‘ভারতীয় পেট লিগ’ ফিটনেসে পাশ নম্বর পাবে?

রোহিতের পেট ও কোমর স্ফীত হলেও ব্যাটে রান পাচ্ছেন তিনি।ছবি: টুইটার

ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আন্তোনিও কাসানো নামটা অপরিচিত লাগতে পারে। রগচটা মেজাজের সঙ্গে প্রতিভারও কমতি ছিল না ইতালিয়ার সাবেক এ স্ট্রাইকারের। পর্যাপ্ত ছিল আরও একটি বিষয়—ঠিক পর্যাপ্ত নয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলাই শ্রেয়। ওজন।

হ্যাঁ, অতিরিক্ত ওজন নিয়ে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়জুড়ে কথা শুনতে হয়েছে এএস রোমা, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানের সাবেক এ ফুটবলারকে। নিজের আত্মজীবনি ‘ডিকো তুত্তো’তে তিনি লিখেছিলেন, ‘যখন আমি পাস্তা, রুটি, মিষ্টান্ন ও হ্যাম খাই তখন নিজেকে সুখি লাগে...ভালো খাবার খেলে তো মোটা হবেনই।’ এসি মিলান তাঁকে সাফ বলে দিয়েছিল, খেলতে হলে ওজন কমাতে হবে।

আইপিএলে ক্রিকেটারদের এমন করে বলার কেউ আছে?

এবার আইপিএলে ব্যাপারটা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু—কিছু ক্রিকেটারকে ঠিক অ্যাথলেটিজমের চূড়ামণি বলা যাচ্ছে না। এমনকি সাধারণ মানদণ্ডের মধ্যেও নেই। পেট ও কোমরের অংশ দৃষ্টিকটুরকমের স্ফীত। ভারত হকি দলের সাবেক অধিনায়ক বীরেন রাসকুইনহা এ নিয়ে টুইট করেছিলেন, ‘গলির ক্রিকেটে খেলেছি। কিন্তু এবার আইপিএলে কিছু খেলোয়াড়কে দেখে আমি স্তম্ভিত, আনফিট লাগছে। আর কোনো শরীরনির্ভর খেলা দেখিনি যেখানে ফিটনেসের এ অবস্থা নিয়ে খেলোয়াড়েরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াই করে থাকে।’

মহেন্দ্র সিং ধোনির ফিটনেস বরাবরই ভালো। যদিও এবার আইপিএলে আগে তিনি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেননি।
ছবি: টুইটার

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, ক্রিকেটে কি ‘সিক্স প্যাক’ শরীরওয়ালা খেলোয়াড় না হলেই নয়? ফুটবলে যেমন দেখা যায় আরকি। সবার সিক্স প্যাক না হলেও অন্তত ফিটনেসের একটা সাধারণ মানদন্ড ধরা–বাঁধা থাকে। ডেভিড বুন, ইনজামাম–উল–হক কিংবা অর্জুনা রানাতুঙ্গাদের যুগ শেষ হয়েছে। এখন বিরাট কোহলিদের মতো ছিপছিপে ক্রিকেটারদের সময়। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের শরীর এভাবেই পাল্টে গেছে কিংবা যাচ্ছে।

একটা সময় ছিল যখন মাঠে টিকে থাকাটাই ছিল ফিটনেসের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখন খেলাটা ফিটনেসের দিক থেকে এগিয়েছে আরও এক ধাপ। এখন ক্রিকেটাররা আগের চেয়ে বেশি ফিট, দ্রুতগামী এবং শক্তিশালি। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের সাবেক কোচ লালচাঁদ রাজপুতের ভাষায়, ‘এখন টিকে থাকতে অ্যাথলেটিজম ও দক্ষতা—দুটোই লাগে।’

এই অ্যাথলেটিজমের প্রশ্নেই কিছুদিন ধরে অনলাইনে রসিকতা চলছে। নেটিজেনরা আইপিএলের নাম দিয়েছেন—‘ভারতীয় পেট লিগ।’ খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে পর্যন্ত টুইট করেছিলেন,‘কিছু স্বাস্থ্যকর কোমর দেখতে পাচ্ছি...।’

রোহিত শর্মা কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনিদের পেট ও কোমরটা ঠিক তাদের দক্ষতা ও নামের সঙ্গে যায় না। পরিসংখ্যান বলছে, টেস্টে ফাস্ট বোলাররা ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়ান, ওয়ানডেতে ১২ থেকে ১৫ কিলেমিটার। জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের ফিটনেসের দিক থেকে প্রস্তুত করতে অনুশীলনে তাদের শরীরে জিপিএস ‘ভেস্ট’ লাগানো হয়। এতে ঠিক তথ্য–উপাত্ত মেলে তাঁদের শারীরিক সামর্থ্যের। ফিটনেস ধরে রাখার আধুনিক যন্ত্রপাতি চলে আসায় বিপ কিংবা ইয়ো ইয়ো টেস্ট এখন অতীত। এমনকি মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও সাঁতার ও জিমে কসরত করে থাকেন ক্রিকেটাররা।

প্রাক–মৌসুমের ফিটনেস অনুশীলন এখন অনেকটাই এমন—৪৫ থেকে ৬০ মিনিট স্ট্রেংথ ও কন্ডিশনিং সেশন, এরপর এক থেকে দুই ঘন্টা দক্ষতা অনুশীলন এবং তারপর ৩০ থেকে ৪০ মিনিট জিমে অনুশীলন। কলকাতা নাইট রাইডার্স এ জন্য অলিম্পিক স্প্রিন্টার ক্রিস ডোনাল্ডসনকে স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। অধিনায়ক দিনেশ কার্তিকের ভাষায়, ‘এমনকি কোয়ারেন্টিনেও সে আমাদের বিশ্রাম দেয়নি।’ মাঠে নামার শর্ত হিসেবে ক্রিকেটারদের যদি এতটাই ফিট হতে হয়, তলপেটের মেদ যদি ঝরাতে হয়, তাহলে কোমর স্ফীত হচ্ছে কেন?

সহজ উত্তর—করোনাভাইরাসে আরোপিত আলস্য। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে তো মাঠে খেলা গড়ায়নি। দীর্ঘ কয়েক মাস ঘরে বসে বেকার বসে থাকতে হয়েছে খেলোয়াড়দের। অনেকে নিজ উদ্যোগে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সেটি মোটেও সাধারণ সময়ের মতো হওয়ার কথা নয়। এতে খেলোয়াড়দের শরীরটা নিয়ন্ত্রণের একটু বাইরে চলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

কলকাতার কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ভাষায়, ‘খেলোয়াড়দের শারীরিক গড়ন নিয়ে কিছু বলব না। আমার মনে হয় কোভিড–১৯ ভাইরাসের এ সময়ে ক্রিকেটবিশ্বের সব জায়গাতেই এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।’

ট্রেন্ট বোল্টের কথাই ধরুন। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের এ পেসার আইপিএলের জন্য যে প্রস্তুতি নিয়েছেন তাকে কোনোভাবেই আদর্শ বলা যায় না। মুম্বাই–কলকাতা ম্যাচের আগে বোল্ট জানান, নিউজিল্যান্ডের শীত ও লকডাউন মিলিয়ে প্রায় ছয় মাস বসে থাকার পর আইপিএলে খেলতে এসেছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটারদের এমন সময় কেটেছে চার মাস।

ঘরে যে যাঁর মতো ফিট থাকার চেষ্টা করলেও মাঠে খেলা না থাকায় ফিটনেসের প্রস্তুতিটা মোটেও আদর্শ হয়নি। দিল্লি ফ্র্যাঞ্চাইজির সাবেক স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ ভৈভব দাগা জানালেন, ঘরোয়া অনুশীলনে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করা আর সতীর্থদের সঙ্গে তা করার মধ্যে বেশ ফারাক আছে, ‘ক্রিকেট দলীয় খেলা। ফিটনেসের কাজটা তাই দলগতভাবেই আদর্শ হয়।’ দিনেশ কার্তিক আরেকটু ব্যাখ্যা করলেন, ‘সবাই মিলে করা অনুশীলনে নিজের সামর্থ্যকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টাটা একটু বেশিই হয়। একা করলে তাগিদটা সব সময় থাকে না।’

ভারতে জিমনেসিয়ামগুলো খুলেছে এ মাসে। সুইমিং পুল এখনো বন্ধ। এদিকে আইপিএল খেলতে খেলোয়াড়েরা এখন আরব আমিরাতে। অর্থাৎ প্রস্তুতির সময় এসব সুবিধা পাননি তারা। দাগার মতে, অনেক খেলোয়াড়ই ট্রেডমিলে কসরত করতে চান না। তাঁরা দলগত অনুশীলন পছন্দ করেন। কিন্তু (লকডাউনে) সেটা সম্ভব হয়নি।

ক্রিকেটে তিন সংস্করণে শারীরিক সামর্থ্যের পরীক্ষা আলাদা আলাদা। কোথাও দ্রুতগতি ও শক্তি বেশি লাগে কোথাও আবার নমনীয়তা ও টিকে থাকার সামর্থ্যের প্রয়োজন হয়। রাজস্থান রয়্যালসের স্ট্রেংথ ও কন্ডিশনিং কোচ জন গ্লুস্টারের মতে, টেস্ট সিরিজ খেলে আসা ক্রিকেটার টি–টোয়েন্টিতে ২০ শতাংশ কম প্রস্তুত থাকেন।

সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসকে গ্লুস্টার বলেন, ‘জিপিএসের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার রুলস ফুটবলে একজন খেলোয়াড় নির্দিষ্ট গতিতে যে পরিমাণ দৌড়ান তা আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টির চেয়ে কম কিংবা বেশি নয়।’ টি–টোয়েন্টিতে শক্তি ও গতি দুটোই লাগে—এ কারণে ক্রিকেটারদের জিমে সময় দেওয়ার পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।

ক্রিকেট তো ফুটবলের মতো অহর্নিশ দৌড়ানোর খেলা নয়। থেমে থেমে দৌড়ানোর খেলা। তাই স্ফীত কোমর থাকলেই সেই খেলোয়াড়টি ম্যাচ খেলার মতো ফিট নন—ভেবে নেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। কলকাতার বিপক্ষে রোহিতের ৫৪ বলে ৮০ রানের বিস্ফোরক ইনিংস তার প্রমাণ। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের ফিজিও অ্যান্ড্রু লেইপাস মনে করেন, শুধু ছিপছিপে হলেই তাকে ফিট ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়।

তবে একটু আনফিট শরীর চোটের প্রবণতা বাড়াতে পারে। এবার আইপিএলে বাজে ফিল্ডিং কিন্তু একেবারে কম দেখা যাচ্ছে না। বিরাট কোহলির মতো ফিট খেলোয়াড় এক ম্যাচে দু–দুটো ক্যাচ ছেড়েছেন। লালচাঁদ রাজপুতের ভাষায়, ‘ফিল্ডিং দল হিসেবে আমরা প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ ক্যাচ ধরি। এটা (লকডাউনে) হয়নি। টি–টোয়েন্টিতে আগে অ্যাথলেট হতে হয়।’

অ্যাথলেটিজমের প্রশ্নে এবারের আইপিএল কি পার্শ মার্ক পাবে?