বিশ্বাস রেখো যে তোমরা পারবে...

আমরাও পারি—এ বিশ্বাসটা থাকুক বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরছবি: বিসিবি

জিততে হলে কী চাই? জীবনের পরীক্ষা আর অলিম্পিক কি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রতিযোগিতা এক নয়। জীবনের পরীক্ষায় ফলের আশা না করে কাজ করে যাওয়া ভালো। গন্তব্য নয়, পথকেই মোকাম করে তোলাটা শ্রেয়তর; তাতে জীবন সার্থক হয়, সুন্দর হয়, আনন্দপূর্ণ হয়! জীবনের পরীক্ষায় প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, টাইব্রেকারের দরকার পড়ে না। কিন্তু বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে একটা দল, বাকি প্রতিটা দলকে চ্যাম্পিয়নের নিচে থাকতে হবে। এই সব প্রতিযোগিতায় ভালো করার মন্ত্রটা কী?

আমার নিজের ধারণা, জিততে হলে চাই স্বপ্ন, পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি। আমাকে চাইতে হবে যে আমি চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। বেইজিং অলিম্পিকে যে চীন সবচেয়ে বেশি সোনা জিতল, তার কারণটা হলো, তারা অনেক আগে থেকেই জানত, খেলাটা হবে চীনে, আর তাতে ভালো করতে হবে, আর সে জন্য এক যুগ আগে থেকেই তারা শুরু করে দিয়েছিল টার্গেট ধরে ধরে প্রস্তুতি। ফুটবলে বা ক্রিকেটে যারা চ্যাম্পিয়ন হতে চায়, তাদের সবারই সেই লক্ষ্যটা স্থির থাকে আগে থেকেই, সে অনুযায়ী নেওয়া হয় প্রস্তুতি, ব্যাপক পরিকল্পনা, অনুশীলন, সাধনা। এই সাধনা–প্রস্তুতি অনেকগুলো দল করে, এদের মধ্যে সবাই চ্যাম্পিয়ন হয় না বটে, কিন্তু যারা প্রস্তুতি নেয় না, সাধনা করে না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য বুকে পুষে রাখে না, নিজেকে উজাড় করে দেয় না, তাদের কেউই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না।

খেলোয়াড়েরাও নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি ভরসা রাখুক
ছবি: বিসিবি

প্রথম কথাটা হলো, আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে চাই কি না। দুই নম্বর কথাটা হলো আত্মবিশ্বাস, আমি কি মনে করি, আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা আছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। বহু ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে, একটা দেশ একটা খেলায় ভালো করবে কি করবে না, তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য বলে নিজেদের মনে করবে কি না, স্বপ্ন বুনবে কি না, স্বপ্ন অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে কি না। সৌদি আরব কিংবা ইরাক বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য এক যুগের পরিকল্পনা করে এগোলে কি সফল হবে? এর উত্তর: না। কিন্তু যদি তারা লক্ষ্য স্থির না করে, চেষ্টা না করে, নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস না-ই রাখে, তাহলে যে কোনো দিনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না, তা আমরা জানি।

বাংলাদেশ ভালো করবে ততটাই, যতটা বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখবে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ কি ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি কিংবা এক দিনের ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে? কেন নয়? আমাদের উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে; এদের মধ্যে ভাত খাওয়া আর রুটি খাওয়া—সব ধরনের খেলোয়াড় আছে। আমরা মাঝেমধ্যেই বড় বড় দলকে হারাই, হোয়াইটওয়াশও করি। মানে, ভৌগোলিক অবস্থান, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দিক থেকে বাংলাদেশ একটা ক্রিকেটিং দেশ, আর সবচেয়ে বড় হলো এই দেশের মানুষের ক্রিকেটপ্রেম। আমাদের ক্রিকেটভক্ত ছড়িয়ে আছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, গণভবন থেকে বঙ্গভবন।

এখন দরকার স্বপ্ন দেখা। তারপর লক্ষ্য নির্ধারণ। তারপর পরিকল্পনা, কর্মপন্থা। আমরা দেখি যে বিকেএসপি থেকে অনেক খেলোয়াড় তৈরি হয়। আমরা দেখি যে অনেক বড় হিমালয় রেঞ্জ থাকলেই এভারেস্ট পাওয়া যায়। আমাদের বয়সভিত্তিক ক্রিকেট দরকার। জেলায় জেলায় ক্রিকেটচর্চা দরকার। স্কুলভিত্তিক টুর্নামেন্ট দরকার।

দেশের মানুষ হাসুক, ক্রিকেট দলের সাফল্যে
ফাইল ছবি

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে প্রবর্তিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে বহু মেয়ে ফুটবলার উঠে আসছে। আর সেই মেয়েরা যখন একসঙ্গে ট্রেনিং ক্যাম্পে থেকে খেলছে, ট্রেনিং নিচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভালো করছে।

শ্রীলঙ্কা যে ওডিআইতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বিশ্বকাপে, তখন রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে দলের খেলোয়াড়েরা বহু দিন অভিন্ন টিমে একসঙ্গে খেলেছিলেন। ব্রাজিলে গিয়ে জার্মানি বিশ্বকাপ ফুটবল জিতে এল, কারণ, তারাও ব্রাজিলের একটা দ্বীপে গিয়ে বহু দিন আগে থেকে নিবিড় অনুশীলন করেছিল। আমরা যদি জাতীয় পর্যায়ে বয়সভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে একটা বড়সড় বালক টিম গড়ে বহু বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিই, সেখান থেকে খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবেই।

এখন প্রশ্ন হলো, এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেমন করবে? আমি বলি, বাংলাদেশ ততটাই ভালো করবে, যতটা তারা স্বপ্ন দেখে, আশা করে, যতটা ওপরে ওঠার লক্ষ্য তারা নির্ধারণ করেছে, যতটা আত্মবিশ্বাস তারা বুকে ধারণ করে। জয়ের জন্য চাই জিগীষা। জয় করবার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা। তারপর দরকার মরিয়া চেষ্টা।

একবারে কেউ পুরো টুর্নামেন্ট খেলে না। খেলতে হবে বল বাই বল, ওভার বাই ওভার, ম্যাচ বাই ম্যাচ। কাজেই স্বপ্ন বড় হওয়া উচিত। সাকিব আল হাসানের সেই কথাটা এখানে আসবে, যা ঘটা সম্ভব, তা চাওয়া স্বপ্ন নয়; যা হবে না বলে সবাই ভাবছে, সেটা করতে চাওয়াই স্বপ্ন।

কাজেই আসুন বড় স্বপ্ন দেখি। বিশ্বকাপ খেলতে আরব দেশে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে ভালোভাবেই হারিয়েছে, নিজের দেশে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারানোটাও তাদের মনোবল উঁচু রাখছে। প্রস্তুতি ম্যাচে ওমানের সঙ্গে খেলাতেও অনুশীলনটা ভালোই হলো। আইপিএলে সাকিব আর মোস্তাফিজের পারফরম্যান্স আমাদের আশার সলতে উসকে দিচ্ছে। এত দিন আমরা ভাবতাম, আমরা টি–টোয়েন্টি ভালো খেলি না, এবার মনে হচ্ছে খেলাটা আমরা শিখে উঠতে পারছি।

কাজেই আমরা আশা ছাড়ছি না। আমরা আরাম করে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বসে খেলা দেখব। খেলা দেখাটাই উপভোগ করব। খেলা হচ্ছে এশিয়ায়। এশিয়ার কেউই চ্যাম্পিয়ন, এটাই তো হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আফগানিস্তান শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান ভারত...

বাংলাদেশ যদি ভালো করতে থাকে, আমাদের আর পায় কে? যদি অনেক দূর এগোয়, আমরা বলব, শাবাশ, শাবাশ। যদি এশিয়ার অন্য কেউ চ্যাম্পিয়ন হয়, আর আমাদের সেটা চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়, তাহলে কী বলব? তাহলে বলব, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সেই কৌতুকটা। এক যুবকের খুব মনখারাপ। তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, মন খারাপ করিস না, ওকে যে পেয়েছে, সে–ও তো পুরুষ। কোনো একজন পুরুষই তো তাকে পেয়েছে। আমাদের পুরুষবন্ধু।

আর যদি আমাদের প্রতিবেশীদের কেউ চ্যাম্পিয়ন না হয়? তাহলে ওই কৌতুকটা মনে করব—আলাদিনের দৈত্য বলল, আপনি যা চাইবেন তা পাবেন, তবে আপনার প্রতিবেশী সেটাই ডাবল পাবে। অনেক ভেবে লোকটা বলল, আমার একটা চোখ কানা করে দিন...

না। আমরা এবার ভালো করব। বিশ্বাস রাখুন। সাধনা করুন। নিজেকে উজাড় করে দিন। খেলাটা সব সময় গায়ের জোর দিয়ে হয় না। তাহলে মেসি নেইমার শচীন টেন্ডুলকার পেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হতেন না। নতুন আর অভিজ্ঞয় গড়া আমাদের এবারের টিম ভালো। তারা ভালো করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

উফ্ফ! আবার আসছে চার-ছক্কা হইহইয়ের দিন। করোনার কোপে জর্জরিত জীবনে আনন্দ আর উত্তেজনার উপলক্ষ। ছোট ক্রিকেটের বড় আসর। বিশ্বকাপ আসে, বিশ্বকাপ যায়, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি মধুর হয়েই থাকে। এবারেরটাও আমাদের জীবনে সেই মাধুর্যের স্পর্শ দিয়ে যাবে। আর শিশির যেমনটা বলেছেন সাকিবকে, টিভি বিজ্ঞাপনে, আমরাও তেমনি করে বলি মাহমুদউল্লাহদের, তোমরা বিশ্বাস রেখো যে তোমরা পারবে...

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক