বিস্মৃত হবেন, এটাই যেন ভাগ্য সৈকতের

আজ দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন সৈকতছবি: প্রথম আলো

ডেভ হোয়াটমোর বাংলাদেশ দলের কোচ থাকতে কথাটা বলেছিলেন সাকিব আল হাসানকে নিয়ে। সাকিব তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবে পা রেখেছেন। ব্যাট-বলে সব্যসাচী হওয়ায় তাঁকে ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার’ বলেছিলেন হোয়াটমোর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও সাকিবের মতোই নতুন। খেলাটির গতিপ্রকৃতি ও ধাঁচ-ধরন বিচারে পরে দেখা গেল, হোয়াটমোরের সেই ‘ইউটিলিটি’ ক্রিকেটাররাই বেশি করে দলের কাজে আসছেন।

কারণটা সহজ—টি-টোয়েন্টিতে একই সঙ্গে ব্যাটিং-বোলিংয়ে দক্ষ ক্রিকেটারের আবেদন বেশি। ম্যাচের যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো যায়। সাকিব স্পিনার হয়ে ওঠার পর তাঁকে যেমন বোলিংয়ে যেকোনো সময় কাজে লাগানো যায়, ব্যাটিংয়েও খেলানো যায় যেকোনো পজিশনে। অর্থাৎ দলের প্রয়োজনে যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো পজিশনে ভূমিকা রাখতে পারা খেলোয়াড়েরাই ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার’।

সৈকত আলীকে দেখে হোয়াটমোরের এই কথা নিশ্চয়ই মনে পড়েছে অনেকের। ৩৪ বলে ৫৮ রানের ইনিংসের পরও যিনি থেকে যাবেন আড়ালে।

অর্ধ শতকের পর সৈকত
ছবি: প্রথম আলো

সৈকত আলী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ২০০৮ সালে, ১৫ পূর্ণ হওয়ার আগেই। ২০১৩ সালে অভিষেক ঘটে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সৈকত কখনো ওপেনার, কখনো তিনে-চারে নামা ‘পাকা’ ব্যাটসম্যান, কখনো আবার ম্যাচ ফিনিশ করে আসা ছয়-সাতের ব্যাটসম্যান।

এর সঙ্গে মিডিয়াম পেসও ভালোই করেন। প্রাণ কমিকের সেই ‘চাচা চৌধুরী’র মতো প্রখর (ক্রিকেট) মস্তিষ্কের অধিকারী ফরচুন বরিশাল অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আজ বিপিএল ফাইনালে সৈকতকে নিয়ে জুয়া খেলে প্রায় জিতেই গিয়েছিলেন!

বিপিএলে এবার সৈকত ফাইনালের আগে দুটি ম্যাচ খেলেছেন। নিয়মিত ওপেনার মুনিম শাহরিয়ারের জায়গায় তাঁকে ওপেন করিয়ে তেমন ফল পাননি সাকিব। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের বিপক্ষে ৬ বলে মারলেন ‘ডাক’ এবং তার আগে মিনিস্টার ঢাকার বিপক্ষে ১৮ বলে ১৫। এর আগে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ৩৫ বলে করেছেন ৩৯ রান। মোটেও আহামরি কোনো পারফরম্যান্স নয়। তবু ফাইনালে পেস-অলরাউন্ডার জিয়াউর রহমানকে বসিয়ে সৈকতকে খেলায় বরিশাল টিম ম্যানেজমেন্ট।

গেইল ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন আজ
ছবি: প্রথম আলো

ক্রিস গেইলের সঙ্গে মুনিম থাকায় এবার আর ওপেনার হিসেবে নয়, যে পজিশনে দলের ভার টানতে হয় সবচেয়ে বেশি, সে জায়গায়—তিনে! তাতে ফলটাও মিলেছে হাতেনাতে। সৈকতের ৩৪ বলে ৫৮ রানের ইনিংসে বরিশাল জয়ের পথে ছুটেছে দুর্দান্ত গতিতে।

দ্বিতীয় ওভারে মুনিম শূন্য রানে আউট হওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নামেন সৈকত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার অভিজ্ঞতা নেই, ওদিকে প্রতিপক্ষ দলে মোস্তাফিজুর রহমান, সুনীল নারাইন ও মঈন আলীর মতো আন্তর্জাতিক তারকারা—সৈকতের মাথায় পাহাড়প্রমাণ চাপ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বিষয় তাঁর পক্ষে ছিল—শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে এক দশকের বেশি সময় কাটিয়ে দেওয়ার সুবাদে শেরেবাংলার বাইশ গজের চরিত্র সৈকতের নখদর্পণে। আর তাই বলের চরিত্র বুঝে সৈকতের খেলা শটগুলো আজকের ফাইনালে নিঃসন্দেহে সবার চোখে লেগে থাকবে।

আজ সোইকত শুরু থেকেই ছিলেন আগ্রাসী
ছবি: প্রথম আলো

মুনিমকে ফিরিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসে ফুটছিলেন কুমিল্লা পেসার শহীদুল। প্রথম বলে সৈকতকে বেশ ভালোভাবে পরাস্ত করেছেন। শহীদুলের করা ওই ওভারেই সৈকত মেরেছেন টানা তিন চার। প্রথম ‘পুল’টি ছিল চোখে লেগে থাকার মতো—পেছনের পায়ে ভর দিয়ে শটটি খেলার সঙ্গে শরীর ঘুরেছে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। বল একটু থেমে আসায় কোনো শটই আগেভাগে খেলার চেষ্টা করেননি।

নাসের হুসেইনের ভাষায়, ‘ভালো ব্যাটসম্যানরা সব সময় বল দেরিতে খেলেন’—সৈকতের যেন তা মনে পড়ে গিয়েছিল! আর তাই পয়েন্ট, কাভার ও স্ট্রেট দিয়ে সৈকতের খেলা শটগুলো দেখে মনে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞ কেউ খেলছেন! যদিও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গত মৌসুমেও তিনে-চারে নেমে বিস্ফোরক সব ইনিংস খেলেছেন সৈকত। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ কে মনে রাখে, বিপিএলই যে মানুষের ঘরে পৌঁছায়!

আবু হায়দার, নারাইন, মোস্তাফিজ—কাউকেই ছাড় দেননি সৈকত। ওভারে দু-তিনটি করে চার মেরেছেন। তাঁর ব্যাটিংয়ের ভাষা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, কুমিল্লার ইনিংসে নারাইনের মতো সৈকতকেও ‘০০৭—লাইসেন্স টু কিল’ ছাড়পত্র দিয়ে নামিয়েছিল বরিশাল।

সৈকত আজ চমকে দিয়েছেন সবাইকে
ছবি: প্রথম আলো

নারাইনের মতো সৈকত অসুন্দর কিন্তু নির্মম ব্যাট করেননি, বরং বলা ভালো ভয়াল সুন্দর ব্যাট করেছেন। আর তাই টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের শেষ কথা হিসেবে স্বীকৃত ‘ইউনিভার্স বস’ গেইলও সৈকতের সঙ্গে প্রমাণ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েন। ৭ ওভার শেষে সৈকত যখন ২৭ বলে ৫৫ রানে অপরাজিত, গেইল তখন অন্য প্রান্তে ৮ বলে ৫!

সপ্তম ওভারে আবু হায়দারকে টানা ৩ চার মারার পথে ২৬ বলে অর্ধশতক তুলে নেন সৈকত। ১০তম ওভারে সীমানায় ইমরুল কায়েসকে ক্যাচ দিয়ে যখন ফিরছিলেন, ম্যাচটা ততক্ষণে সহজ হয়ে এসেছে বরিশালের জন্য। বাকি ১০ ওভারে দরকার ৭১। বোঝাই যাচ্ছিল, সৈকতকে ‘বাজির ঘোড়া’ বানিয়ে সাকিবের ‘আড়াই প্যাঁচে’ ম্যাচে পিছিয়ে পড়েছে কুমিল্লা। এরপর জয়ের বাকি কাজটুকু সেরে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল গেইল, সাকিব ও ব্রাভোদের।

আন্তর্জাতিক তারকা হয়েও তাঁরা কাজটা করতে পারেননি। বরিশালও প্রথম বিপিএল শিরোপা জয়ের সুবাস পেতে পেতে হারিয়ে ফেলেছে। সে সুবাদে নারাইনই ম্যাচের নায়ক, আর আড়ালে সৈকত।

হ্যাঁ, সৈকতের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটারদের সবাই ভুলে যায়। এটাই নিয়তি।