বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্ব রেকর্ড গড়া বোলার মুগ্ধ করছেন আইপিএলে

চাহার মাত্র ১৩ রান দিয়ে উইকেট নিয়েছেন চারটি।ছবি : আইপিএল

দীপক চাহারকে মনে পড়ে?

মনে না পড়ার কোনো কারণ নেই। বিরাট কোহলি, যশপ্রীত বুমরা, রবীন্দ্র জাদেজা, হার্দিক পান্ডিয়াবিহীন ভারতের হয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে বছর দুয়েক আগে ভারত জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন এক ঝাঁক অনিয়মিত মুখ। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন এই চাহার। সুযোগটা তিনি দুহাত ভরে নিয়েছিলেন, আর তাতেই পুড়ে খাক হয়েছিল বাংলাদেশ। নাগপুরে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে বৈচিত্র্যময় সুইং বোলিংয়ের পসরা সাজিয়ে একে একে তুলে নিয়েছিলেন লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ মিঠুন, আমিনুল ইসলাম, শফিউল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমানকে। মোহাম্মদ নাইমের বীরত্বে যে ম্যাচে বাংলাদেশ জয়ের স্বপ্ন দেখছিল একপর্যায়ে, সেই বাংলাদশই শেষমেশ চাহারের সুইং-তোপে দিশা হারিয়ে থেমে যায় ১৪৪ রানে, ৩০ রানের হার।

চাহারের বোলিংয়ের তেজ দেখেছিল বাংলাদেশ।
ছবি : টুইটার

চাহারের বোলিং ফিগারও ছিল দেখার মতো; ৩.২-০-৭-৬! বাংলাদেশ অল আউট না হয়ে গেলে, বাকি চার বলে হয়তো আরও উইকেট পেতে পারতেন এই পেসার। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এটাই সেরা বোলিং ফিগার। চাহারের বোলিং-বৈচিত্র্য তখন থেকেই আরও ভালোমতো সবার নজরে আসে। পাওয়ার-প্লেতে উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা, সুইং বল, নাকল বল—যেকোনো অধিনায়কেরই বড় অস্ত্র যে তিনি হতে পারেন, সবাই আস্তে আস্তে বোঝা শুরু করে। মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাইয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই চাহার বেশ নিয়মিত মুখ, অধিনায়কের ভরসার জায়গা। কেন ভরসার জায়গা? সেটা আবারও প্রমাণ করেছেন এই ডানহাতি পেসার। তাঁর সুইং-বিষে নীল হয়েই গত রাতে একরকম আত্মসমর্পণ করেছেন গেইল-রাহুলরা।

চাহারের বোলিং ফিগার গত রাতেও ছিল দৃষ্টিনন্দন। বল করেছেন চার ওভার। মাত্র ১৩ রান দিয়ে উইকেট নিয়েছেন চারটি। মায়াঙ্ক আগরওয়াল, ক্রিস গেইল, দীপক হুদা, নিকোলাস পুরান—পাঞ্জাবের ব্যাটিং অর্ডারের ‘কোমর’ বলতে গেলে একাই ভেঙে দিয়েছেন চাহার। প্রথমে দুর্দান্ত এক আউটসুইঙ্গারে বোল্ড করেছেন মায়াঙ্ককে, এরপর অসাধারণ নাকল বলের জবাব খুঁজে পাননি গেইল, বলের গতি না বুঝতে পেরে শর্ট কাভারে দাঁড়িয়ে থাকা রবীন্দ্র জাদেজার হাতে ক্যাচ দিয়েছেন। টানা ফুল লেংথে বল করে একবার হুট করে শর্টপিচ ডেলিভারি দিয়েই আউট করেছেন আরেক উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান নিকোলাস পুরানকে। সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা শার্দুল ঠাকুর ক্যাচ নিয়েছেন পুরানের। ধোনি বুঝছেন, দুর্দান্ত ছন্দে আছেন চাহার। এক টানে ফর্মে থাকা বোলারের কোটা শেষ করে দিলেন চার ওভার বল করিয়ে। শেষ ওভারেও আরেকটি নাকল বলে চাহার পরাস্ত করলেন পাঞ্জাবের গত ম্যাচের অন্যতম নায়ক দীপক হুদাকে। হুদা ক্যাচ ওঠালেন, ধরেন ফাফ ডু প্লেসিস। নিজের আইপিএল ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগারটাও এভাবেই পেয়েছেন এই ডানহাতি সুইং বোলার।

শাস্ত্রীর প্রশংসা দেখে চাহারের মুখে হাসি লম্বা হবে নিশ্চিত
ছবি : আইপিএল

চাহারের এই বোলিং দেখে যথারীতি প্রশংসাবাক্য আসা শুরু হয়েছে চারদিক থেকে। আর সে তালিকায় যাঁর নামটা দেখে চাহারের মুখের হাসি লম্বা হবে সবচেয়ে বেশি, তিনি জাতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রী। সুইং বোলিংয়ের দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন দেখে নিজের মত প্রকাশ করতে টুইটারকেই বেছে নিয়েছেন কোহলিদের কোচ। সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন একজন আদর্শ সুইং বোলারের গুরুত্ব, ‘এটা প্রমাণিত যে একজন জেনুইন সুইং বোলার যে উভয় দিকেই বলকে কথা বলাতে পারে, সে যেকোনো সেরা ব্যাটসম্যানকেই পরাস্ত করতে পারে। দুর্দান্ত বৈচিত্র্যময় বোলিং। বুদ্ধিদীপ্ত।’

শাস্ত্রীর প্রশংসা দেখে চাহারের মুখে হাসি লম্বা হবে কারণ, বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই অসাধারণ বোলিং করার পরেও আস্তে আস্তে জাতীয় দল থেকে একরকম ছিটকেই পড়েছেন। যশপ্রীত বুমরা, মোহাম্মদ শামি, ভুবনেশ্বর কুমার, উমেশ যাদব, ইশান্ত শর্মা থেকে শুরু করে টি নটরাজন, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, শার্দুল ঠাকুর, মোহাম্মদ সিরাজ, নবদ্বীপ সাইনিরা ভারতের পেস আক্রমণ সামলানোর সুযোগ পেলেও চাহারকে যেন ভুলেই গেছেন শাস্ত্রী। গত কয়েকটা সিরিজেই তাঁকে দেখা যায়নি মূল একাদশে। এই বোলিং দেখে জাতীয় দলের জন্য আবারও হয়তো বিবেচনা করা হতে পারে তাঁকে!

যদিও চাহার কেন জাতীয় দলে সুযোগ পান না, গত ম্যাচের পর সে প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করা আকাশ চোপড়ার কাছে, ‘আমি বুঝি না টি-টোয়েন্টিতে দীপক চাহারকে কেন জাতীয় দলে ডাকা হয় না। হয়তো স্কোয়াডে থাকে, কিন্তু মূল একাদশে জায়গা পায় না। ওর বিশ্ব রেকর্ড আছে টি-টোয়েন্টিতে, তা-ও খুব বেশি আগের কথা না।’

পিচে মুভমেন্ট থাকলে চাহারের মতো একজন বোলার হাতে থাকা যে একটা অধিনায়কের কাছে কত বড় আশীর্বাদ, ম্যাচ শেষে ধোনির কথাতেই স্পষ্ট সেটা। প্রথম ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে চাহারের কল্যাণে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানো চেন্নাই অধিনায়ক বলেছেন, ‘চাহার কিন্তু ডেথ ওভারেও দুর্দান্ত বল করতে পারে। আমি যদি আক্রমণাত্মক খেলতে চাই, উইকেট পেতে চাই, তাহলে আমি ওকে ব্যবহার করার চেষ্টা করি। কারণ ও পিচের সুবিধা ভালোমত নিতে পারে। আমি আজ আক্রমণাত্মক খেলতে চেয়েছি। তাই ওকে দিয়ে টানা চার ওভার বোলিং করিয়েছি। চার ওভার টানা বল করার জন্য ওর ফিটনেসও প্রশংসার দাবিদার।’

ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক পেসার ইরফান পাঠান অবশ্য সুইং বোলিংয়ে চাহারের বুদ্ধিমত্তার কথাই তুলে ধরেছেন বিশেষভাবে, ‘স্যাম কারেন ও দীপক চাহার—দুজনই চেন্নাইয়ের হয়ে দুর্দান্ত সুইং বোলিং করতে পারে। কিন্তু আমি কারেনের চেয়ে চাহারকে এগিয়ে রাখব একটু। কারণ একজন বোলার হিসেবে আপনি যত বেশি সময় ধরে বল হাতে ধরে রাখতে পারবেন, আপনি বলে তত বেশি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবেন। বল ডেলিভারি দেওয়ার আগপর্যন্ত আরেকটু বেশি সময় ধরে যদি বল ধরে রাখতে পারেন, তাহলে আপনি বলকে কথা বলাতে পারবেন, পিচ অনুযায়ী বলের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যে কাজটা চাহার কারেনের চেয়ে ভালো করতে পারে। আমি আগেও বলেছি, কারেন আরেকটু দেরিতে বল ছাড়লে ও আরও ভালো সুইং বোলার হতে পারবে। এটা যেকোনো স্পিনারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বল ছাড়ার একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল ধরে রাখতে হবে, যতটুকু রাখা যায় আর কি। আর এটাই চাহারের মূল কৌশল।’

সুইং বোলিংয়ে চাহারের বুদ্ধিমত্তার কথাই সবার মুখে
ছবি : আইপিএল

পাঠান অবশ্য চাহারের দুর্দান্ত সুইংয়ে অবদান তাঁর অ্যাকশনেরও, ‘চাহার যখন বল করে, ওর হাত অনেকটা ওর মূল শরীরের কাছাকাছি থাকে, শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। সুইং বোলিং করার জন্য এ ধরনের অ্যাকশন অনেক কাজে দেয়। গতবার আইপিএলে একজন বোলার এসেছিলন, শেলডন কটরেল (কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব)। সে-ও দুর্দান্ত বোলিং করত। কিন্তু ওর অ্যাকশনটা অন্য রকম ছিল। বল ছাড়ার সময় ওর হাত মূল শরীর থেকে অনেক দূরে থাকত। এমন অ্যাকশনে বল করলে আপনি অত ভালো সুইং পাবেন না। বলের ওপর তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না আপনার। চাহারের ওই সমস্যা নেই।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে পাঠান আবার তুলে ধরেছেন চাহারের বোলিং-বৈচিত্র্যের বিষয়টা। সুইং বোলার হয়েও নিকোলাস পুরানকে যেভাবে বাউন্সারে আউট করেছেন, সেটাই চোখে লেগে আছে পাঠানের, ‘বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং করেছে দীপক চাহার। সুইং বোলারদের জন্য হুট করে বাউন্সার দেওয়াটা সব সময়ই অনেক কার্যকরী অস্ত্র। কারণ ব্যাটসম্যানরা সুইং মোকাবিলা করার জন্য সব সময় ফ্রন্টফুটে খেলার চেষ্টা করে।’