ধোনির কথায় বদলে যাওয়ার চেষ্টায় ‘দুর্ভাগা’ নুরুল

উইকেটকিপার আর প্রথম স্লিপের ক্যাচ প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। কিপিং করছেন নুরুল হাসান আর স্লিপে দাঁড়িয়ে লিটন দাস! এই ছবিটা কি কোনো বার্তা দেয়? গত বছর ভারত সফর থেকে টেস্টে নিয়মিত উইকেটকিপিং করছেন লিটন। শ্রীলঙ্কা সফর যদি হয়, তাহলে কি নুরুলকে নিয়ে নতুন চিন্তা আছে টিম ম্যানেজমেন্টের?

ধোনি নুরুলকে দিয়েছেন বদলে যাওয়ার বটিকা।
ছবি: টুইটার

দলীয় সূত্রে যা জানা যায়, তাতে বলাই যায়, এবারও নুরুলের বড় কোনো সুখবর নেই! থাকবে কী করে, দলে তিনজন উইকেটকিপিং অলরাউন্ডার আছেন মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস আর মোহাম্মদ মিঠুন। তিনজনই দলের ব্যাটিং লাইনআপে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে তাঁরা উইকেটকিপিংয়েও দক্ষ। মুশফিক, লিটন, মিঠুনের ভিড়ে নুরুলের সম্ভাবনা তাই নেই বললেই চলে। টিম ম্যানেজমেন্ট বরং তাঁকে বর্তমান করোনাপরিস্থিতিতে খুব 'ভালো বিকল্প' হিসেবে বিবেচনা করছে। মজাটা হচ্ছে, যদি টিম ম্যানেজমেন্টকে প্রশ্ন করা হয়, উল্লিখিত চার উইকেটকিপারের মধ্যে সবচেয়ে ভালো কিপিং করেন কে? নুরুলের নামটাই আগে আসবে নিশ্চিত।

তবুও মূল স্কোয়াডে নুরুলের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাটা কমে যায় অলরাউন্ডার প্রশ্নে। আধুনিক ক্রিকেটে শুধু উইকেটকিপার নিয়ে খেলতে চায় না বেশির ভাগ দলই। সব দলই এমন উইকেটকিপার নিতে চায়, যিনি ব্যাটিংও ভালো করতে পারবেন। নির্বাচক হাবিবুল বাশার বলছিলেন, 'মুশফিক-লিটন কিপিং করলে হয় কী, একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান বা বোলার নিয়ে খেলা যায়। সোহান (নুরুল) যে ব্যাটিংয়ে খারাপ, সেটিও বলা যাবে না। তবে তুলনা করলে ওর চেয়ে মুশফিক-লিটনকে এগিয়ে রাখতে হবে। শুধু কিপার হিসেবে সোহানকে এগিয়ে রাখা যায়। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট যে চায় কিপিং-অলরাউন্ডার।'

উইকেটরক্ষক হিসেবে জাতীয় দলে নুরুলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে
ছবি: শামসুল হক

নুরুল প্রথম বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছেন ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। মুশফিক-লিটন-মিঠুনের মতো উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানদের পেছনে ফেলে গত চার বছরে বাংলাদেশ দলে নিজের জায়গাটা পোক্ত করতে পারেননি তিনি। নুরুলের মতো চটপটে দারুণ এক উইকেটকিপারের জন্য কিছুটা খারাপও লাগে হাবিবুলের, 'ওই যে কথায় বলে না ভুল সময়ে আসা! সোহানের দুর্ভাগ্য, আমাদের একই সময়ে অনেক ভালো উইকেটকিপার এসেছে, যারা ব্যাটিংয়ে খুব ভালো। এখন আধুনিক ক্রিকেটে সবাই উইকেটকিপিংয়ের সঙ্গে ব্যাটিংও চায়। জাতীয় দলে নিয়মিত না হলেও তাকে আমরা উপেক্ষা করছি না। আমাদের সিস্টেমে সে আছে, ''এ'' দল বা এমন দলগুলোয় তাকে নিয়মিত সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।'

বাংলাদেশ দলে নিয়মিত সুযোগ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে অবশ্য নুরুলও খুব একটা চিন্তিত নন। তাঁর কথা হচ্ছে, 'সব সময়ই লক্ষ্য থাকে জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়া, সেটির জন্য শতভাগ দিয়েই চেষ্টা করি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজের প্রতি সৎ থাকা। যেখানেই খেলি নিজের সঙ্গে যেন অসততা না করি। অবশ্যই বাংলাদেশ দলে খেলা অনেক বড় গর্বের ব্যাপার। যদিও বাংলাদেশ দলে নাও খেলতে পারি তবুও সেটি নিয়ে হতাশ হই না। বাসার সামনে বাচ্চাদের সঙ্গে খেললেও সেখানে নিজর সেরাটা দেওয়ার মানসিকতা থাকে।'

জাতীয় দলে নিয়মিত হতে পারেননি নুরুল কখনোই।
ছবি: প্রথম আলো

জুলাইয়ে খুলনা শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে ব্যক্তিগত অনুশীলন শুরু করেছিলেন নুরুল। পরের মাসে চলে আসেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। মিরপুরে যাঁরা অনুশীলন করেছে বেশিরভাগই এগিয়েছেন শ্রীলঙ্কা সিরিজ সামনে রেখে। নুরুলের অবশ্য বাংলাদেশ দলে সুযোগ পাওয়ার ভাবনাটা কাজ করেনি। তিনি ভালো করেই জানেন, মিরপুরের অনুশীলনে খেলোয়াড় সংখ্যা বেশি, মাঠে কিংবা জিমে সময় খুব বেশি বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। তবুও মিরপুরে চলে আসা কারণটা কী, সেটি বলছিলেন নুরুল, 'হাই-ইনটেনসিটি প্র্যাকটিস কিংবা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে অনুশীলন করার লক্ষ্যে ঢাকায় চলে আসা। মিরপুরে সময় কম পেলেও এখানে ইনটেনসিটি বেশি। খুলনায় থাকতে এটাই মনে হচ্ছিল। মিরপুরে সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে সবকিছুই বেশি।'

বাংলাদেশ দলের নিয়মিত খেলোয়াড়দের ভিড়ে নুরুলের এই চেষ্টাটাই বিশেষ নজর কেড়েছে গত দুই মাসে। তিনি ভালো করেই জানেন, বর্তমান টেস্ট দলে তাঁর সুযোগ পাওয়া কতটা কঠিন। আর চাইলেই শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ইনডোর কিংবা মাঝ উইকেটে অনুশীলনের সুযোগ মেলে না। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটা আরও কঠিন। অনুশীলনে বিসিবি তাঁদেরই অগ্রাধিকার দিয়েছে যাঁদের নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা আছে। তার মানে নুরুলকে নিয়ে আছে। সে কারণেই তাঁকে ২৭ জনের প্রাথমিক দলে সুযোগ দিয়ে জৈব সুরক্ষা বলয়ে রাখা।

টিকে থাকতে নুরুলকে লড়ে যেতে হয় নিরন্তর।
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার সুরক্ষা বলয়ে থাকলেও কলম্বোগামী ফ্লাইটে (যদি সফরটা হয়) তাঁর ওঠা হবে কিনা, সেটি জানা যাবে শিগগির। তবে নুরুল এত কিছু ভাবতে চান না। তিনি মনোযোগী নিজের কাজটা নিয়ে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে গিয়ে মাহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে নুরুলের দেখা হওয়ার ঘটনাটা নিশ্চয়ই জানা। ভালো ফিনিশার হতে কী করণীয়, নুরুলকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন ধোনি। সাবেক ভারতীয় অধিনায়কের পরামর্শ গত তিন বছরে কতটা কাজে লাগিয়েছেন, সেটিই বলছিলেন নুরুল, 'ধোনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতে মানসিকভাবে কীভাবে সে তৈরি থাকে। সে একটা কথাই বলছিল, নিজের শক্তির ওপর আস্থা রাখা। যদি ৮-১০টা বল পাও, ওই আত্মবিশ্বাস রাখা যেন শুরুতে ঝুঁকি না নিয়ে শেষ ২-৩ বলে স্ট্রাইকরেট দ্বিগুণ করে ফেলা যায়। শুরুতে নিজের মতো খেলা, নিজের শক্তির ওপর ভরসা করা। ওর কথা থেকে আমার ভাবনাটা বদলেছে। আগে ভাবতাম যেয়েই মারতে হবে। একটা বলও মিস করা যাবে না! এখন সেটা বেশ বদলেছে। ফিনিশিংয়ে ভূমিকা ঠিক রাখতে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।'

নুরুলের লক্ষ্য নিজেকে দুর্দান্ত এক ফিনিশার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। গত মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে এই লক্ষ্যে বেশ কিছু দূর এগিয়েছেনও। গত অক্টোবর-নভেম্বরে জাতীয় লিগে যে তিনটি বড় ইনিংস খেলেছিলেন প্রতিটিতেই ছিলেন অপরাজিত। ঢাকার বিপক্ষে ১৫০* ও ৬১*, রাজশাহীর বিপক্ষে ৯৭* রানের ইনিংস বলে দিচ্ছে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার কাজটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করছেন। গত বিপিএলে অপরাজিত থেকেছেন ছয় ইনিংসে। নুরুলের ইনিংস শেষ পর্যন্ত লম্বা করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে সর্বশেষ বিসিএলেও, পূর্বাঞ্চলের বিপক্ষে দক্ষিণাঞ্চল ৬১ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও দলকে তিনি ভালো স্কোর এনে দিয়েছেন ১৫৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে।

কোচ ডমিঙ্গোর ভাবনায় তিনি আছেন ‘ভালো বিকল্প’ হিসেবেই
ছবি: প্রথম আলো

নিজের এই চেষ্টা নিয়ে নুরুল বলছিলেন, ‘গত এক বছরে যত লিগ-টুর্নামেন্ট খেলেছি, বেশির ভাগ ইনিংসে চেষ্টা করেছি যেন শেষ পর্যন্ত খেলে আসতে পারি। পাঁচ-ছয়ে নামা একজন ব্যাটসম্যানের কাজই থাকে শেষ করে আসা। নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে কার্যকর কিছু জুটি গড়া। যখন আপনি ৬-৭ নম্বরে ব্যাটিং করবেন নিচের দিকের ব্যাটসম্যানের সঙ্গে ৪০-৫০ রানের জুটি গড়তে পারলে অনেক সময় ম্যাচের চেহারা বদলে যায়। শেষ করে আসার মানসিকতাই তৈরি করছি।'

জাতীয় দলের নিয়মিত সুযোগ পাওয়ার লক্ষ্যেই নিজেকে দুর্দান্ত ফিনিশার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নুরুল। তবুও যদি না খোলে বাংলাদেশ দলের দরজা, সেটি নিয়েও খুব বেশি ভাবতে চান না ২৬ বছর বয়সী উইকেটকিপার, ‘একটা সময় এটা খুব কাজ করত (বাংলাদেশ দলে সুযোগ না পাওয়ার হতাশা)। পরে ভাবলাম নিজের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হলে সেটির প্রভাব ঘরোয়া ক্রিকেটেও পড়বে। নিজেকে উদ্বুদ্ধ করি এভাবেই, নিজের প্রতি সৎ থাকা। যেখানেই খেলি না কেন শতভাগ চেষ্টা করব। কোথায় খেলছি, এটা নিয়ে বেশি ভাবলে সব ক্রিকেটে এটার প্রভাব পড়বে।’