বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয়যাত্রার যাত্রী তিনি

রাইসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলির গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক।ছবি: প্রথম আলো

চলে যাওয়ার জন্য এমন একটা দিন বেছে নিলেন তিনি! করোনার কারণে ১০ মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিল বাংলাদেশ। সেই মার্চ মাসের পর আজই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে বৈশ্বিক ক্রিকেটে ফিরল বাংলাদেশ। আর এদিনই চলে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোর অন্যতম পুরোধা রাইসউদ্দিন আহমেদ।

এই প্রজন্মের ক্রিকেটপ্রেমীরা ক্রিকেটের রমরমা দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু স্বাধীনতার পর ব্যাপারটা ছিল ঠিক উল্টো। ক্রিকেটকে তখন শুরু করতে হয়েছিল একেবারে শূন্য থেকেই। অর্থ নেই, স্বীকৃতি নেই—কঠিন পরিস্থিতি। সেই সময় যে কজন ক্রিকেট সংগঠক দেশের ক্রিকেটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন, যাঁদের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের যাত্রা শুরু, রাইসউদ্দিন আহমেদ তাঁদের একজন। নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে রাইসউদ্দিন আহমেদরাই দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে। আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ লাভ, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের যাত্রা শুরু, বিদেশি দলের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ—দেশের ক্রিকেটের শুরুর গল্পে এক বড় জায়গা জুড়েই আছেন রাইসউদ্দিন আহমেদ।

২০১৭ সালে রাইসউদ্দিন আহমেদকে আজীবন সম্মানা দিয়ে সম্মানিত করে প্রথম আলো।
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাইসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড) সাধারণ সম্পাদক। তবে তাঁর সংগঠক সত্তাটার শুরু হয়েছিল সেই পঞ্চাশের দশকেই। ঐতিহ্যবাহী সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন খেলার আয়োজনে, সংগঠনে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, স্কোয়াশ—সব জায়গায় ছিল তাঁর বিচরণ। ওই বয়সেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। পাকিস্তান বাস্কেটবল ফেডারেশনের সহসভাপতির পদও অর্জন করেন তিনি। পাকিস্তানের সেই বৈষম্যের দিনগুলোয় রাইসউদ্দিন আহমেদ ক্রীড়াক্ষেত্রে বাঙালিদের অধিকার আদায়েও ছিলেন সচেষ্ট। ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোয় পাঞ্জাবি, সিন্ধি ও পাঠানদের সঙ্গে বাঙালিদের সমানুপাত ছিল তাঁর সেই সময়ের দাবি। সে সময় তিনি বাঙালি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ও পাকিস্তান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে। দুই পাকিস্তানের দল নিয়ে কারদার সামার ক্রিকেট নামে একটি জনপ্রিয় টুর্নামেন্টও চালু করেছিলেন তিনি। নিজেও ছিলেন ভালো খেলোয়াড়। প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগেও খেলেছেন। ক্রিকেট তো খেলেছেনই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে তিনি পাকিস্তানের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কায়েদে আজম ট্রফিতেও খেলেছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন রাইসউদ্দিন আহমেদরা। শুরুর দিকে অবশ্য স্থবির হয়ে পড়া দেশের ক্রিকেট নিয়ে প্রথম লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় লিখেছিলেন ইংরেজ সাংবাদিক রবিন মার্লার। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছিলেন। সেই লেখার সূত্র ধরেই বাংলাদেশে প্রথম সফরে আসে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসি। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) তিন দিনের ম্যাচ খেলে এমসিসি। সেটিই বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম ম্যাচ। এই সময় এমসিসির মতো দলকে দেশে নিয়ে আসার পেছনে রাইসউদ্দিন আহমেদের ছিল বড় ভূমিকা। সে সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই রাইসউদ্দিন আহমেদ বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন।

এটা ছিল রাইসউদ্দিন আহমেদদের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের যাত্রা শুরুর গল্প। এরপর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় পুরো সময়টাতেই রাইসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয়যাত্রার অভিযাত্রী। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বোর্ডের সহসভাপতি। কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের ক্রিকেট যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, সেই ভিত্তি গড়ে দেওয়ার কারিগর ছিলেন তাঁরাই। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে প্রথম তিনটি দলের মধ্যে থাকতে পারলেই ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হতো বাংলাদেশের। সে লক্ষ্যে বিদেশি কোচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফল হয়নি। সেই ব্যর্থতা ছুঁয়ে গিয়েছিল রাইসউদ্দিন আহমেদকে। সে জন্যই ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির আগে সংগঠক হিসেবে আগের ব্যর্থতার শিক্ষা নিয়েছিলেন। এরপর বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে খেলা ও ২০০০ সালে দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব—রাইসউদ্দিন আহমেদের অবদান স্মর্তব্য অনেক অর্জনেই।