বিশ্বকাপে রঙিন, করোনায় ধূসর

ইতিহাসের পাতায় ২০২০ সাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে করোনার বছর হিসেবে। তার মধ্যেও নতুন স্বাভাবিকতায় মাঠে খেলা ছিল। ছিল মাঠ ও মাঠের বাইরে আনন্দ–বেদনার কাব্য। সেসব নিয়েই ফিরে দেখা ২০২০

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হাত ধরেই প্রথম বৈশ্বিক শিরোপা এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটেফাইল ছবি

বছরটা হতে পারত ক্রিকেটে ঠাসা। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সমারোহ ছিল আইসিসির ভবিষ্যৎ সফর পরিকল্পনায়। করোনাভাইরাস এসে গ্রাস করে ফেলল সারা বছরের ক্রিকেটই। যা একটু খেলা হয়েছে, সেটা বছরের শুরু ও শেষে। মাঝের সাত-আট মাস কাটে ক্রিকেটে ফেরার অপেক্ষায়।

বছরটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জন দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আকবর আলীর অনূর্ধ্ব-১৯ দল ভারতকে হারিয়ে জয় করে যুব বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিছু একটা করে বসবে, এমন বিশ্বাস ছিল যুবা ক্রিকেটারদের। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। কিন্তু কে জানত, এমন রঙিন শুরুর পর ২০২০ সালটাই হয়ে যাবে ধূসর!

বাংলাদেশের কম টেস্ট খেলার হাহাকার অনেক দিনের। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কারণে ২০২০ সালের চিত্রটা ছিল উল্টো। দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশের ১০টি টেস্ট খেলার কথা ছিল এ বছর। এক বছরে এত টেস্ট আগে কখনো খেলেনি বাংলাদেশ দল। অথচ শেষ পর্যন্ত খেলা হলো কিনা মাত্র দুটি টেস্ট! ফেব্রুয়ারির শুরুতে পাকিস্তান সফরে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হার। এরপর দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় ইনিংস ব্যবধানে।

পাকিস্তানে ফিরতি সফরে আরও একটি টেস্ট খেলার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও টেস্ট সিরিজ ছিল ঘরের মাঠে। শ্রীলঙ্কা সফরে ছিল তিন টেস্টের সিরিজ। শ্রীলঙ্কা সফরটা আগামী এপ্রিলে হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে আবার কবে ঘরের মাঠে আনা যাবে কে জানে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলার সুযোগ বাংলাদেশের খুব একটা হয় না। সেদিক থেকে করোনায় বড় ক্ষতিই হলো বাংলাদেশের।

সাদা বলের ক্রিকেটেও বছরটা হতে পারত ব্যস্ততার। এ বছরই হওয়ার কথা ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ ক্রিকেট। করোনায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেছে দুই বছর। ২০২০ অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটি এখন হবে ২০২২ সালে। এক বছর পিছিয়ে গেছে এশিয়া কাপও।

বিশ্বকাপ মাথায় রেখেই দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলোর সূচিতেও ছিল টি-টোয়েন্টির আধিক্য। বছরের শুরুতে পাকিস্তানে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারে বাংলাদেশ দল। এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টিতে প্রত্যাশিত জয়। মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ব একাদশ ও এশিয়া একাদশের দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। বিশ্ব ক্রিকেটের তারকাদের মিরপুরে এক করাই ছিল বিসিবির উদ্দেশ্য। এপ্রিলে ইংল্যান্ডের মাটিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও চার টি-টোয়েন্টি। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ হলে তার আগে নিউজিল্যান্ডেও টি-টোয়েন্টি সফরে যেত বাংলাদেশ। কিন্তু সবই গেছে করোনার পেটে।

বাংলাদেশ এ বছর ওয়ানডে খেলেছে মাত্র তিনটি। তিনটিই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর এক বছরে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ওয়ানডে খেলার রেকর্ড। তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটি স্মরণীয় করে রাখেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফির অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে সেই সিরিজে। অধিনায়ক মাশরাফির শেষ সিরিজটি রাঙিয়েছেন তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। দেশের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরের নিজের রেকর্ডটি নতুন করে গড়েন তামিম। পরের ম্যাচেই সেই রেকর্ড ভাঙেন লিটন।

ফেব্রুয়ারি-মার্চের জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর শুরু হয় ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু এক রাউন্ড খেলার পরই করোনার ঝুঁকিতে লিগ বন্ধ হয়ে যায়। মাঠে খেলা থাকলেও ক্রিকেটাররা এ সময় নানাভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন দুস্থ মানুষের। অনেকে নিলামে নিজেদের স্মারক বিক্রি করে সাহায্য করেছেন করোনা দুর্গতদের। ঘরবন্দী সময়ে ক্রিকেটারদের বড় দুশ্চিন্তা ছিল ফিটনেস নিয়ে। ক্রিকেটাররা বাড়িতেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফিটনেস ধরে রাখার কাজ করেছেন।

অক্টোবরে শ্রীলঙ্কা সফর দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। কিন্তু অনেক নাটকীয়তার পর স্থগিত হয়ে যায় সফর। তবে অক্টোবরেই বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররা মাঠে ফেরেন। এরপর হয় বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। আইসিসির নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেয়ে সাকিব আল হাসান এক বছর পর ক্রিকেটে ফিরেছেন এই টুর্নামেন্ট দিয়েই। তবে ক্লাব ক্রিকেট খেলে জীবিকা উপার্জন করা ক্রিকেটারদের জন্য বছরটা দুঃস্বপ্নেরই রয়ে গেছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট বন্ধ থাকায় অনেক ক্রিকেটারই ভুগছেন আর্থিক সংকটে।

ভুগতে হয়েছে নারী ক্রিকেটারদেরও। বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এশিয়া কাপ, নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো বড় তিনটি টুর্নামেন্টই পিছিয়ে যায়। এবারই প্রথমবারের মতো নারী অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল। আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। করোনায় সেটিও হতে পারেনি। বছরের শেষে উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জে জাহানারা আলম ও সালমা খাতুনের পারফরম্যান্স নারী ক্রিকেটে কিছুটা স্বস্তি আনে। এ ছাড়া বছরজুড়ে নারী ক্রিকেট ছিল স্থবির।