বাবাদের ছেলেরা
বাবার দীর্ঘ ছায়া থেকে বেরোতে নিজের পদবি বদলে ফেলেছিলেন ডন ব্র্যাডম্যানের ছেলে। জন ব্র্যাডম্যান থেকে হয়ে গিয়েছিলেন জন ব্র্যাডসেন। ক্রিকেটের ধারেকাছেও যাননি। ভালো হার্ডলার ছিলেন বলে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত খেলা থেকে শত হস্ত দূরে গিয়ে পড়াশোনাটাকেই ধ্যানজ্ঞান করে ফেলেন। অ্যাডিলেডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবিধানিক ও পরিবেশ আইনের অধ্যাপনা করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। জন ব্র্যাডসেনের ছাত্রছাত্রীদের প্রায় কেউই নাকি জানতেন না, তাঁদের আইনশাস্ত্রে দীক্ষা দেওয়া দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ানের ছেলে!
ব্র্যাডম্যান বেঁচে থাকতেই অবশ্য জন ব্র্যাডম্যানে ফিরেছিলেন জন ব্র্যাডসেন। স্যার ডন তখন বলেছিলেন, ‘তুমি যা ভালো মনে করো, তাই করো। আমার জন্য কিছু কোরো না।’ শন মার্শ ও মিচেল মার্শের এই সমস্যা হয়নি। প্রথম এবং অবশ্যই বড় কারণ, জিওফ মার্শ ‘ডন ব্র্যাডম্যান’ নন। কেউই তা নন। ক্রিকেট ইতিহাসে আর কাউকেই প্রচারের আলো এভাবে খুঁজে বেড়ায়নি। আর কেউ তা এমন তীব্র অপছন্দও করেননি।
প্রচারের আলো খুঁজে বেড়ানোর কথা বললে স্যার ডনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন এক শচীন টেন্ডুলকার। তাঁর ছেলেকেও নিশ্চয়ই জন ব্র্যাডম্যানের মতো একই বিড়ম্বনা সইতে হয়। হয়তো একটু বেশিই। কারণ শচীন-পুত্র অর্জুন টেন্ডুলকারও ক্রিকেট খেলেন। তবে পদবি বদলানোর কথা ভাবছেন বলে এখন পর্যন্ত কিছু শোনা যায়নি। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে!
অর্জুনের প্রসঙ্গটা এই লেখায় অপ্রাসঙ্গিক নয়। লেখাটা তো বিখ্যাত ক্রিকেটার বাবার ক্রিকেটার সন্তানদের নিয়েই। অস্টিন ওয়াহ ও থান্ডো এনটিনি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই এই আলোচনার পালে হাওয়া লেগেছে। যেটি আরও জোরালো হয়েছে সিডনিতে অ্যাশেজের শেষ টেস্টে শন মার্শ ও মিচেল মার্শের সেঞ্চুরির পর।
থান্ডো এনটিনির পরিচয় বোধ হয় না দিলেও চলছে। এ জন্য পদবিই যথেষ্ট। অস্টিন ওয়াহর ঘটনা তা নয়। এনটিনি মানেই মাখায়া এনটিনি। কিন্তু ওয়াহ মানে তো স্টিভ হতে পারে, হতে পারে মার্কও। অস্টিন ওয়াহ চার মিনিটের বড়-ছোট দুই ওয়াহ যমজের বড়জন অর্থাৎ স্টিভের ছেলে। বাবার সঙ্গে ব্যাটিংয়ের ধরনেও নাকি অনেক মিল।
যেমন মিল ত্যাগনারায়ণ চন্দরপলের। স্টান্সটা বাবার মতো অমন বিদ্ঘুটে নয়। তবে শিবনারায়ণ চন্দরপলের স্টান্সও তো শুরুতে অমন ছিল না। বাবা যেমন বেলের ওপর ব্যাটের হাতল ঠুকে গার্ড নেন, ছেলেও তা-ই। দুজনই বাঁহাতি। চার বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন ত্যাগনারায়ণ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট তো বাবা-ছেলে একসঙ্গেই খেলছেন। গত বছর একই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন দুজনই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এর আগে মাত্র একবারই একই ম্যাচে বাবা ও ছেলেকে হাফ সেঞ্চুরি করতে দেখেছে। সেটি সেই ১৯৩১ সালে। ইংল্যান্ডের জর্জ গানের বয়স তখন ৫৩ বছর। ছেলে জর্জ ভারনন গান ২৬। দুই গান-ই অবশ্য সেঞ্চুরি করেছিলেন ওই ম্যাচে। শিবনারায়ণ চন্দরপল ছেলেকে নিয়ে এই কীর্তিটাও ছুঁয়ে তবেই খেলা ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন কি না, কে জানে!
গান আর চন্দরপলদের মতো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাবা ও ছেলের একসঙ্গে খেলার উদাহরণ অনেক আছে। খুঁজলে প্রতিপক্ষ দুই দলে খেলার ঘটনাও হয়তো পাওয়া যাবে। ডব্লু জি গ্রেস তো ১৯০০ সালে দুই ছেলেকে দলে নিয়ে লন্ডন কাউন্টি দলের হয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন। বড় ছেলের নাম ছিল তাঁর নামেই-ডব্লু জি গ্রেস জুনিয়র। আরেকজনের চার্লস বাটলার গ্রেস। ডব্লু জি গ্রেস সিনিয়র আর জুনিয়র একসঙ্গে অনেক খেলেছেন, ৪৬টি ম্যাচে তাঁরা ছিলেন সতীর্থ। মজার ব্যাপার হলো, দুই ছেলেরই ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে বাবার আগে।
ডব্লু জির দুই ভাই টেস্ট খেললেও ছেলেদের কেউ টেস্ট ক্রিকেটার হতে পারেননি। গানদের ঘটনাও তা-ই। জর্জ গান ১৫টি টেস্ট খেললেও ছেলের আর টেস্ট খেলা হয়নি। গানদের সঙ্গে এই মিলটাও থাকুক, এটা নিশ্চয়ই চান না শিব। যদিও ত্যাগনারায়ণ টেস্ট খেললে সেটি ক্রিকেটের বাবা-ছেলের দীর্ঘ তালিকায় আরেকটি সংযোজনই শুধু হবে, মার্শরা থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই। বাবা টেস্ট ক্রিকেটার এবং তাঁর দুই ছেলে টেস্ট খেলেছেন-এই গৌরবেও অবশ্য মার্শদের একচ্ছত্র অধিকার নেই। ভারতের অমরনাথ আর নিউজিল্যান্ডের হ্যাডলিরা তা আগেই করে রেখেছেন।
ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান লালা অমরনাথের দুই ছেলে সুরিন্দর ও মহিন্দরও টেস্ট খেলেছেন। তুলনায় কম বিখ্যাত সুরিন্দরের বাবার মতোই টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি আছে। নিউজিল্যান্ডের ওয়াল্টার হ্যাডলির যে দুই ছেলে টেস্ট খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে ছোটজনকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। রিচার্ড হ্যাডলি বলাটাই যথেষ্ট। রিচার্ডের বড় ভাই ডেইল হ্যাডলিরও শুরুটা হয়েছিল অমিত সম্ভাবনা নিয়েই। ডেইলও ছিলেন ফাস্ট মিডিয়াম বোলার। কিন্তু পিঠের চোট ২৬ টেস্ট আর ১১ ওয়ানডেতেই শেষ করে দেয় তাঁর ক্যারিয়ার।
হ্যাডলিদের পাঁচ ভাইয়ের প্রথম চারজনই ক্রিকেটে মজেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন তিনজন। ডেইল আর রিচার্ডের বড় ভাই ব্যারি হ্যাডলি অবশ্য খেলেছেন মাত্র দুটি ওয়ানডেই। দুটিতেই নিউজিল্যান্ড দলে তাঁর সতীর্থ ছোট দুই ভাই! বাবার মতো ব্যারিও ছিলেন ব্যাটসম্যান।
টেস্ট ক্রিকেটার বাবার দুই ছেলের টেস্ট খেলায় মিল তো আছেই, লালা অমরনাথ ও ওয়াল্টার হ্যাডলির মধ্যে মিল আছে আরেকটি। দুজনই নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে। লালা অমরনাথ ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম অধিনায়ক। ওয়াল্টার হ্যাডলিকে বুঝতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। খেলা ছাড়ার পর এত রকম ভূমিকায় নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে অবদান রেখেছেন যে তাঁকে ‘ফাদার অব নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট’-ও বলেন অনেকে। ‘মিস্টার নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট’ তো হরহামেশাই বলা হয়।
বিখ্যাত বাবার ছেলে হলে সুবিধা, না অসুবিধা? গত বিশ্বকাপের সময় রিচার্ড হ্যাডলিকে প্রশ্নটা করায় হেসে বলেছিলেন, ‘আমি তো বাড়তি খাতিরই পেয়ে এসেছি।’ সুরিন্দর অমরনাথ অবশ্য একবার বলেছিলেন, ‘লালা অমরনাথের ছেলে’ পরিচয়টা গর্বের, তবে তাঁর ঠোঁটকাটা স্বভাব কখনো কখনো অমরনাথ ভাইদের সমস্যার কারণ হয়েছে। লালার বাক্যবাণ যাঁদের গায়ে বিঁধেছে, তাঁরা ঝাল মিটিয়েছেন ছেলেদের ওপর।
হানিফ মোহাম্মদের মুখে প্রায় একই রকম কথা শুনেছিলাম। করাচিতে তাঁর বাড়িতে সাক্ষাৎকার দিতে বসে ছেলে শোয়েব মোহাম্মদের ক্যারিয়ার নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার কারণে ওকে অবিচারের শিকার হতে হয়েছে। খেলোয়াড়ি জীবনে যারা আমার শত্রু ছিল, তারা ওর ওপর শোধ নিয়েছে।’
পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটিং ‘গ্রেট’ হানিফ মোহাম্মদ ৫৫টি টেস্ট খেলেছেন, ছেলে শোয়েব ৪৫ টি। শোয়েবের ব্যাটিং গড় বাবার চেয়ে বেশি, কিন্তু বাবার খর্বকায় শরীরের দীর্ঘ ছায়া সব সময়ই ঢেকে রেখেছে তাঁকে। একটা ক্ষেত্রে অবশ্য মোহাম্মদ বাবা-ছেলে অনন্য। দুজনেরই টেস্টে দুটি করে ডাবল সেঞ্চুরি, ক্রিকেটের আর সব বাবা-ছেলের কাছে যা এখনো স্বপ্ন।
পাকিস্তান ক্রিকেটে বাবা-ছেলের গল্প বলতে গেলে মোহাম্মদদের সঙ্গেই আসে আরও দুটি নাম। মজার ব্যাপার হলো, সেখানেও বাবার নামের শেষে ‘মোহাম্মদ’। ছেলে অবশ্য সেই পদবি না নিয়ে বাবার নামটাই নিয়েছেন-নজর মোহাম্মদের ছেলে মুদাসসর নজর। হানিফ-শোয়েবের মতো এই দুজনেরও একটি অনন্য কীর্তি আছে। পাকিস্তানের পক্ষে ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যন্ত ব্যাটিং করার প্রথম কীর্তি নজর মোহাম্মদের। ৩১ বছর পর যেটির পুনরাবৃত্তি করেন ছেলে মুদাসসর নজর। বাবা-ছেলে দুজনেরই ব্যাট ক্যারি করার উদাহরণ এই একটিই। কাকতালীয়ভাবে দুটিই ভারতের বিপক্ষে।
ক্রিকেটে বাবা-ছেলে পরম্পরার ইতিহাস এমনই সমৃদ্ধ যে, এ নিয়ে আলাদা একটা বই-ই হতে পারে। দৈনিক পত্রিকার ক্ষুদ্র পরিসরে সেটি ধরানোর চেষ্টা করাটাই বোকামি। সেটি না করে বরং মজার একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ হোক।
বাবা-ছেলের গল্প তো বটেই, তবে এখানে তা দুই জোড়া। ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তানের হয়ে একসঙ্গে ব্যাটিং ওপেন করেছেন হানিফ মোহাম্মদ ও নজর মোহাম্মদ। এবার ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে এগিয়ে যান প্রায় তিন দশক। করাচিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নামছেন পাকিস্তানের দুই ওপেনার। তাঁদের নাম? শোয়েব মোহাম্মদ ও মুদাসসর নজর। পরিচয় তো আগেই হয়েছে-হানিফ আর নজরের দুই ছেলে!