'নিচুমনা'দের চূড়ায় থাকার দিনগুলো

প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ম্যাকগ্রার সে রসিকতা। ফাইল ছবি
প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ম্যাকগ্রার সে রসিকতা। ফাইল ছবি

ক্রিকেট মাঠে লাল কার্ড?

অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা নয়। ক্রিকেট অনুসারীদের খুব প্রিয় এক দৃশ্যই এটি। আম্পায়ারিংয়ের মতো আপাত একঘেয়ে কাজটাতেও বিনোদন খুঁজে নিতেন বিলি বাউডেন। নিউজিল্যান্ডের এই আম্পায়ারের সুবাদে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটে দেখা গেল ফুটবলের সে আতংকের দৃশ্য। পকেটে হাত দিচ্ছেন ম্যাচ অফিশিয়াল, আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছেন অপরাধী খেলোয়াড়—'এই যা সব শেষ হলো বুঝি!' পকেট থেকে বের হয় লাল রঙা এক কার্ড। সেদিনের জন্য খেলা সাঙ্গ হয় খেলোয়াড়ের।

ক্রিকেটে এমনটা দেখা গেছে ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমে যা ইচ্ছা তা করছিলেন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা। কেউ নকল গোফ লাগিয়ে নেমেছেন, কেউবা বিশাল উইগ পরে। ইচ্ছেমতো কিউই বোলারদের পিটিয়ে ২ রানের আক্ষেপে পুড়েছেন রিকি পন্টিং। ম্যাচের শেষ বলে ৪৫ রান দরকার ছিল নিউজিল্যান্ডের। এমন অবস্থায় স্পিনার হওয়ার সাধ জাগল গ্লেন ম্যাকগার।

ওতেও আপত্তি করেননি বাউডেন। কিন্তু ম্যাকগ্রা কিনা হেঁটে এসে নিচু হয়ে গড়িয়ে বল ছাড়তে চাইলেন, মানে আন্ডারআর্ম বোলিং। ব্যাটিংয়ে থাকা কাইল মিলসও মাটিতে ব্যাট পেতে রাখলেন সে বল থেকে বাঁচতে। বাউডেন ছুটে এসে সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন ম্যাকগ্রাকে। এ ঘটনায় হাসছেন দেখে নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকা ড্যারেল টাফিকেও দেখানো হলো লাল কার্ড। টি-টোয়েন্টি নামের 'পপকর্ন ক্রিকেটে' সেদিন এভাবেই ফুর্তিতে মেতেছিলেন সবাই।

ম্যাকগ্রার এই চেষ্টার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সর্বশেষ আন্ডারআর্ম বোলিং যেদিন দেখেছিল, খেলোয়াড়, দর্শকদের অনুভূতি ছিল পুরো উল্টো। ১৯৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এমনই এক তাসমান-দ্বৈরথে শেষ বলে ৬ রান দরকার ছিল নিউজিল্যান্ডের। অধিনায়ক ও বড় ভাই গ্রেগ চ্যাপেলের বুদ্ধিতে বোলিংয়ে থাকা ট্রেভর চ্যাপেল বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে পাঠালেন ব্রায়ান ম্যাকক্যাকনির দিকে। হতভম্ব ম্যাকক্যাকনি সেটা ঠেকিয়ে রাগে ক্ষোভে ব্যাট ছুড়ে মেরেছিলেন। ভদ্রলোকের খেলায় ক্রিকেটীয় চেতনা নষ্ট করায় ইয়ান চ্যাপেল অনুজ গ্রেগকে পরদিন পত্রিকায় ধুয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাবেক কোচ ট্রেভরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার লম্বা না হওয়ার পেছনে এ ঘটনা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। তখনো পর্যন্ত আইনসিদ্ধ আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের কবর খোড়া হয়ে যায় সেদিনই। চিরতরে নিষিদ্ধ হয় গড়িয়ে বল করার চেষ্টা।

ট্রেভর চ্যাপেলের সে কলঙ্ক। ফাইল ছবি
ট্রেভর চ্যাপেলের সে কলঙ্ক। ফাইল ছবি

অথচ একসময় গড়িয়ে বল করাটাই শিল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। গতি আর নিয়ন্ত্রণের মিশেল ঠিক রেখে যারা এভাবে বল করতে পারতেন, আদর করে তাদের একটা নাম দেওয়াও হয়েছিল—"লবস্টার"! ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবেদনকে সাহিত্যে রূপ দেওয়া নেভিল কার্ডাস তো এর সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন। ক্রিকেটে উত্তেজনা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্ডার আর্ম বোলিংয়ের রীতিমতো ওকালতি করতেন কার্ডাস।
১৯২৪ সালে সাসেক্সের সবচেয়ে বিখ্যাত আন্ডার আর্ম বোলার ওয়াল্টার হামফ্রের মৃত্যুর পর কার্ডাস লিখেছিলেন, 'কোনো সন্দেহ নেই, রাস্তার মানুষ “লব”দের কথা শুনলেই হাসে। সে নিজে অবশ্য বলত “গ্রাবস।'' কিন্তু ব্যাটসম্যানদের যুগে হামফ্রের এই শিল্প যে সাফল্য এনে দিয়েছে, তা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।'

হামফ্রে শুধু নিজেই আন্ডার আর্ম বোলিং করতেন, এমনটা নয়। 'লবস্টার' শ্রেণিতে লোক বাড়ানোর কাজটাও বুঝে নিয়েছিলেন। সব ধরণের বোলিংয়ের মতো আন্ডারআর্ম বোলিংও শিল্প হিসেবে ধরা হতো তখন। গড়িয়ে বল করার দক্ষতা নিঁখুত করতে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম করতেন লবস্টাররা। হামফ্রের সহযোগিতাতেই জর্জ সিম্পসন–হেওয়ার্ড সর্বকালের সেরা 'আধুনিক' (সে যুগের) লব বোলার হয়েছিলেন। তিন বছর টানা অনুশীলন করে তবেই প্রথমবারের মতো কোনো ম্যাচে আন্ডারআর্ম বোলিং করেছিলেন হেওয়ার্ড। ইংল্যান্ড দলে জায়গা পেতেও সময় লাগেনি।

১৯১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে অভিষেকে যখন বল করেছিলেন হেওয়ার্ড, পুরো স্টেডিয়ামে হাসির শব্দে কান পাতা যাচ্ছিল না। তবে সে হাসি থামতে সময় লাগেনি। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৬ ওভার বল করে ৪৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন এই লব বোলার। মানুষ অবশ্য এই বোলিংকে নিচু মানসিকতা হিসেবেই দেখত। এ ধরণের বোলারদের দলে জায়গা পাওয়াও তাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। যদিও কার্ডাসের চোখে এটাই বাড়তি সুবিধা, 'একজন ব্যাটসম্যান একজন লব বোলারের বিপক্ষে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কারণ, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজেকে অপমান করা।'

সাসেক্সের হয়ে সবচেয়ে সফল আন্ডার আর্ম বোলার ছিলেন হামফ্রে। ফাইল ছবি
সাসেক্সের হয়ে সবচেয়ে সফল আন্ডার আর্ম বোলার ছিলেন হামফ্রে। ফাইল ছবি

ট্রেভর কিংবা গ্রেগ চ্যাপেলদের যুগে আন্ডার আর্ম বোলিং ছিল শুধুই নেতিবাচক ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন। ব্যাটসম্যানকে রান নিতে না দেওয়ার চেষ্টার ফল। কিন্তু কার্ডাসের সময়টায় লবস্টাররা ছিলেন ভিন্ন কিছু। সে সময় রান আটকানোর চেয়েও উইকেট তুলে নেওয়ার জন্যই লবস্টারদের কদর ছিল। ক্রিকেটের প্রথম দিকটায় এভাবেই বল করতেন সবাই। এভাবে বল করলে স্পিনে বৈচিত্র আনা যেত বেশি। কিন্তু রাউন্ডআর্ম ও ওভারআর্ম বোলিং চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে লবস্টাররা হারিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এ কারণেই কার্ডাস চাইতেন এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা হোক। তাঁর মনে হয়েছিল, যেহেতু সবাই এ বোলিংকে ঘৃণার চোখে দেখে, কেউই আর এমন বল খেলতে অভ্যস্ত নয়। ফলে এমন একজন দলে থাকলে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলা যায়, 'সব দেশের উচিত লব বোলারদের উৎসাহ দেওয়া।'

অবহেলা ও ঘৃণা আন্ডার আর্ম বোলিংকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। প্রথম দিককার অনেক গুণও তাই হারিয়ে ফেলেছিল এ শিল্প। এ কারণে ট্রেভর চ্যাপেলের বলটি কোনোমতে উইকেট পার হয়েছিল গড়িয়ে গড়িয়ে। অথচ এক সময় লবস্টাররা রীতিমতো গতির ঝড় তুলতেন। ১৮ শতকের শেষ দিকে এ কারণে বিখ্যাত ছিলেন ডেভিড হ্যারিস। তবে আন্ডার আর্ম বোলিংয়ে গতি আর আতংক নিয়ে কোনো মিথ থাকলে সেটা জর্জ ব্রাউনের।

কখনো টেস্ট খেলেননি। টেস্ট ক্রিকেটের জন্মের ২০ বছর আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। তবু হ্যাম্পশায়ার ও সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা এই ফাস্ট বোলারকে ক্রিকেট ভোলেনি। বলা হয় ১৭ সন্তানের জনক ব্রাউনের বলের গতি এত বেশি ছিল যে 'লংস্টপ' হিসেবে দুজন ফিল্ডার রাখতে হতো। 'লংস্টপ' কী একটু বুঝিয়ে বলা যাক। আধুনিক ক্রিকেট ফাইন লেগ বা থার্ড ম্যানের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সরাসরি উইকেটরক্ষকের পেছনে সীমানা দড়িতেও যে ফিল্ডার রাখা যায় এবং সে ফিল্ডিং পজিশনেরও যে একটা নাম আছে, সেটা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। রান আটকাতেই একজন লং স্টপ থাকত ফিল্ডিংয়ে। কিন্তু ব্রাউনের জন্য দুজন রাখা হতো। ডেঞ্চ নামের একজন নিয়মিতই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতেন। ডেঞ্চ দাবি করেছিলেন, ব্রাউনের গোলা থেকে রক্ষা পেতে বুকে খড় বেঁধে ফিল্ডিংয়ে যেতেন তিনি।

ব্রাউন সম্পর্কিত সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি অবশ্য মর্মান্তিক। একবার নাকি ব্রাউন এতটাই জোরে বল করেছিলেন যে, সে বল লং স্টপের ফিল্ডার হাতে থাকা কোট দিয়েও আটকাতে পারেননি। বরং কোটের পেছনে থাকা এক হতাভাগা কুকুরের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল সে বল। ইংলিশ অলরাউন্ডার ও আরেক লবস্টার এডওয়ার্ড বাড অবশ্য দাবি করেছিলেন, ব্রাউনের মতোই গতিময় ছিলেন ওয়াল্টার মারকন। কিন্তু অস্কফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই বোলার আন্ডারআর্ম বোলিং করতেন না। মারকনের ভঙ্গি ছিল জেফ টমসন কিংবা লাসিথ মালিঙ্গাদের মতো রাউন্ডআর্ম। আর তাঁর বোলিংয়ে কোনো কুকুরের মৃত্যুর কোনো খবর কখনো জানা যায়নি বলে কিংবদন্তিও হতে পারেননি।

আন্ডারআর্ম বোলারদের গুরুত্ব কমতে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে তো খুঁজেই পাওয়া যেত না লবস্টারদের। নিজের লেখায় বারবার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার আহবান জানিয়েছেন কার্ডাস। কারণ, লবস্টারদের কারণে ব্যাটসম্যান যে অস্বস্তিবোধ করত, তাতে দর্শক বাড়তি মজা পেতেন। খেলাটার বৈচিত্র ও আকর্ষণ বাড়াতেই লবস্টারদের টিকিয়ে রাখতে বলেছিলেন কার্ডাস। কিন্তু ক্রিকেটীয় চেতনার সঙ্গে না যাওয়া এই বোলিংটার হারিয়ে যাওয়া আটকাতে পারেননি এই কিংবদন্তি। ১৯২১ সালে সর্বশেষ কোনো লবস্টার পেয়েছিল ক্রিকেট। জ্যাক হবসকে আউট করে আলোচনায় আসা ট্রেভর মোলোনির প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার সে বছরই শেষ। মাত্র ৩ ম্যাচ আর ৪ উইকেটে থেমেছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের সর্বশেষ লবস্টার বোলারের ক্যারিয়ার।

গত এক শ বছরে তাদের আর ফিরে পায়নি ক্রিকেট। গ্রেগ ও ট্রেভর চ্যাপেলের ম্যাচ জেতার নেশা লবস্টারদের ফিরে আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছে চিরতরে।