ভদ্রলোকের খেলায় পানি টানা অসম্মানের?

‘ওয়াটার বয়’ ধোনিছবি: টুইটার

ক্রিকেটে ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’ নামে একটা ব্যাপার আছে। একাদশের কোনো খেলোয়াড় মাঠের বাইরে চলে গেলে তাঁর জায়গায় ফিল্ডিং করাই তাঁর মূল কাজ। তবে এর বাইরে ড্রেসিং রুম থেকে ব্যাটসম্যানদের কাছে বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়া, পছন্দসই ব্যাট, গ্লাভস এনে দেওয়াও তাঁর কাজ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর একটা বড় কাজ আছে। সেটি ‘পানি টানা’।

দলের খেলোয়াড়দের তৃষ্ণা নিবারণের কাজটা যে খুব ফেলনা কিছু নয়, সেটা সবাই জানেন। ক্রিকেট যখন ব্যাট আর বলের লড়াই, তখন মাঝেমধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে খেলাটি ভদ্রলোকের খেলা হয়ে ওঠে আরও অনেক কিছুকে সঙ্গী করে। এ খেলাতে দুই দলের এগারো জন ক্রিকেটার যখন মাঠের লড়াইয়ে অবতীর্ণ, তখন আরও দুজনের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা হচ্ছেন দুই দলের দুই ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’।

এই দ্বাদশ খেলোয়াড়টির ওপর দর্শকদের খুব কম নজরই থাকে। নজর দেওয়ার কিছু তো নেই, তিনি তো আর একাদশের কেউ নন, মাঠের ওই ব্যাট-বলের লড়াইয়ে তো আর তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু অনেক সময় দ্বাদশ ব্যক্তি হওয়াটাও কোনো কোনো খেলোয়াড়ের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। একবার ভাবুন তো কোনো খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে মাঠে ফিল্ডিং করতে নেমে ওই দ্বাদশ খেলোয়াড় যদি দুর্দান্ত ফিল্ডিং করেন, দারুণ একটা ক্যাচ ধরেন, তাহলে তো স্পটলাইটটা খুব দ্রুতই তিনি তাঁর দিকে ফেরাতে পারেন। সাধারণত দলে নতুন সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়েরা অন্তত দ্বাদশ খেলোয়াড় হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। দ্বাদশ খেলোয়াড় হওয়া মানেই তো মাঠে প্রবেশের সুযোগ, নিজেকে অল্প হলেও নিজেকে মেলে ধরার উপলক্ষ।

এ বছরের গোড়াতেই দেখা গেছে দৃশ্যটি।
ছবি: টুইটার

কিন্তু এর পরেও কথা থেকে যায়। সতীর্থদের জন্য পানি টানার কাজটা তরুণ কিংবা সদ্য দলে সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটাররাই করবেন—এমন একটা ধারণা খুব ভালোভাবেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মাথায় গেঁথে গেছে। কেবল ক্রিকেটপ্রেমীই নন, অনেক সময় ক্রিকেট সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে দাঁড়ায় এই ধারণা। চিন্তাটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে দলের কোনো সিনিয়র খেলোয়াড় যদি কাজটা করেন, কিংবা তাঁকে দিয়ে যদি কাজটা করানো হয়, তাহলে রীতিমতো হইহই রইরই পড়ে যায়—এই বুঝি ওই সিনিয়র ক্রিকেটারের জাত গেল, পানি টানিয়ে কোনো সিনিয়র ক্রিকেটারকে বুঝি অসম্মান করা হলো।

এই তো কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে সতীর্থদের জন্য মাঠে পানি নিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদকে নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটারই এমনটায় নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সরফরাজের মতো একজন সিনিয়র ক্রিকেটারকে দিয়ে পানি টানিয়ে পাকিস্তানি টিম ম্যানেজমেন্ট নাকি অন্যায় আচরণ করেছেন। সাবেক অধিনায়ক রমিজ রাজা তো সরফরাজকে এমন কাজ এড়িয়ে যাওয়ার উপায়ও বাতলে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজটা কি সত্যিই অসম্মানের? একজন সিনিয়র ক্রিকেটার একাদশের বাইরে থাকলে কি অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কোনো ক্রিকেটারের জন্য পানি, কিংবা গ্লাভস বা টাওয়েল-ব্যাট ইত্যাদি নিয়ে যেতে পারেন না?

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের হাতে পানির কার্ট।
ছবি: টুইটার

ব্যাপারটা যে অসম্মানের নয়, সেটি যুগে যুগে প্রমাণ করেছেন অনেক বড় বড় তারকাই। এ বছরের শুরুর দিকেই তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল এ মুহূর্তে ক্রিকেট দুনিয়ার দুই সেরা ক্রিকেটার বিরাট কোহলি আর কেন উইলিয়ামসনকে ‘পানি টানা’ ভূমিকায় দেখে। বাউন্ডারি লাইনের বাইরে এই দুই ক্রিকেটার পানির বোতল নিয়ে বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন, আম্পায়ারের সংকেতের; এমন ছবি রীতিমতো ভাইরাল হয়েছিল। কেবল এটিই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসে বড় বড় সব তারকারাই তাঁদের তারকাখ্যাতির তুঙ্গে থেকে ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’ হয়েছেন। আনন্দের সঙ্গে পানি নিয়ে মাঠে গিয়েছেন এমন ক্রিকেটারদের জন্য, যারা সামর্থ্যে, অভিজ্ঞতায় তাঁদের ধার কাছ দিয়েও যান না।

কোহলিকে একাধিকবার এ ভূমিকায় দেখা গেছে। ২০১৭ সালেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের একটি টেস্টে সামান্য চোটের কারণে মাঠের বাইরে ছিলেন। কিন্তু ড্রেসিং রুমে চুপচাপ বসে থাকাটা তাঁর ভালো লাগেনি। পানির বোতলের কার্ট হাতে নেমে গিয়েছিলেন মাঠে। হাসিমুখে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি সতীর্থ-সেবার কাজটা দারুণ উপভোগ করছেন। কেবল কোহলি কেন, মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে শুরু করে, শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, এমনকি স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও ‘পানি টানা’র কাজটা করেছেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে। গ্রেট ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত তারকাখ্যাতির চেয়েও এ কাজ করে বড় করে দেখেছেন দলের স্বার্থ। ভদ্রলোকের খেলার ব্যাপারটি তো ছিলই, এমন ভূমিকায় তাঁরা বড় করে সামনে তুলে ধরেছেন দলীয় খেলার ক্রিকেটের দলগত ঐক্য বা টিমম্যানশিপের ব্যাপারটি।

সতীর্থদের জন্য পানি টানতে আপত্তি ছিল না শচীন টেন্ডুলকারেরও
ছবি: টুইটার

সবাইকে ছাপিয়ে পানি টানাকে দারুণ মহিমান্বিত করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। ২০১৯ সালে ক্যানবেরার মানুকা ওভাল এমন এক দৃশ্য দেখেছিল, যার জন্য প্রস্তুতি ছিল না কারওরই। সফরকারী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী একাদশের এক প্রস্তুতি ম্যাচে মরিসন মাঠে নেমে পড়লেন পানির বোতলের কার্ট হাতে। প্রধানমন্ত্রী একাদশে থাকা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররাও ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন! প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। দেশের সরকারপ্রধান তাঁদের জন্য পানি নিয়ে এসেছেন! ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিল না তাঁদের। কিন্তু মরিসন হাসিমুখে মাঠে প্রবেশ করে খেলোয়াড়দের পানি খাওয়ালেন। অবতারণা হলো চমৎকার এক দৃশ্যের। সংস্কার ভেঙে তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন মানবিকতাবোধ আর বিনয়ের দৃষ্টান্ত।

মানবিকতাবোধ, বিনয়—এই জিনিসগুলো কেবল ক্রিকেট কেন, সব খেলারই অংশ, এগুলোকে কেউ খুঁজে পায়, কারও কারও আবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।