প্রসঙ্গ সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসানপ্রথম আলো

অক্টোবর ২০১৬। টেস্টে ১৫০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়ার পর আরও ৪ উইকেট নিলেন সাকিব আল হাসান। ১৫তম বারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট। ছাড়িয়ে গেলেন বাঁহাতি স্পিনারদের ‘গুরু’ বিষেন সিং বেদিকে। ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ায় বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে সাকিবের সামনে তখন শুধু তিনজন। রঙ্গনা হেরাথ, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ও ডেরেক আন্ডারউড।
সাকিবের এসব জানার কথা নয়। জানতেনও না। টেস্টটা হচ্ছিল চট্টগ্রামে। দিনের খেলা শেষে হোটেলে ফেরার পর ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই সুইমিং পুলে নামতেন। লেখার বাড়তি কিছু রসদ জোগাড় করতে আমিও এটিকে রুটিন করে নিয়েছিলাম। সুইমিং পুলেই সাকিবকে তাঁর সর্বশেষ অর্জন সম্পর্কে জানালাম। সাকিব মন দিয়ে পুরোটা শুনে বললেন, ‘এখন তাহলে টেস্ট থেকে রিটায়ার করে ফেলা যায়। শুধু টি-টোয়েন্টি খেলব। টি-টোয়েন্টি ইজ দ্য রিয়েল ক্রিকেট।’

সাকিব আল হাসান
প্রথম আলো

সেপ্টেম্বর ২০১৭। ঘটনাস্থল এবারও র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলের সুইমিং পুল। পার্থক্য বলতে দুজনের কেউই তখনো পানিতে নামিনি। ডেক চেয়ারে বসে সাকিবের সঙ্গে কথা হচ্ছে। কদিন আগেই ঢাকায় প্রথম টেস্টে দুর্দান্ত এক অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে বড় ভূমিকা রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ে। কলকাতার সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত সংবাদ প্রতিদিনের ফিচার পাতা ক্যাফে হাউসের জন্য সাকিবের ওপর একটা লেখা চেয়েছেন। শুধু গৌতমদার কারণেই প্রথম আলোর জন্য লেখার ব্যস্ততার মধ্যেও তা লিখতে বাধ্য হয়েছি। ‘রয়েল বেঙ্গল সাকিব’ নামে তা ছাপাও হয়ে গেছে। সেই লেখাটা লিখতে গিয়েই একটা কৌতূহল হলো, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের মধ্যে সাকিবের স্থান কোথায়। স্থান নির্ধারণ করার ক্ষমতা তো আমার নেই, আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ৫০ টেস্ট শেষে আটের দশকের সেরা চার অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম, ইমরান খান, কপিল দেব ও রিচার্ড হ্যাডলি এবং এঁদের আগে-পরের সেরা দুই অলরাউন্ডার গ্যারি সোবার্স ও জ্যাক ক্যালিসের তুলনায় সাকিবের পারফরম্যান্স কেমন। তা দেখতে গিয়েই চমকে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সাকিবের পারফরম্যান্স এঁদের যে কারও সঙ্গে তুলনীয়। সাকিবের তুলনায় কারও হয়তো রান বেশি, কিন্তু উইকেটের দিক থেকে তিনি অনেক পিছিয়ে। আবার কারও হয়তো উইকেট কয়েকটা বেশি, কিন্তু রানের দিক থেকে সাকিবের ধারেকাছে নেই। টেস্টের মতো ওয়ানডেতেও একই ঘটনা।

লেখার লিংকটা সাকিবকে পাঠিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর যেটির উত্তর পেয়েছি, ‘ভালো লিখেছেন’।
সুইমিং পুলের পাড়ে বসে আলোচনাটা আমিই তুললাম, ‘সাকিব আপনি কি বুঝতে পারছেন, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কী একটা সুযোগ আপনার সামনে?’
সাকিব হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার লেখা পড়ে তো তা-ই মনে হলো।’
আমি বললাম, ‘আমি না লিখলেও ঘটনা একই থাকত। আমি তো আর আমার কোনো ধারণা বা বিশ্বাসের কথা বলিনি। যা বলার তা বলছে নির্জলা পরিসংখ্যান। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, ওয়ানডেতে যত কিছুই করেন না কেন, ক্রিকেট ইতিহাস গ্রেটনেসের বিবেচনায় আমলে নেবে শুধু টেস্ট ক্রিকেটের পারফরম্যান্স।’
সাকিব একটু অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঘটনা কী বলেন তো, কাল হাথুরুও (বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে) আমাকে একই কথা বলেছেন।’
আমি রসিকতা করে বললাম, ‘তার মানে গ্রেট ম্যান থিংক অ্যালাইক কথাটা ঠিক না।’
সাকিব হাসলেন। রসিকতাটা বুঝে কি না নিশ্চিত হতে না পেরে আমি বললাম, ‘কার গ্রেটনেস নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ, তা বুঝতে পেরেছেন তো?’
এবার একটু সশব্দ হাসি দিয়ে সাকিব বললেন, ‘বলতে হবে না, আমি বুঝেছি।’

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের পরপরই বাংলাদেশ যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। সাকিবকে উদ্দীপ্ত করতেই একটা তথ্য মনে করিয়ে দিলাম, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় পরপর দুই টেস্টে আপনার ইনিংসে ৫ উইকেট আছে। শেন ওয়ার্ন আর অনিল কুম্বলে একবারও যা নিতে পারেননি। মুত্তিয়া মুরালিধরনও নিয়েছেন মাত্র একবার। বুঝতে পারছেন, নিজেকে আরও ওপরে তুলে নেওয়ার কেমন একটা সুযোগ আপনার সামনে। ফাটিয়ে দেন এবার।’
সাকিবের হাসিটাকে প্রতিশ্রুতি মনে করেছিলাম। ঢাকায় ফেরার পর খবরটা পেয়ে তাই একটু অবাকই হলাম। সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ছুটি চেয়ে আবেদন করেছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ছুটি পেয়েছিলেন আংশিক। বাদ পড়ল সেই টেস্ট সিরিজটাই। যা নিয়ে আমি এত কথা বলে এলাম। হাথুরুসিংহেও কেন সাকিবকে টেস্ট সিরিজের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েছিলেন, তা–ও বুঝতে পারলাম। সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মনটা সজাগ রাখলে সেদিনই হয়তো এমন কিছু অনুমান করতে পারতাম।

পুরোনো গল্প এমন সবিস্তারে বলার কারণটা মনে হয় ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ছে না। দুটি গল্পেরই একই মোর‍াল: টেস্ট ক্রিকেট যতই অমরত্ব পাওয়ার বাহন হোক, অনেক দিন ধরেই সাকিবের প্রায়োরিটি লিস্টে তা সবার ওপরে নেই। মাঝামাঝিও নেই। পছন্দের ক্রমটা খুব পরিষ্কার: টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে... টেস্ট।

সাকিব আল হাসান
প্রথম আলো


শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ছুটি চেয়ে সাকিবের আইপিএল খেলতে চাওয়াতে তাই একটুও অবাক হইনি। ২০১৪ সালের দিকেও সাকিবকে এমন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে দেখেছি। আগে থেকে ঠিক করা ছিল না, বাংলাদেশের এমন একটা সম্ভাব্য সিরিজের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত আইপিএলের সময়টা মিলে গিয়েছিল।
যা শোনার পর খুলনার হোটেলে ব্রেকফাস্ট রুমে সাকিবকে একটু সহমর্মিতার সুরেই বললাম, ‘আইপিএল তো তাহলে আর খেলা হচ্ছে না এবার।’
সাকিব বললেন, ‘কেন, বাংলাদেশের সিরিজটা বাদ দিয়ে যদি আইপিএল খেলি, সমস্যা কী?’
বলার ভঙ্গি আর তাকিয়ে থাকার ধরন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার প্রতিক্রিয়াটা কী হয়, তা দেখতেই ওই কথাটা বলা। আমার প্রতিক্রিয়ায় কিছু যায় আসে না, কিন্তু তা থেকে মিডিয়া রিঅ্যাকশন ও সাধারণ্যে প্রতিক্রিয়ার একটা আভাস তো পাওয়া যাবে।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিরিজটা হয়েছিল কি না, মনে নেই। তবে হয়ে থাকলেও সাকিব যে তা বাদ দিয়ে আইপিএল খেলতে যাননি, তা তো নিশ্চিত করেই বলতে পারি। গিয়েছেন কি যাননি, এটা মূল প্রশ্ন নয়। ঘটনাটা বলার একটাই কারণ, সময়টা মিলে না গেলে তো সমস্যা নেই, কিন্তু মিলে গেলে আন্তর্জাতিক সিরিজ না আইপিএল—এই দ্বন্দ্ব সাকিবকে এর আগেও ভুগিয়েছে। কে কী বলে, মানুষের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, এসব ভেবেই হয়তো সেটিকে চাপা দিয়ে রেখেছেন। এবার আর সে পথ মাড়াননি।

সাকিব আল হাসান
প্রথম আলো

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জন্য এই সমস্যা নতুন, তবে অন্য ক্রিকেট বোর্ডগুলো কিন্তু অনেক আগে থেকেই এতে ভুগছে। শুধু ভারত আর পাকিস্তানই ব্যতিক্রম। আইপিএল তো ভারতেরই জিনিস আর পাকিস্তানিদের তো সেখানে প্রবেশাধিকারই নেই। বাকি বোর্ডগুলো একেকভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছে। সমাধানটা সব সময় বোর্ডের হাতে থাকেওনি। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক ক্রিকেটার বোর্ডের চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফ্রিল্যান্সার হয়ে গেছেন। সময় পেলে জাতীয় দলে খেলেন।
আইপিএলের মাধ্যমে শুরু (শুরুর কৃতিত্ব বা দায় অবশ্য দেওয়া উচিত আইসিএলকে) এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অনেক দিনই এই নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটারদের ঢালাওভাবে দোষ দেওয়াটা অন্যায়। এর সঙ্গে দেশপ্রেম গুলিয়ে ফেলাটা তো আরও বেশি অন্যায় (এ বিষয়ে পরে কোনো এক সময় বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে)। ক্রিকেটাররা পেশাদার, কোথায় খেলবেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁদের অবশ্যই আছে।
আপনি আশা করতে পারেন, ‘তুচ্ছ’ টাকাপয়সার কথা না ভেবে তাঁরা দেশের পক্ষে খেলাটাকেই বড় মনে করবেন। কেউ তা করলে আমরা অবশ্যই খুশি হব। না করলে আপনার মন খারাপ হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ, আপনি যে তাঁদের পেশাদার ক্রিকেটারের বদলে অন্য আসনে বসিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ওই আবেগ দ্বারা চালিত হয়ে তাঁকে ভিলেন বানিয়ে ফেলাটা হবে অন্যায়।


অন্য পেশাদারদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, তাঁদের ক্যারিয়ার অনেক সংক্ষিপ্ত। ৪৫-৫০ বছর বয়সে অন্য পেশার মানুষ ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছায় আর খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার এর অনেক আগেই শেষ। এই সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা তো কেউ করতেই পারেন। তার ওপর টাকার পার্থক্যটা যদি এমন আকাশ-পাতাল হয়। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোতে আমার সাবেক সহকর্মীদের আমি প্রায়ই একটা উদাহরণ দিতাম। বলতাম, ‘এই যে ধরো, আমরা এখানে ৮ ঘণ্টা-১০ ঘণ্টা কাজ করছি। এখন কেউ যদি আমাদের দেড়-দুই ঘণ্টা একই কাজ করার বিনিময়ে ১৫ গুণ-২০ গুণ বেশি টাকা দেয়, আমরা কি তা করব না? কাজ তো একই, অনৈতিক কিছু তো না।’
১৫-২০ গুণ বললাম, আইপিএলের ক্ষেত্রে অঙ্কটা কখনো কখনো আরও বহু গুণ, সাকিবের ক্ষেত্রেই তো আরও বেশি। সাকিবের ছুটির আবেদন মঞ্জুর না করেও বিসিবির কোনো উপায় ছিল না। জোর করে তো কাউকে খেলানো যায় না। কেউ নিজেকে সব ফরম্যাটের জন্য অ্যাভেইলেবল না রাখলে বড়জোর চুক্তি থেকে বাদ দিতে পারে বা কম টাকার চুক্তি করতে পারে। তবে বিসিবি একটা কাজ বোধ হয় করতে পারত। আন্তর্জাতিক সূচির সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ মিলে গেলে ক্রিকেটারদের জাতীয় দলে পাওয়া নিশ্চিত করতে সমান অঙ্ক না হলেও মোটামুটি একটা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারত। এই সমাধানটা অন্য কোনো দেশ চর্চা করে বলে জানা নেই। খুব ভালো প্র্যাকটিসও হয়তো না। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিব আর মোস্তাফিজই যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সুযোগ পান, এটা করার কথা ভাবাই যেত। সাকিবের দেখানো পথ ধরে মোস্তাফিজও যদি এখন আইপিএলের জন্য ছুটি চান, তখন বিসিবি কী করবে? এর আগে জাতীয় স্বার্থেই মোস্তাফিজকে আইপিএলে খেলার ছাড়পত্র দেয়নি বিসিবি। কিন্তু মোস্তাফিজের ব্যক্তিগত স্বার্থটাও তো একটু দেখা উচিত ছিল। উচিত ছিল কিছুটা হলেও আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক কিছুতেই সাকিব ‘প্রথম’। টি-টোয়েন্টি যুগের আধুনিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াতেও।

(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে)