পরিচয় বদলানোয় ক্ষতি হবে না তো সৌম্যর?

সৌম্যকে অর্ডারে নিচে নামিয়ে খেলানোর পরিকল্পনা বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর।ছবি: প্রথম আলো

খালেদ আহমেদ বাউন্সার মারার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বলগুলো খুব বেশি উঁচুতে উঠছিল না। অপর প্রান্তে থাকা সৌম্য সরকারের কোমর বরাবর আসা বলটি সৌম্য সরে গিয়ে পুল করলেন। বল গেল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির দোতলায়।

নেটের পাশেই দাঁড়িয়ে সৌম্যর বিশাল ছক্কা দেখছিলেন প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। যিনি একটু আগেই সৌম্যকে ওপেনার থেকে সরিয়ে ফিনিশারের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা সংবাদ সম্মেলনে দিয়ে এসেছেন, তিনি চান সৌম্য এমন বিশাল ছক্কাগুলো ইনিংসের শেষে এসে মারুক। দলের রান বাড়ুক।

নিচে ব্যাটিং করলে কিছু ওভার বোলিংও করতে হবে। সেটিও করুক সৌম্য। দুই দায়িত্ব পালন করে টিকে থাকুক সাদা বলের একাদশে। ওপেনিংয়ে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে লিটন দাসের জায়গাটা পাকা। তিনে সাকিব আল হাসান খেলতে চান। কিন্তু ফর্মে থাকা তরুণ ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেনকে তৈরি করতে হবে। তাই তিন নম্বর জায়গাটা দেওয়া হচ্ছে নাজমুলকে। চার, পাঁচ, ছয়ে সাকিব, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ খেলবেন। সৌম্যর জায়গা তাহলে সাত নম্বরে।

সৌম্যর দারুণ সব ইনিংসগুলো সব টপ অর্ডারে ব্যাটিং করেই।
ছবি: প্রথম আলো

আপাতত বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের সেরা সাত ব্যাটসম্যানের তালিকাটা এমনই। কাল প্রধান কোচ ডমিঙ্গোর কথায় ছিল সৌম্যবিহীন টপ অর্ডারের ইঙ্গিত, ‘এ মুহূর্তে টপ অর্ডার প্রায় স্থিতিশীল। তামিম ও লিটন আছে। আমরা সৌম্যকে মিডল অর্ডারে দেখতে চাই। আমরা একজন পাওয়ার হিটার খুঁজছি, যে কিনা ইনিংসের শেষে দ্রুত রান তুলতে পারবে। কিছু ওভার বোলিংও করতে পারবে। বিশ্বকাপের আগে যেন আমরা সবাইকে বিভিন্ন দায়িত্বে খেলিয়ে দেখতে পারি কে কেমন করে। এই মুহূর্তে আমরা মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে সৌম্যকে ইনিংস শেষ করে আসছে, এটা দেখতে চাই। তার অভিজ্ঞতা আছে। সে পরিষ্কার হিটার। তার ব্যাটিংয়ে আমার অনেক আস্থা।’

এই দায়িত্বে যে সৌম্যকে লম্বা সময়ের জন্য দেওয়া হচ্ছে, সেটি বোঝা যায় ডমিঙ্গোর পরের কথায়, ‘৬, ৭ নম্বর পজিশনে খেলা কঠিন দায়িত্ব। মাঝেমধ্যে আপনার প্রতি ওভারে ১০ করে রান দরকার আর তখনই আপনি একটি ভালো বলে আউট হলেন। মাঝেমধ্যে আপনাকে ৫০ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ব্যাটিংয়ে যেতে হবে। আর তখনই ভালো একটা বলে আউট হয়ে যেতে পারেন। পরিস্থিতিটা কঠিন। তবে ধৈর্য ধরতে হবে।’

সৌম্যকে এমন দায়িত্ব দেওয়া কিন্তু মোটেও নতুন কিছু না। এর আগে তিন ইনিংসে সৌম্য খেলেছেন মিডল অর্ডারে। তিন ইনিংসেই সেবার তিনি ছিলেন ব্যর্থ। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে সাত নম্বরে নামানো হয় সৌম্যকে। সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল, সেটি ঠিক পরের ওয়ানডে ম্যাচেই প্রমাণ করেন এই বাঁহাতি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনে নেমে করেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি।

ডমিঙ্গো সৌম্যকে দিতে চান ‘ফিনিশার’ এর দায়িত্ব।
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের পরের ওয়ানডে সিরিজটা ছিল আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সেঞ্চুরি করা সৌম্য সেই সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে ব্যাটিং করেন ছয় ও সাত নম্বরে। দুই ম্যাচের একটিতেও তিনি রান পাননি। তৃতীয় ম্যাচে আবার তিনে সুযোগ পান। ৮১ বলে ৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে সেই ম্যাচে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতান সৌম্য।

এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে তিনটি ওয়ানডেতে ব্যর্থ হন। কিন্তু সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে পেয়ে তিন ম্যাচে তিনটি ফিফটি করেন সৌম্য। সব কটিই আসে টপ অর্ডারে ব্যাটিং করে। একই ছন্দ ধরে রাখেন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ওপেনিংয়ে নেমে ৪২ রান করেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপজুড়ে ভালো শুরু পেলেও সৌম্যর ব্যাট থেকে বড় ইনিংস আসেনি। তবে তাঁর শেষ ওয়ানডে ইনিংসটি ৬৯ রানের, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে।

নিচে যেহেতু খেলবেন, তাই তাঁর কাছ থেকে মিডিয়াম পেস বোলিংটাও চায় বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট।
ছবি: প্রথম আলো

সৌম্য নিচে খেললে এখন সেই শুরুর ঝড়টা কে তুলবে, সেটিই দেখার বিষয়। ৫৫ ওয়ানডের ছোট্ট ক্যারিয়ারে সৌম্যর অর্জন ২ সেঞ্চুরি ও ১১ ফিফটি। এর মধ্যে ১০ ম্যাচেই বাংলাদেশ জয়ের মুখ দেখেছে। সৌম্যর রান করা মানেই যেন বাংলাদেশের জয়। এর মূল কারণ তাঁর স্ট্রাইক রেট। এই বাঁহাতি যেদিন রান করেন সেদিনই ঝড়ের গতিতে রান করেন। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র সৌম্যর ওয়ানডে স্ট্রাইক রেট এক শ ছুঁই ছুঁই (৯৮.৫৮)। লিটন দাস তাঁর পরেই (৯৫.২৩)। তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ এমনকি তরুণ নাজমুল হোসেনের স্ট্রাইক রেটও ৮০-র আশপাশে।

হুট করেই সেই এক, দুই ও তিন নম্বরের আদর্শ ব্যাটসম্যান সৌম্যকে দেওয়া হচ্ছে ফিনিশারের দায়িত্ব। কে জানে, এই নতুন দায়িত্ব ও এর চাহিদার দাবি মেটাতে আবার সৌম্যর সহজাত ব্যাটিংটাই না হারিয়ে যায়! ওপেনার হিসেবে শুরুতে ১০টি বল দেখে খেলার সুযোগ থাকে। থিতু হলে বড় ইনিংস খেলার সুযোগ থাকে। নিজের দিনে প্রতিপক্ষের সেরা বোলারদের দুমড়েমুচড়ে ফেলার সামর্থ্য যিনি রাখেন, তাকেই তো সবচেয়ে বেশি বল খেলতে দেওয়া উচিত। অযথা উইকেটে পড়ে থাকার ব্যাটসম্যান সৌম্য নন। নিজের দিনে হয় প্রতিপক্ষের ঘুম হারাম করবেন, না হয় আউট হয়ে সাজঘরে ফিরবেন। সৌম্যর স্ট্রাইক রেট তার প্রমাণ।

ফিনিশার হলে গল্পটা ভিন্ন। নিজের ব্যাটিং কম, হিটিং নিয়ে বেশি ভাবতে হবে সৌম্যকে। যে সৌম্য চোখধাঁধানো ক্রিকেটীয় শটে চার-ছক্কা বের করতে পারেন, যিনি টাইমিংয়ে বাউন্ডারি ছাড়া করতে পারেন, তাকেই পেশির জোরে ছক্কা মারার অনুশীলন করতে হবে। রেঞ্জ হিটিং অনুশীলন করতে হবে। নিজের ব্যাটিংয়ে যোগ করতে হবে ১০ বলে ৩০ রান করার সামর্থ্য। সঙ্গে বোলিং নিয়েও ভাবতে হবে। সাতে ব্যাটিং করলে সৌম্যর কাছে যেকোনো অধিনায়ক কয়েক ওভার বোলিং চাইবেন।

সৌম্য প্রস্তুতও হচ্ছেন সেভাবে। জাতীয় দলের অনুশীলনে আজকাল ব্যাটিংয়ের আগে বোলিংটা করতে দেখা যায় এই বাঁহাতিকে। টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে আর ব্যাটিং করা হয় না তাঁর। মেহেদী হাসান, আফিফ হোসেনদের সঙ্গে ব্যাটিং অনুশীলনে নামেন। যেন নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলার মিশনে এর মধ্যেই নেমে গেছেন সৌম্য।

অথচ এই সৌম্যই ওপেনিংয়ে নেমে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে করেছিলেন ২০০ রান। ছন্দময় সৌম্য যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪০ ওভার খেলে ফেলেন, কে জানে, হয়তো ওয়ানডেতেও প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করার সামর্থ্যটা সৌম্যরই আছে। ফিনিশারের দায়িত্ব সেই সৌম্যকে কি এলোমেলো করে দেবে না?

এমন উদাহরণ কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে যথেষ্টই আছে।