদেশ দলে অভিষেক হয়েছে হাসান মাহমুদ, মোহাম্মদ নাঈম, শরীফুল ইসলাম ও শামীম হোসেনের। এঁদের মধ্যে হাসান মাহমুদ ছাড়া জিম্বাবুয়ে সফরে আছেন বাকি তিনজনই। দলের আরও দুই তরুণ ক্রিকেটার আফিফ হোসেন এবং মেহেদী হাসানও এর আগে সাকিবের সঙ্গে খুব বেশি খেলার সুযোগ পাননি। দুজনই ২০১৮ সালে একটি করে সিরিজ খেলে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিলেন। এরপর তো এক বছরের জন্য সাকিবই দলের বাইরে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর পরও সাকিব তাই তাঁদের কাছে দূর আকাশের তারা হয়েই ছিলেন।

জিম্বাবুয়ে সফরে তরুণ ক্রিকেটারদের অনেক কাছে এসেছেন সাকিব।
ছবি: বিসিবি

সেই দূরের তারাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ এল এবারের জিম্বাবুয়ে সফরে। সাকিবেরও সুযোগ হলো তাঁদের সঙ্গে মেশার। জৈব সুরক্ষাবলয়ের ক্রিকেটের এই একটা সুবিধা। বাইরে বের হওয়া যায় না বলে হোটেলবন্দী জীবনে সতীর্থদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটে। গল্পে–আড্ডায় কমে আসে ছোট–বড়, তারকা–সাধারণের ব্যবধান। দূরের তারা সাকিবও এখন শামীম–নাঈমদের কাছে তাই ঘরের মানুষ।

পরশু দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টি ম্যাচের পর হারারে স্পোর্টস ক্লাবের ড্রেসিংরুমের সামনের দৃশ্য। সাকিবকে ঘিরে ছোটখাটো একটা আড্ডা জমে গেল। নাঈম, শামীম, আফিফ, নুরুল হাসান ও তাইজুল ইসলামের সঙ্গে আড্ডায় মধ্যমণি সাকিব। কখনো নিজে কিছু বলছেন, কখনো অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।

তরুণদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন সাকিব।
ছবি: শামসুল হক

এমনিতে দলের মধ্যে সাকিবের আড্ডাবাজ হিসেবে খ্যাতি নেই; যেটা ছিল মাশরাফির, আছে তামিমেরও। তারপরও তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে এই কম কথা বলা সাকিবেরই অন্য রকম একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিষয়টি যখন ক্রিকেটের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ, খেলাটিকে বোঝা এবং কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর প্রসঙ্গ—তখন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবের কথাই তাঁদের জন্য বেদবাক্য। স্বভাবগত কারণে সাকিব হয়তো কথা অল্পই বলেন, কিন্তু যেটা বলেন সেটাকেই মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছেন তরুণ সতীর্থরা। সাকিবের মানসিক শক্তি, স্রোতের প্রতিকূলে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহসিকতা তাঁদের কচি মস্তিষ্কে জোগায় বড় হওয়ার প্রণোদনা।

জাতীয় দলে আজ যাঁরা সাকিবের সতীর্থ, সেই নাঈম–শামীমরা তাঁর খেলা দেখেই বড় হয়েছেন। সাকিবকে আদর্শ মেনে সাকিবের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে করতেই আজ তাঁদের এই পর্যন্ত আসা। বিশ্বসেরাদের একজন হয়ে উঠতে সাকিবের সংকল্প আর পরিশ্রম তাঁদের জন্য ভবিষ্যতের পথনির্দেশিকা। নানা দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলে সাকিবের বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে মেশার গল্পগুলো তাঁদের কানে রূপকথার মতো শোনায়। দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টিতে আন্তর্জাতিক অভিষেক হওয়া শামীম হোসেন কাল বলছিলেন, ‘সাকিব ভাই আমার অনুপ্রেরণা। সব সময়ই চাইতাম, সাকিব ভাই থাকা অবস্থায় যেন আমি জাতীয় দলে খেলি। অভিষেক ম্যাচের ক্যাপটা যেন উনার কাছ থেকে পরতে পারি।’

সাকিব তরুণদের অনুপ্রেরণা
ছবি: প্রথম আলো

মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন যদিও সাকিবের সঙ্গে আগেও খেলেছেন, তবু দ্বিতীয় ওয়ানডে জয়ের পর তাঁর কথায়ও ফুটে উঠেছে সাকিবের সঙ্গে খেলার রোমাঞ্চ। সাকিবের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাবেন—এই স্বপ্ন নাকি তাঁর অনেক দিনের।

ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করে শামীম–সাইফউদ্দিনরা এখন স্বপ্নের নায়ক সাকিবেরই সতীর্থ। একসঙ্গে খেলছেন, একই টিম বাসে চড়ছেন, একই ড্রেসিংরুমে পাশাপাশি বসছেন, একই টিম মিটিংয়ে থাকছেন। হয়তো গায়ে চিমটি কেটে দেখছেনও, এসব স্বপ্ন নয়তো!

কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব এমনই এক চরিত্র, ‘সাকিব আল হাসান’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে তাঁর কীর্তির তালিকা যেমন সামনে আসে; প্রায় সমানভাবে ভেসে ওঠে তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক খবরের শিরোনামও। সাকিব স্বভাবে চুপচাপ, কথা কম বলেন, অল্পতে মেজাজ হারান—এসব কথাও এই তরুণেরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় দলে একই তাঁবুর নিচে আসার পর দলের এই ‘বড় ভাইটি’কে নিয়ে তাঁদের জল্পনাকল্পনার শেষ ছিল না।

জিম্বাবুয়ে সফরের এই কয়দিনে সব জল্পনাকল্পনাই উধাও। দূরের তারা সাকিব তাদের কাছে এখন ধরাধমেরই একজন রক্ত–মাংসের মানুষ। আর সেটি যেন সাকিবের জন্যও বড় পাওয়া। সেদিন গল্পের ছলেই এই প্রতিবেদককে সাকিব বলছিলেন, ‘আমি তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে মিশতে পারছি, ওরাও আমাকে পছন্দ করছে; এটা আমার জন্যও অনেক বড় পাওয়া।’