ভালোদের তালিকায় নাম তুলতে সবাই চান। আর সেই ভালোদের মধ্যে যদি সেরা হওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই। কেউ চান না খারাপের তালিকায় নাম তুলতে। খেলাধুলার পারফরম্যান্স নিয়ে যখন কথা হয়, তখন অবশ্য ‘খারাপ’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘বাজে’ শব্দটা ব্যবহার করাই ভালো। তো সেই বাজেদের তালিকায় যদি কোনো কারণে কারও নাম উঠে যায়, সবারই চেষ্টা থাকে সেখান থেকে নাম কাটিয়ে ফেলার। কে চান, সেই বাজেদের মধ্যে সেরা হতে? কিন্তু জেমস অ্যান্ডারসন আর ট্রেন্ট বোল্টের মধ্যে এখন যে লড়াইটা চলছে, সেটা আসলে বাজেদের মধ্যে সেরা হওয়ারই!
এটুকু শুনে অনেকেই রেগে যেতে পারেন। অ্যান্ডারসন বাজে? ট্রেন্ট বোল্ট? একজন সর্বকালের সেরা পেসার কি না, সে নিয়ে বরং তর্ক হতে পারে। অন্যজন সময়ের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন, এতে দ্বিমত করার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
খুবই সত্যি। তবে কথা আসলে বোলার অ্যান্ডারসন বা বোল্টকে নিয়ে নয়। একটু ব্যাখ্যা করলেই পরিষ্কার হবে। বলুন তো, একটা ক্রিকেট দলে যে ১১ জন থাকেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বাজে ব্যাটসম্যান কে? ১ নম্বরে যে ব্যাটিং করতে নামেন, তিনি হয়তো সেরা নাও হতে পারেন, স্বীকৃত ছয়-সাতজন ব্যাটসম্যানের মধ্যেই হয়তো একজন হবেন। কিন্তু এতে তো কোনো সন্দেহ নেই যে দলের সবচেয়ে অদক্ষ কিংবা বাজে ব্যাটসম্যান হবেন তিনিই, যাঁকে সবার শেষে ব্যাটে নামানো হয়। অর্থাৎ, ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান। অ্যান্ডারসন ও বোল্ট সে হিসেবে তো বাজেদের দলেই পড়েন!
বোল্টের ব্যাটসম্যান হিসেবে একটা চাওয়া ছিল, সেটি পূরণ হয়েছে। টেস্টে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ রানের লড়াইয়ে অ্যান্ডারসনকে ৬১৮ রানে রেখে তিনি পৌঁছে গেছেন ৬৪০ রানে।
তা এই বাজে যাদের বলছি, সেই ১১ নম্বর পজিশনের সেরা কিন্তু বোল্ট। সবার শেষে ব্যাটিংয়ে নেমে টেস্ট ক্রিকেটে তিনি যত রান করেছেন, তা করতে পারেননি আর কেউই। শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই নয়, সব ফরম্যাটেরই সেরা ‘নাম্বার ইলেভেন’ হওয়া থেকে বোল্ট আছেন এখন হাতছোঁয়া দূরত্বে এবং সেখানে পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবেন অ্যান্ডারসনের চেহারা। দুজনের এই পিছু ধাওয়ার খেলটা শুরু হয়েছিল চলমান ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড সিরিজের লর্ডস টেস্ট থেকে।
লর্ডস টেস্টের আগে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে অ্যান্ডারসনের রান ছিল ৬০৯। বোল্ট ছিলেন ২০ রান পিছিয়ে। শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরন ছিলেন সবার সামনে, ৬২৩ রান নিয়ে। লর্ডস টেস্টে ১৮ রান করে বোল্ট পৌঁছে গিয়েছিলেন ৬০৭ রানে। ওই টেস্টে ৭ রান করেও টেস্ট শেষে অ্যান্ডারসনের রান ৬০৯-ই থেকেছে, কারণ, তিনি তা করেছিলেন ১০ নম্বরে নেমে!
পরের টেস্টে অ্যান্ডারসন আরও ৯ রান করেন, এবার নাম্বার ইলেভেন হিসেবেই। কিন্তু ততক্ষণে বোল্ট তাঁকে পেছন ফেলে এগিয়ে গেছেন অনেকটাই। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের প্রথম ইনিংসেই যে বোল্ট করে ফেলেছিলেন ১৬ রান। আর তাতেই তিনি পৌঁছে যান ৬২৩ রানে, ছুঁয়ে ফেলেন মুরালিকে।
মুরালিধরনকে ছাড়িয়ে ১১ নম্বরে ‘বিশ্বসেরা’ হওয়ার স্বপ্নপূরণে দ্বিতীয় ইনিংসে নামেন বোল্ট। ষষ্ঠ বলটায় ব্যাট লাগিয়েই দৌড়ে দ্বিতীয় রান যখন পূর্ণ করছেন, হাত তুলে অভিনন্দনের জবাবও দিলেন। ততক্ষণে যে নিউজিল্যান্ড ড্রেসিংরুম থেকে আসা হাততালির শব্দ এসে গেছে তাঁর কানে। ক্রিজে সঙ্গী মিচেল অভিনন্দন জানালেন জড়িয়ে ধরে।
রেকর্ডটার জন্য নাকি অধীর আগ্রহেই অপেক্ষা করছিলেন বোল্ট। মিচেল জানিয়েছিলেন, আইপিএলে দুজনের একসঙ্গে কাটানো মৌসুমে প্রতিদিনই নাকি বোল্ট রেকর্ডটার কথা উল্লেখ করতেন। রেকর্ডটা নিজের করে নেওয়ার পর বোল্ট বলেছিলেন, এই রেকর্ডে নাকি সাড়ে ১০ বছর ধরেই চোখ ছিল তাঁর।
বোল্টের ব্যাটিং প্রদর্শনী যেমন মজার, তেমনি ব্যাটিং নিয়ে তাঁর কথাবার্তাগুলোও! আইপিএলে প্রথম চারের দেখা পেয়েছেন এ বছরই, ওই ম্যাচে করেছিলেন ১৬ রান। পরে ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণীতে কথা বলেছেন নিজের ব্যাটিং নিয়েও। হার্শা ভোগলেকে হাসতে হাসতে বলেছেন, নিজের ব্যাটিং নিয়ে যে কথা বলতে হচ্ছে তাঁকে, এটাই বিস্ময়কর লাগছে তাঁর কাছে।
অবশ্য রাজস্থান রয়্যালসের খাটো ব্যাটিং লাইনআপের কারণে বোল্টকে নামতে হচ্ছিল আট নম্বরেই। একবার বলেছিলেন, সাঙ্গাকারা হয়তো তাঁর মধ্যে এমন কিছু দেখেছেন, যা অন্য কোচরা দেখেননি, তাই তাঁকে আট নম্বরে নামাচ্ছেন। ব্যাটিংয়ের সময়ে নাকি তিনি মারাত্মক উদ্বেগের মধ্যেই থাকেন।
সেই বোল্টের ব্যাটসম্যান হিসেবে একটা চাওয়া ছিল, সেটি পূরণ হয়েছে। টেস্টে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ রানের লড়াইয়ে অ্যান্ডারসনকে ৬১৮ রানে রেখে তিনি পৌঁছে গেছেন ৬৪০ রানে।
লড়াইটা আরও জমজমাট সব সংস্করণের হিসেবে। লর্ডস টেস্টের আগে অ্যান্ডারসন ছিলেন ৭৭২ রানে, শেষেও তাই। বোল্ট ৭৪১ রানের সঙ্গে ১৮ রান যোগ করে অ্যান্ডারসনের দিকে এগিয়ে যান কিছুটা। এরপর ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৬ রান করে ছাড়িয়ে যান অ্যান্ডারসনকে, তাঁর রান হয়ে যায় ৭৭৫। অ্যান্ডারসন আবার নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৯ রান করে পেছনে ফেলেন বোল্টকে।
বোল্ট পরের ইনিংসে ১৭ রান করে আবারও ছাড়িয়ে যান অ্যান্ডারসনকে। তাতেই বোল্ট টেস্টে সেরা নাম্বার ইলেভেনও হয়ে যান, সব সংস্করণে সেরা হওয়া এখন তাঁর জন্য সময়েরই ব্যাপার। মুরালিধরনের সর্বোচ্চ ৭৯৩ থেকে যে মাত্র ১ রান দূরত্বে বোল্ট। ৭৮১ রান নিয়ে খুব পিছিয়ে নন অ্যান্ডারসনও।