বিশ্বকাপে বাংলাদেশের '৫৪'

বিশ্বকাপ খেলাটা যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্যই চরম ও পরম কাঙ্ক্ষিত এক ব্যাপার। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দেশের অভিষেকের পর থেকে এখনো পর্যন্ত ৪৫ জন বাংলাদেশি ক্রিকেটার সিক্ত হয়েছেন বিশ্ব আসরে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার গৌরবে। এবার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে দেশের পঞ্চম বিশ্বকাপে অভিষিক্ত হবেন আরও নয়জন। বিশ্বকাপ খেলা মানেই তো নিজেকে ইতিহাসের অংশ বানিয়ে ফেলা। প্রিয় পাঠক আসুন না, একবার স্মৃতির ডানায় ভর করে অতীতে চলে যাওয়া যাক। রোমন্থন করা যাক বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরা স্কোয়াডগুলোকে নিয়ে, স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের নিয়ে, যাঁরা নিজেদের বিশ্বকাপ-সৌভাগ্য দিয়েই স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।
বিশ্বকাপ ১৯৯৯
বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ খেলা দলটি স্বভাবতই আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের বাংলাদেশের স্কোয়াডটি ছিল এ রকম: আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, ফারুক আহমেদ, এনামুল হক, খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ, মো. রফিক, হাসিবুল ইসলাম, মঞ্জুরুল ইসলাম, শফিউদ্দিন বাবু, নিয়ামুর রশীদ, নাঈমুর রহমান, শাহরিয়ার হোসেন ও মেহরাব হোসেন।
দেশের প্রথম বিশ্বকাপ দলটি নিয়ে উঠেছিল আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের ঝড়। বাংলাদেশের টেস্ট-পূর্ব যুগের সেরা আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যান আতাহার আলী খান সেবার বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলেই সুযোগ পাননি। দল ঘোষণার পর দেখা গেল, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন সে সময় দেশের সেরা ব্যাটসম্যান মিনহাজুল আবেদীন। বয়সের কারণে নির্বাচকেরা তাঁকে সেবার রাখতে চাননি। কিন্তু মিনহাজুলের বাদ পড়া যে সারা দেশে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেবে, সেটা বোধ হয় বুঝতে পারেননি তাঁরা। পত্রপত্রিকায় বিতর্কের পর বিশ্বকাপ দলে হস্তক্ষেপ করেছিলেন খোদ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি নির্বাচকদের বলে-কয়ে মিনহাজুলকে দলের অংশ করেছিলেন দেশের মানুষের দাবির মুখে।
মিনহাজুলকে দলে রাখতে কোপ পড়েছিল বিশ্বকাপ দলে প্রথমে সুযোগ পাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের ওপর। নব্বইয়ের দশকে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সফল এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানকে সেবার ‘জাতীয় স্বার্থে’ বলি দিতে হয়েছিল আজন্ম লালন করা নিজের বিশ্বকাপ-স্বপ্নকে।
১৯৯৯ স্কোয়াডের আরও একটি মজার বিষয় হলো, এই বিশ্বকাপে আমিনুল হোসেনের নেতৃত্বে খেলেন বাংলাদেশে তিনজন সাবেক অধিনায়ক-আকরাম খান, ফারুক আহমেদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের স্থলাভিষিক্ত মিনহাজুল আবেদীন। তবে বিশ্বকাপ মিশনটা খুব একটা খারাপ যায়নি নবাগত বাংলাদেশ দলের জন্য। স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ের আনন্দ আস্বাদন করে বাংলাদেশ। মিনহাজুল নিজের অন্তর্ভুক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছিলেন তাঁর অনন্য পারফরম্যান্স দিয়েই।
বিশ্বকাপ ২০০৩
২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে প্রত্যাশার কমতি ছিল না দেশের মানুষের। সেই বিশ্বকাপের স্কোয়াডে অনেক নতুন মুখ থাকলেও বাংলাদেশ তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে নিয়মিত এবং টেস্ট খেলুড়ে দল বটে। প্রথমবারের মতো আফ্রিকা মহাদেশে অনুষ্ঠিত ২০০৩ -এর বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মাসুদ। তাঁর নেতৃত্বে স্কোয়াডের অন্য সদস্যরা হলেন খালেদ মাহমুদ, মো. রফিক, মঞ্জুরুল ইসলাম, হাবিবুল বাশার, আল-শাহরিয়ার, সানোয়ার হোসেন, তুষার ইমরান, এহসানুল হক, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তালহা যুবায়ের, হান্নান সরকার, অলক কাপালি, মোহাম্মদ আশরাফুল ও তাপস বৈশ্য। খালেদ মাসুদ, খালেদ মাহমুদ, রফিক ও মঞ্জুরুল ইসলাম ছাড়া দলে আর কারোরই বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না এই স্কোয়াডের। এ স্কোয়াডটিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। জাতীয় দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আকরাম খান বাদ পড়েছিলেন স্কোয়াড থেকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! এই আকরামকেই সেবার বিশ্বকাপে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোটগ্রস্ত মাশরাফি বিন মুর্তজার জায়গায়। তীব্র হতাশার ওই আসরে আকরাম ব্যাট হাতে শেষ ম্যাচটি প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন। কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে দারুণ খেলেই তিনি করেছিলেন ৪৪ । কানাডা-কেনিয়ার বিপক্ষে হার ছাড়াও সেবার বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশকে আস্বাদন করতে হয়েছিল লজ্জা আর বিপর্যয়ের তোতো স্বাদ।
বিশ্বকাপ ২০০৭
২০০৭ বিশ্বকাপটি বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য ক্রিকেটপ্রেমীরা আলাদা করে মনে রাখবেন নিশ্চয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বিশ্বকাপের নবম আসরে গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচে অন্যতম ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেয় বাংলাদেশ দল। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিশ্বকাপের মঞ্চ ত্যাগ করতে হয় ভারতকে। আর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টপকে যায় গ্রুপ পর্বের ওপারে। চমক লাগানো সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্কোয়াডে ছিলেন হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ রফিক, জাভেদ ওমর, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, শাহরিয়ার নাফীস, মুশফিকুর রহিম, ফরহাদ রেজা, রাজিন সালেহ, শাহাদাত হোসেন, সৈয়দ রাসেল, তামিম ইকবাল ও তাপস বৈশ্য। অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তাপস বৈশ্য ছাড়া স্কোয়াডের বাকি ১০ সদস্যই বিশ্বকাপে একদম নতুন। ২০০৭ বিশ্বকাপ স্কোয়াডের একটি অন্য রকম দিক হচ্ছে, ক্যারিয়ারের একেবারে শেষলগ্নে এসে জাভেদ ওমরের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হওয়া। এক দিনের ক্রিকেটে ১৯৯৫ সালে অভিষিক্ত জাভেদের বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা ছিল সেই ১৯৯৯ সালেই। কিন্তু টিম-কম্বিনেশনের কারণে তাঁর সেবার বিশ্বকাপ খেলা হয়নি, বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তাঁর ২০০৩ সালেও। ২০০৭ বিশ্বকাপ তাই জাভেদের জন্য ছিল অসম্ভব আবেগের। সেবার দলে ঢুকেছিলেন সাকিব-তামিম-মুশফিক ত্রয়ী। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান এই তিন তারকার অভিষেকের কারণে তাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০০৭ বিশ্বকাপ স্কোয়াড।
বিশ্বকাপ ২০১১
২০১১ বিশ্বকাপটিও বাংলাদেশের জন্য বিশেষ এক স্মরণীয় স্মৃতি। তিন আয়োজক দেশের একটি বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে স্বাগতিক হিসেবে প্রথমবারের মতো অভিষিক্ত বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপের স্কোয়াডটিতে ছিল নতুন-পুরোনোর মিশেল। ১৫ জনের স্কোয়াডটিতে ছিলেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফিস, জুনায়েদ সিদ্দিক, ইমরুল কায়েস, রকিবুল হাসান, শফিউল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, মাহমুদউল্লাহ, রুবেল হোসেন, নাঈম ইসলাম, নাজমুল হোসেন এবং সোহরাওয়ার্দী শুভ। গ্রুপ পর্বের খেলায় ভারতের কাছে হোঁচট খায় বাংলাদেশ। আরও যুক্ত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা। তবে স্মরণীয় ছিল চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ জয়ের স্মৃতি। আয়ারল্যান্ড ও হল্যান্ডকে হারিয়েও দেশবাসীর মৌলিক প্রত্যাশাটা ঠিকই পূরণ করেছিল বাংলাদেশ দল।
ঘোষিত হয়ে গেছে ২০১৫ বিশ্বকাপের স্কোয়াডও। বিশ্বকাপে একেবারে নতুন মুমিনুল হক, এনামুল হক, নাসির হোসেন, আল আমিন হোসেন, আরাফাত সানি, সাব্বির রহমান, তাসকিন আহমেদ, তাইজুল ইসলাম ও সৌম্য সরকারের সঙ্গে আছেন অভিজ্ঞ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ ও রুবেল হোসেন। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে সাকিব, মুশফিক ও তামিম প্রত্যেকেই গেছেন ১৫ টি করে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে। মাশরাফির থাকছে ১১ টি, মাহমুদউল্লাহর ৪ টি এবং রুবেল হোসেনের ঝুলিতে থাকছে বিশ্বকাপ ম্যাচের অভিজ্ঞতা।