বিতর্কিত রানআউটের পর পাকিস্তানের হারে আম্পায়ারের দোষও দেখছেন শোয়েব

শেষ ওভারের আগেও ফখরকে রান আউট করার সুযগ পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।ছবি: এএফপি

ফখর জামানের ইনিংসটি নিয়েই সব আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। স্রোতের বিরুদ্ধে যেভাবে একাই লড়েছেন পাকিস্তানি ওপেনার, এমন ইনিংসের দেখা যে বহুদিন পর মেলে। ৩৪১ রান তাড়া করতে নেমে একটি দলের একজন ছাড়া আর সব ব্যাটসম্যান মিলে তুলেছেন মাত্র ১০৬ রান। সে ম্যাচেও কিনা প্রতিপক্ষ জয় নিশ্চিত করতে পেরেছে ইনিংসের শেষ ওভারে। ৫০তম ওভারে ওই ফখরের আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত যত অসম্ভব মনে হোক না কেন, সিরিজের প্রথম ম্যাচে কাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তান হারবে—এ বাজি ধরা যাচ্ছিল না। ১৫৫ বলে ১৯৩ রানের ইনিংসটি এতটাই দুর্দান্ত ছিল তাঁর।

কিন্তু ইনিংস ছাপিয়ে এখন ফখরের আউটই বেশি আলো কেড়ে নিচ্ছে। ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া আউট নিয়ে যে ঝামেলা বেধেছে। শেষ ৬ বলে ৩১ রান দরকার ছিল পাকিস্তানের। প্রথম বলে ভালোভাবে ব্যাটে বলে হয়নি ফখরের। লং অফে বল যাওয়ায় দৌড়ে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। নিজে স্ট্রাইকিং প্রান্তে যাচ্ছেন বলে একটু হেলেদুলেই নিচ্ছিলেন দ্বিতীয় রান। লং অফে থাকা ফিল্ডার এইডেন মার্করাম সরাসরি বল পাঠালেন ফখরের প্রান্তেই। শেষ দিকে হুঁশ ফেরে ফখরের, তাড়াহুড়া করে ঢোকার চেষ্টা করেন ক্রিজে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

ঝামেলাটা বাঁধিয়েছেন কুইন্টন ডি কক। ফখর যখন উইকেটের মাঝে, তখন প্রোটিয়া উইকেটকিপার হাত তুলে বোলারের প্রান্তে থ্রো করতে বলছিলেন ফিল্ডারকে। সেটা দেখে ফখর পেছনে ফিরে তাকান। আবার ফিরে তাকিয়ে গতি বৃদ্ধি করার আগে মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হয়। এটাই তাঁর আউটে মূল ভূমিকা রেখেছে। এমন আউট নিয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা তাই অভিযোগ তুলেছেন। ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী ঘটনা ঘটিয়েছেন ডি কক—এমন অভিযোগ তাদের। সাবেক ক্রিকেটার শোয়েব আখতার আরও এক ধাপ এগিয়ে। তাঁর দাবি, গতকালের ম্যাচে আম্পায়ারদের দুই ভুলই হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানকে।

ডি ককের এই হাসি ভালো লাগেনি পাকিস্তান সমর্থকদের।
ছবি: এএফপি

গতকাল আউটের পরই শোয়েব টুইটারে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘কুইন্টন ডি ককের করা রানআউট কি খেলার চেতনাবিরোধী? সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।’ সঙ্গে ভোটে মতামত নিয়েছেন। তাতে ‘এটা ঠিক আছে’তে ভোট পড়েছে ৪৩.৬ ভাগ। আর ‘এটা খুব বাজে ব্যাপার ছিল’—এটায় সায় দিয়েছেন ৫৬.৪ ভাগ টুইটার ব্যবহারকারী। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে শোয়েব অবশ্য নিজের মতটা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি একে প্রতারণা বলব না। কিন্তু এটা ক্রিকেটের চেতনার সঙ্গে যায় না।’
সেই সঙ্গে ক্রিকেটের এ–সংক্রান্ত আইনে কী শাস্তি আছে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন।

কাল ডি কক যদি ফখরকে ইচ্ছা করে বিভ্রান্ত করে থাকেন, তবে সেটি আর শুধু তাত্ত্বিক চেতনাবিরোধী তর্কে আটকে থাকে না। কারণ, ক্রিকেটের আইনের ৪১.৫. ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ফিল্ডার ইচ্ছা করে নিজের কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা ব্যাটসম্যানের সঙ্গে চাতুরী করলে তাতে আইনের লঙ্ঘন ঘটবে।’ এতে ৫ রান জরিমানা এবং আবার বল করার নিয়ম আছে। ওই মুহূর্তে ৬ বলে ৩১ রানের সমীকরণে ছোটা পাকিস্তানের যে ৫ রান বাড়তি পেলে সুবিধা হতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সঙ্গে প্রায় দুই শ ছোঁয়া ইনিংস খেলা এক ব্যাটসম্যানকেও ক্রিজে পেত পাকিস্তান।

নিজের দলের হারটা যে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি শোয়েব সেটা পরের আরেক টুইটে টের পাওয়া গেছে। কাল ৪৭তম ওভারে আন্দিলে ফিকোয়াওর বলে কাভারে ক্যাচ দিয়েছিলেন ফখর জামান। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা হাত লাগিয়েও ধরতে পারেননি। নিজে উল্টো পড়ে যান, তাঁর মাথা থেকে হ্যাট আর সানগ্লাসও পড়ে যায়। বলটা গিয়ে এরপর বাভুমার ক্যাপের ওপর পড়ে। শোয়েব সে ঘটনায় পাকিস্তানের ৫ রান প্রাপ্য ছিল বলেই মনে করেন। টুইটে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানকে যে ৫ রান দেওয়া হয়নি, সেটা ভুললেও চলবে না। ফখর জামানের ক্যাচ ফসকানোর পর বল হ্যাটে পড়েছিল।’

ফিল্ডিংয়ের সময় মাঠে ফিল্ডিং দলের রাখা হেলমেটে বল লাগলে ৫ রান জরিমানা দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু ফিল্ডিং করার সময় মাথা থেকে পড়ে যাওয়া হ্যাটে বল লাগলেও জরিমানা করা যাবে, ক্রিকেটে এমন কিছু কেউ কখনো শোনেননি। ম্যাচটা কাল শেষ পর্যন্ত ১৭ রানে হেরেছে পাকিস্তান। শোয়েবের দেখানো হিসেবে গেলে ফখরের আউটের সময়ে আর এর আগে বাভুমার ওই ক্যাচের সময়ে আরও ১০ রান পেয়ে যেত পাকিস্তান! সে সঙ্গে উইকেটে ফখরের উপস্থিতি কে জানে আরও ৭ রান এনে দিতই পাকিস্তানকে।

শোয়েবের মতো এমন দফায় দফায় পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার কথা তোলেননি ওয়াকার ইউনিস। তবে পাকিস্তানের বোলিং কোচ ফখরের আউটের পর ডি ককের হাসিতে সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পেয়েছেন। টুইটারে ফখরের প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রেকর্ড ভাঙা ইনিংস। এককথায় দুর্দান্ত, ফখর জামান। কুইন্টনের এই মিচকে হাসি কী বলছে আপনাদের?’

পাকিস্তানিদের এতসব প্রশ্নের জবাব একাধিক টুইটে দিয়েছেন তাবরিজ শামসি। কাল ফখরের তাণ্ডবের সামনে নিজের কোটা পূরণ করতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকান এই বাঁহাতি লেগ স্পিনার। টুইটে নিজের দলের ব্যাটসম্যানের সঙ্গে ফখরের ইনিংসটির দারুণ প্রশংসা করেছিলেন এই স্পিনার। কিন্তু তাঁর টুইটে পাকিস্তানি সমর্থকেরা ‘প্রতারক’ বলে হামলে পড়লে খেপে যান শামসি। পরের টুইটেই কড়া জবাব দিয়েছেন, ‘রান শেষ না করে ব্যাটসম্যানের দৌড় থামিয়ে দেওয়া হাস্যকর মনে হয় না? সে একটা দারুণ ইনিংস খেলেছে, তাঁকে এর প্রাপ্যটা না দিয়ে মনোযোগ অন্য দিকে সরানো ঠিক হচ্ছে না। ওই মুহূর্তে একজন ব্যাটসম্যানের কাজ ছিল রান শেষ করা। একদম সহজ ব্যাপার।’

সে টুইটেও পাকিস্তানের সমর্থকেরা ক্রিকেটের ৪১.৫.৬ ও ৪১.৫.৭ ধারা অনুযায়ী ৫ রান জরিমানা কখন করা হয়, সে ব্যাখ্যা তুলে এনে খোঁচা দিচ্ছিলেন শামসিকে। এর জবাবে শামসি আবার টুইট করতে বাধ্য হন। সে টুইটে ডি কক কেন এ কাজ করেছিলেন, সেটারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই স্পিনার, ‘শুধু ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য বলছি। কুইন্টন ডি কক ব্যাটসম্যানের সঙ্গে কথা বলছিল না বা তাদের কোনো কিছু ইঙ্গিত করছিল না। সে একজন ফিল্ডারকে নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে ব্যাকআপ থাকতে বলেছিল। ব্যাটসম্যান রান শেষ না করে যে পেছনে ঘুরে কী হচ্ছে সেটা দেখা শুরু করল, সেটা তো এটা কুইন্টনের দোষ নয়। ব্যাটসম্যানের উচিত ছিল রান শেষ করা। ওকে (ডি কক) শুধু শুধু ঘৃণা করা বাদ দিন।’

এ ঘটনায় পাকিস্তান ২৪ ঘণ্টা সময় পাচ্ছে অভিযোগ করার। পাকিস্তান অনানুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে ম্যাচ রেফারির ও অফিশিয়ালদের কাছে জানতে চেয়েছিল। তাদের জানানো হয়েছে, ফখর প্রথম রান পূর্ণ করার আগেই ডি কককে ফিল্ডারের উদ্দেশে বোলিং প্রান্তে বল ছোড়ার আহ্বান জানাতে শোনা গেছে এবং নিজের প্রান্তের চেয়ে বোলিং প্রান্তেই মারা হোক, এটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেয়েছিলেন ডি কক। আম্পায়াররা ঘটনাটি বারবার দেখে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। ওদিকে ফখর নিজেও বলেছেন, অন্য প্রান্তে থাকা হারিস রউফ পরে দৌড় শুরু করায় রউফের সময়মতো ক্রিজে পৌঁছানো নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সেদিক থেকেও ডি ককের বারবার বোলিং প্রান্তে ছুড়তে বলার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেটপ্রেমীরা এতে সন্তুষ্ট হবেন?