‘পাওয়ার হিটার’ কীভাবে পেতে পারে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন বহুদিন ধরেইছবি: রয়টার্স

‘আমাদের দলে পাওয়ার হিটার নেই’—বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে নামলেই এটি নিয়ে আক্ষেপ হয়। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চোখে আঙুল দিয়েই যেন দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ দলে কথায় কথায় চার–ছক্কা মারার ব্যাটসম্যান নেই। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভালো করতে যে দলের এ ধরনের ব্যাটসম্যানের প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ এখন কীভাবে পেতে পারে ‘পাওয়ার হিটার’। এটা কি তৈরি করা যায়?

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও হালে নির্বাচক হাবিবুল বাশার কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, এ সংস্করণে ভালো করতে হলে বাংলাদেশ দলের পাওয়ারপ্লে ব্যাটিংয়ে উন্নতি ঘটাতে হবে। তিনিও লেট মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে পাওয়ার হিটার না থাকার আক্ষেপ শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অন্য দলে এমন ব্যাটসম্যান আছেন, যাঁরা মাঠের চারদিকে মেরে খেলতে পারেন। যদি প্রয়োজনীয় রানরেট ১০-১২–ও হয়ে যায়, তবু তাঁরা মেরে সেই রান তুলে নিতে পারেন।

মাহমুদউল্লাহ বলেছেন, শামীমও পাওয়ার হিটার নন
ছবি: এএফপি

কেবল এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই নয়, বেশ আগে থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেছে বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য। চার-ছক্কা মারার ব্যাটসম্যান যেহেতু দলে নেই, তাই এ সংস্করণে কখনোই ভালো করতে পারে না বাংলাদেশ।

‘পাওয়ার হিটার’ কীভাবে বের করা যাবে—এ প্রশ্নের উত্তরও সেদিন হাবিবুল দিয়েছিলেন। তাঁর কথা একটাই—‘দেশে ভালো উইকেট তৈরি করতে হবে, সেটি বিপিএলই হোক কিংবা অন্য কোনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। আমরা দেশে সাধারণত ভালো উইকেট পাই না। প্রচুর ম্যাচ হয় প্রায় একই উইকেটে। ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও আমরা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হোম কন্ডিশনের সুবিধা পেতে চাই।’

হাবিবুল স্পষ্ট করে না বললেও তিনি যে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের কথা বুঝিয়েছেন, এটা না বললেও চলছে। তিনি ‘হোম কন্ডিশন’–এর কথা বলেও অনেক কিছুই বলে দিয়েছেন। বিশ্বকাপের ঠিক আগে মিরপুরের উইকেটে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির দলকে পেয়ে আমরা সিরিজ জিতেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড দলও ভড়কে গিয়েছিল মিরপুরের উইকেট দেখে। সরাসরি না বললেও তাদের ক্রিকেটাররা আকারে-ইঙ্গিতে সমালোচনা করে গেছেন।

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের উইকেট পাওয়ার হিটার সৃষ্টি হতে দিচ্ছে না?
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

‘পাওয়ার হিটার নেই’ বলে যে আক্ষেপ আমাদের, সেটি কেন, সে উত্তর খুঁজে নিতে খুব বড় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। এটা পরিষ্কার যে ক্রমাগত বাজে উইকেটে খেলতে খেলতে আমাদের ব্যাটসম্যানদের এমন অভ্যাস দাঁড়িয়েছে যে তাঁরা এখন মেরে খেলতেই ভয় পান। এই ভয়, শঙ্কা তাঁদের ভেতরে–ভেতরে এমনভাবে কুঁকড়ে রেখেছে, যেটির বাজে প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। আমাদের ক্রিকেটারদের অবস্থা অনেকটা সারা বছর প্রশ্ন ফাঁস করে পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রদের মতো। পরীক্ষায় কী আসছে, আগে থেকেই তারা জেনে যায়। সে কারণে আরও বিস্তৃত পরিসরে পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করে না তারা। হঠাৎই যদি তাদের প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষায় বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা হোঁচট খায় স্বাভাবিক নিয়মেই।

ছক্কা-চার মারার ব্যাটসম্যান শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করা যায় না। এমন কিছু সম্ভব নয়। তথাকথিত পাওয়ার হিটিংও বিশেষ কোনো বিষয় নয়, যেটি ব্যাটসম্যানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। চার-ছক্কা সবাই মারতে পারেন, দলের প্রয়োজন বুঝে মারতে পারা, বলেকয়ে মারতে পারাই আসলে সেই তথাকথিত পাওয়ার হিটিং।

অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে মিরপুরের উইকেটে হারিয়ে আদতে কোনো লাভ হয়নি বাংলাদেশের
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এমন ব্যাটসম্যান তৈরি হবে তখনই, যখন কেউ নিয়মিত ভালো উইকেটে ব্যাটিংয়ের চর্চাটা করে যাবে দিনের পর দিন। ঘরোয়া ক্রিকেটে সে ধরনের উইকেটে খেলে খেলে হাত পাকিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বজায় রাখবে সেই ধারা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও ছক্কা মারতে পারেন। হ্যাঁ, তাঁরা হয়তো কেউই ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল কিংবা কাইরন পোলার্ড নন, কিন্তু অতীতের কত ম্যাচেই তো চার-ছক্কার ফুলঝুরি দেখা গেছে তাঁদের ব্যাটিংয়ে। হঠাৎ কেন তাঁরা ব্যাটিংটা বেমালুম ভুলে গেলেন।

মোহাম্মদ নাঈমের অভিষেকলগ্নের কথা মনে আছে? ২০১৯ সালে ভারতের মাটিতে কী অসাধারণ অভিষেকটাই না হয়েছিল নাঈমের! নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি করেছিলেন ৪৮ বলে ৮১। স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬৮!
অনেকেই বলতে পারেন, দুই বছর আগে নাঈমের এই ইনিংসের কথা এখানে কেন আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এ কারণেই যে এই নাঈমই এখন মারা ভুলে গেছেন। তিনি এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুটি ফিফটি পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ব্যাটে ওই ধরনের কোনো আগুন নেই। এটা কেন!

গতিতে এখনো সমস্যা হয় বাংলাদেশের
ছবি: এএফপি

এর একটাই কারণ, নাঈম নাগপুরের মতো উইকেটে এরপর আর কখনোই খেলতে পারেননি। মিরপুরের ওই কালো মাটির ১২০-১৩০ ধরনের উইকেটে খেলতে খেলতে ব্যাটিংয়ের দ্যুতিটাই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।

কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লিটন দাস একটা অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগটা ছিল মিরপুরের একাডেমিতেও নাকি তাঁদের বাজে উইকেটে ব্যাটিং অনুশীলন করতে হয়। অনুশীলনেই যদি বাজে উইকেট পান, খেলার অভ্যাসের মধ্যেও অনুশীলনের ধারাটা চলে আসে। আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করছে ঘরের মাঠের উইকেট।

২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। যুব দলকে নাকি সেই সময় মিরপুরের একাডেমিতে অনুশীলনই করানো হয়নি। চট্টগ্রামে, বগুড়ায় ভালো উইকেটে অনুশীলন করেই দক্ষিণ আফ্রিকায় সাফল্য পেয়েছিল তারা। এরপর সেই বিশ্বজয়ী যুব দলের কয়জন ক্রিকেটারকে ব্যাটে-বলে আলো ছড়াতে দেখা গেছে?

গতি ও বাউন্সে দুর্বলতা আবার টের পাওয়া গেছে বিশ্বকাপে
ছবি: রয়টার্স

হাবিবুল স্বীকার করেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো উইকেট না থাকার কারণেই পাওয়ার হিটার পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এটাই আসলে সমস্যা। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল কিংবা বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান—এঁরা কেউই তথাকথিত পাওয়ার হিটার নন। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, অ্যারন ফিঞ্চকে কি পাওয়ার হিটার বলা যায়।

তাঁরা কেউই গেইল-রাসেল-পোলার্ডদের মতো দৈত্যকায় নন। কেবল দক্ষতা বাড়িয়েই তাঁরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রাজত্ব করছেন। তাঁরা সবাই যে উইকেটে খেলে দক্ষতা বাড়ান, সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে স্বপ্ন। পার্থক্যটা এ জায়গাতেই। এমনকি স্কটল্যান্ড, নামিবিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ডের মতো দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যে ইতিবাচক দেখা যায়, সেটি ভালো উইকেটেরই ফসল।

সমস্যা চিহ্নিত। এখন সমাধানযাত্রাটা শুরু করতে হবে ক্রিকেট বোর্ডকেই। তারা কি সেটি করবে?