বেকার খাটনির এক দিন

প্রতিপক্ষের দাপট দেখে দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশ।ছবি: এএফপি

হঠাৎ হেসে উঠলেন তাসকিন আহমেদ। পড়ে আসা আলোর ওই দৃশ্য দেখে হাসি আসাটাই স্বাভাবিক। প্রথম আবু জায়েদের হাতে বল দিয়েছিলেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা লাইটমিটার বের করে বললেন, আলো ঠিক আছে, খেলা চালানো যাবে। মুমিনুল মত বদলে বল তুলে দিতে চাইলেন তাসকিনের হাতে। তাসকিন বোলিং মার্কে গিয়ে অপেক্ষা করতে করতেই ধর্মসেনার মতও বদলে গেল। বললেন মাঠে আলোকস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। আলোর অভাবে দ্বিতীয়বারের মতো মাঠ ছেড়ে উঠল দুই দল।

তাসকিন তাই হেসে ফেললেন। তা দেখে একটু স্বস্তিও মিলল, যাক দল মানসিকভাবে এখনো ভেঙে পড়েনি তাহলে। না হলে পাল্লেকেলেতে আজ যেমন দিন কাটাল বাংলাদেশ, তাতে মুখ থেকে হাসি উবে গেলেও কিছু বলার ছিল না। শেষ সেশনে দুইবার আলোর অভাব খেলা থামিয়ে দিয়েছে বলে ‘পুরো দিন’ শব্দযুগল ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তবু যতটুকু খেলা হয়েছে, সেটাই যেকোনো দলকে হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়ার মতো।

৩ উইকেটে ২২৯ রানে দিন শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কা। চতুর্থ দিন শেষে লঙ্কানদের রান ৫১২। এই ২৮৩ রান তুলতে খরচের খাতায় কিছু লিখতে হয়নি শ্রীলঙ্কাকে। আগের দিনের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যানই আজ ড্রেসিংরুমে ফিরলেন। সারা দিনে ৭৬ ওভার বল করেও কোনো উইকেটের দেখা পাননি তাসকিন-মিরাজ-তাইজুলরা।

করুনারত্নে ও ধনঞ্জয়া আজ সারাদিন ব্যাট করেছেন।
ছবি: এএফপি

পাল্লেকেলের উইকেট যে ব্যাটিং সহায়ক, সেটা বুঝতে কোনো ক্রিকেট বিশ্লেষক বনতে হয় না। প্রথম দুই দিনে বাংলাদেশের ব্যাটিং সেটা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। গতকাল শেষ বিকেলে তাইজুলের বলের ঘূর্ণি ভিন্ন কিছুর আভাস দিলেও বাংলাদেশি স্পিনার কালই সতর্ক করেছিলেন ওসব বিভ্রম। পাল্লেকেলের উইকেট আজও বদলাবে না বলে সতর্ক করেছিলেন তাইজুল। বলেছিলেন, তাঁরা শুধু ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলিত বোলিং করতে চান।

সমস্যা হলো, এটা এমনই এক উইকেট যেখানে রান আটকে রাখার উপায় নেই। দলে ভালো স্পিনার নেই বলে স্পিনবান্ধব উইকেট বানানোর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে শ্রীলঙ্কা। আর তাতে এমন এক উইকেটের দেখা মিলেছে, যা রেকর্ড বইয়ে নাম লিখিয়ে ফেলা এক টেস্টের জন্ম দিয়েছে। এক পরিসংখ্যান জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে এই টেস্টের আগ পর্যন্ত কোনো টেস্টে উইকেটপ্রতি সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল ৪৪.৭০। কাল হয়তো অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাল্লেকেলে টেস্টে ব্যাটসম্যানরা গড়ে ১০০ রান তুলেছেন!

২০১৪ সালের সীমারেখা মুছে ফেললে শ্রীলঙ্কায় এমন রানবন্যা আর একবারই দেখেছিল। কোন টেস্টের কথা হচ্ছে, অনেকেরই বুঝে ফেলার কথা। ১৯৯৭ সালে ভারতের ৫৩৭ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা যখন ৯৫২ রান তুলেই তবে ক্ষান্ত হয়েছিল! সে ম্যাচে উইকেটপ্রতি ১০০.৬৪ রান তুলতে দেখা গিয়েছিল। শুধু শ্রীলঙ্কাতেই কেন, ক্রিকেট ইতিহাসেই এমন রানপ্রসবা ম্যাচ খুব কম দেখা গেছে। উইকেটপ্রতি রান তোলায় ইতিহাসে আপাতত চারে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার এই টেস্ট।

ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি পেয়েছেন করুনারত্নে।
ছবি: এএফপি

এমন এক টেস্টে অপ্রিয় কিছু রেকর্ড যে বাংলাদেশের কপালে জুটবে, তাতে আর বিস্ময় কী। ১৯০ রানে তৃতীয় উইকেট পতনের পর জুটি গড়েছিলেন দিমুথ করুনারত্নে ও ধনঞ্জয়া ডি সিলভা। ৩২২ রান তোলার পরও অবিচ্ছিন্ন আছেন তারা। বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোনো উইকেট জুটিতে এর চেয়ে বেশি রান তোলার রেকর্ড আছে আর মাত্র চারটি।

টেস্টে নিজের সেরা ইনিংসটি বাংলাদেশের বিপক্ষেই খেলেছেন ধনঞ্জয়া। চট্টগ্রামে তিন বছর আগে ১৭৩ রানের সে ইনিংসের পর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দেড় শ ছাড়ানো ইনিংসটিও বাংলাদেশের বিপক্ষেই খেলেছেন এই অলরাউন্ডার। ১৫৪ রানে অপরাজিত আছেন তিনি। তাঁর সঙ্গী দিমুথের গল্পটা ভিন্ন। পাল্লেকেলে টেস্টের প্রথম বল থেকেই মাঠে আছেন। ১৭৩ ওভার ফিল্ডিং করার পর ১৪৯ ওভার ধরে ব্যাটিং করছেন। সে সুবাদে ব্যক্তিগত একটা অর্জনও বুঝে নিয়েছেন। টেস্ট ক্যারিয়ারে এর আগে একবারই দুই শ ছোঁয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুবাইয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ৪ রানের জন্য সে মাইলফলক ছুঁতে পারেননি করুনারত্নে।

আজ দুই আলোক স্বল্পতার বিরতির মাঝেই সে দুঃখ ঘুচেছেন করুনারত্নে। অপরাজিত আছেন ২৩৪ রানে। লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের এই দাপটে তাই চতুর্থবারের মতো টেস্ট উইকেটশূন্য দিনের দেখা পেল বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার ২০০৩ ও ২০০৮ সালে দুবার চট্টগ্রামের দুই ভেন্যুতে বাংলাদেশের বোলারদের এভাবে খাটিয়ে মেরেছিল। ২০০৭ সালের ঘটনাটি এর চেয়েও অদ্ভুত ছিল। ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে মোট চারজন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বল করেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। কিন্তু দুই ওপেনার দীনেশ কার্তিক ও ওয়াসিম জাফরকে আউট করতে পারেননি মাশরাফি-রফিক-সাকিবরা। দুজনই আহত অবসর হয়েছিলেন। ফলে সারা দিন বল করেও কোনো উইকেটের দেখা পায়নি বাংলাদেশ।

১৩ বছর পর আবার এমন কিছুর দেখা পেল বাংলাদেশ।