বোলারদের বাঁশ দিয়ে ‘পেটাতে’ বলছেন বিজ্ঞানীরা
‘পেটানো’ শব্দে আপত্তি উঠতে পারে। কিন্তু আপামর জনতা, সেটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়—বিশ্বের সব ক্রিকেট জাতিই হয়তো খেলার উত্তেজনার সময়ে দলের ব্যাটসম্যানদের পেটাতেই বলেন!
এই পেটানোর কাজটা ব্যাটসম্যানরা ব্যাট দিয়ে করেন। বোলারদের ছুড়ে দেওয়া চর্মগোলককে সীমানার বাইরে পাঠানোর সেই ‘অস্ত্র’ আবার বানানো হয় কাঠ দিয়ে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে উইলো কাঠ দিয়ে। সাধে তো আর ক্রিকেট সাহিত্যিকেরা সুযোগ পেলেই ব্যাটের প্রতিশব্দ হিসেবে উইলো ব্যবহার করেন না! ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে যে ব্যাট আর উইলো একে–অপরের পরিপূরক—সেই ঐতিহ্যে এবার বাদ সাধতে চাইছেন কিছু বিজ্ঞানী।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা জানাচ্ছে, উইলোর ব্যাট নয়, বরং বাঁশের তৈরি ব্যাটই ব্যাটসম্যানদের জন্য বেশি উপকারে আসবে। কেন? কারণ পরীক্ষায় দেখা গেছে বাঁশের তৈরি ব্যাট বেশি শক্ত, কাঠের ব্যাটের চেয়ে ভালো ‘সুইট স্পট’ দেয়, আর বলে বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে সাহায্য করে। সহজ ভাষায়, বল পেটাতে বেশি উপযোগী এই বাঁশের ব্যাট।
ক্রীড়া প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সাময়িকীতে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। কেমব্রিজের প্রাকৃতিক উপাদান উদ্ভাবন সেন্টারের বিজ্ঞানীরা গবেষণা শেষে বলছেন, প্রথাগত উইলোর বদলে বাঁশের তৈরি ব্যাট ব্যবহারের কথা ভেবে দেখা উচিত সবার। ডক্টর দার্শিল শাহ ও বেন টিঙ্কলার-ডেভিস প্রলেপযুক্ত বাঁশের ক্রিকেট ব্যাট ও প্রথাগত ক্রিকেট ব্যাটের পারফরম্যান্স তুলনা করে দেখেছেন। আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, ভিডিও প্রযুক্তি, কম্পিউটার মডেলিং, সংকোচন পরীক্ষা, ব্যাটের পৃষ্ঠের দৃঢ়তা ও ব্যাটের কম্পন পরীক্ষা করে দেখেছেন।
পরীক্ষাতে দেখা গেছে, বাঁশের তৈরি এই বিশেষ ব্যাট তুলনামূলকভাবে বেশি শক্ত। উইলোর চেয়ে তিন গুণ বেশি ধকল নেয় এবং অনেক বেশি ওজন নিতে পারে। তার মানে উইলোর মতো সমান শক্তিশালী ব্যাট বাঁশের ক্ষেত্রে আরও সরু হবে। এর ফলে ব্যাটসম্যানরা আরও জোরে ব্যাট ঘোরাতে পারবেন এবং আগের চেয়ে বেশি শক্তি বলে প্রয়োগ করতে পারবেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উইলোর চেয়ে বাঁশের ব্যাট ২২ ভাগ বেশি দৃঢ়। ফলে ব্যাটের ছোঁয়া লাগার পর বল আরও দ্রুতগতিতে ছুটবে।
থাইল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলা ডক্টর শাহ কেমব্রিজে গবেষণা কাজের পাশাপাশি এখনো স্থানীয় এক দলের হয়ে খেলেন। ক্রিকেটে পিছিয়ে থাকা এক দেশের খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর এই খেলায় নেতিবাচক দিকটা ভালোই জানা আছে।
ক্রিকেট সরঞ্জামের উচ্চমূল্য বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চলে খেলাটার প্রসার হতে দিচ্ছে না। ইংলিশ উইলোর উচ্চমূল্য ব্যাটের ভালো একটা বিকল্প খুঁজতে চাইছেন শাহ, ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিকেট ব্যাটের মূল উপাদান উইলো।’ কিন্তু উইলোর পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করাই কঠিন। ব্যাটের জন্য কাঠ জোগাড় করতে হলে অন্তত ১৫ বছর বয়সী গাছ বের করতে হয়। এর মধ্যে আবার ব্যাট বানানোর সময় ১৫ থেকে ৩০ ভাগ কাঠ নষ্ট হয়।
সে তুলনায় বাঁশ ভালো একটি উপাদান। সহজলভ্য, বিশ্বের সব প্রান্তেই পাওয়া যায়। কাঠের তুলনায় অনেক সস্তা, দ্রুত বাড়ে। বাঁশ কাটার পর আগের শিকড় থেকেই নতুন করে জন্মায় এবং মাত্র সাত বছরেই উপযুক্ত হয়। শাহের চোখে বিশ্বের সব প্রান্তে পাওয়া যায়, এটাই বাঁশের সবচেয়ে বড় গুণ, ‘চীন জাপান বা দক্ষিণ আমেরিকা—নতুন করে যারা ক্রিকেট খেলছে, সেখানেও বাঁশের প্রাচুর্য।’
বিশেষ এই ব্যাট প্রস্তুত করার সময় শক্ত পৃষ্ঠ সৃষ্টি করতে চাপ প্রয়োগ করে সংকুচিত করা হয়েছে বাঁশের উপাদান। পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচ ঘণ্টা পর উইলো ব্যাটের চেয়ে বাঁশের ব্যাটের পৃষ্ঠের দৃঢ়তা দ্বিগুণ বেড়েছে।
ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করবে, বিশেষ এই ব্যাটের ‘সুইট স্পট’। ব্যাটের মাঝ অংশ, যেখানে ঠিকভাবে বল লাগাতে পারাটা ব্যাটসম্যানের দক্ষতা—সেই অংশটা বাঁশের ব্যাটের ক্ষেত্রে আরও বেশি কার্যকর। গবেষণায় ডক্টর শাহ ও টিঙ্কলার-ডেভিস দেখেছেন, বাঁশের ব্যাটের সুইট স্পট ১৯ ভাগ ভালো পারফরম্যান্স করছে উইলোর চেয়ে। কারণ, এই ব্যাটের এই অংশটা উইলোর চেয়ে বেশি বড় (৪ সেন্টিমিটার লম্বা, ২ সেন্টিমিটার চওড়া)। আর সাধারণ ব্যাটের চেয়ে নিচ থেকে আরও কাছে (১২.৫ সেন্টিমিটার) সুইট স্পটটি থাকবে।
ডক্টর শাহের চোখে ব্যাটসম্যানদের এই ব্যাট খুব পছন্দ হবে, ‘এটা ব্যাটসম্যানদের স্বপ্ন। প্রথম কথা বাঁশের ব্যাটের সুইট স্পটের কারণে ইয়র্কারে চার মারা সোজা হবে। এটা অন্য সব শটের জন্যও বেশ আকর্ষণীয় হবে। শুধু টেকনিক একটু মানিয়ে নিতে হবে আর ব্যাটের ডিজাইন একটু ভালো হতে হবে।’
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ব্যাটে বল লাগার পর ব্যাটসম্যানের হাতে যে ঝাঁকুনি লাগে, সেটা দুই ধরনের ব্যাটের ক্ষেত্রেই একই। ফলে বাঁশের ব্যাট দিয়ে খেলার কারণে বাড়তি ক্লান্তিতে ভুগতে হবে না ব্যাটসম্যানকে।
তবে ঝামেলা করছে ক্রিকেটের আইন। আইনে সরাসরি বলা আছে, ক্রিকেট ব্যাট অবশ্যই কাঠ দিয়ে বানাতে হবে। ফলে বাঁশের ব্যাট দিয়ে আপাতত প্রীতি ম্যাচেই হয়তো খেলা সম্ভব। এ উদ্যোগকে উৎসাহ দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রভাষক মার্ক মিওডোনিক। তবে এই উপাদান গবেষক ও প্রকৌশলী এটাও বলেছেন, ‘উইলোর চেয়ে বাঁশ বেশি পাওয়া যায় বলেই যে এটা বেশি টেকসই হবে এমন নয়। পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময়কাল, প্রলেপের রেজিনের উৎপাদন এবং মেয়াদ মাথায় রাখতে হবে। রেজিন কী প্রাকৃতিকভাবে নষ্ট নয়? যদি না হয়, তাহলে এই নতুন উপাদান এলবিডব্লু হবে (বাতিল হবে)।’