ভারতীয় বোলারদের নাচিয়ে ছাড়ল ইংল্যান্ড

বেয়ারস্টো-স্টোকসের ১৭৫ রানের জুটি ম্যাচ শেষ করে দিয়েছে।ছবি: এএফপি

‘আশ্চর্য, ওরা রেগে গেল কেন?’

‘আজ রবিবার’ নাটক থেকে ধার করে এ ডায়ালগ দেওয়ার দশা হয়েছিল ভারতীয় বোলারদের। ৩০ ওভার পর্যন্ত ম্যাচে ভালোভাবেই ছিল ভারত। ১ উইকেটে ১৯৪ রান ইংল্যান্ডের। ওভারপ্রতি ৭ এর বেশি করে দরকার ইংল্যান্ডের। প্রথম ওয়ানডেতেও ঝোড়ো শুরু করে পরে ৯ উইকেট হাতে থাকা অবস্থায় ওভারপ্রতি ৬ রান তুলতে পারেনি ইংল্যান্ড। আজও যে এমন কিছু হবে না কে জানে? তাই ম্যাচে ভালোভাবেই ছিল ভারত।

সে ভাবনাটা পরের পাঁচ ওভারে উবে গেছে বেধড়ক পিটুনিতে। শুরুটা করেছেন জনি বেয়ারস্টো। কুলদীপ যাদবকে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে তুলে মেরে সেঞ্চুরি পেয়ে গেলেন বেয়ারস্টো। এর পরেরটুকু বেন স্টোকস শো। কুলদীপকে ওই ওভারে এক চার ও ছক্কা মারলেন। সেই কুলদীপেরই প্রথম ওভারে টানা তিন বলে তিন ছক্কা স্টোকসের। ক্রুনাল পান্ডিয়ার পরের ওভারে তিন ছক্কা ও এক চারে স্টোকস তুললেন ২৮ রান! প্রসিধ কৃষ্ণর পরের ওভারে ১৫ রান তুলে নিলেন বেয়ারস্টো। ৫ ওভারে ৮৭ রান তুলে ম্যাচটা একঝটকায় নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসেছিল ইংল্যান্ড।

এরপর আবার নাটক হলো। মাত্র ২ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে একটু নাটকীয়তা আনার চেষ্টা অবশ্য কাজে দেয়নি। পুনেতে ৩৩৭ রানের লক্ষ্য ইংল্যান্ড ৬ উইকেট ও ৩৯ বল হাতে রেখে পার করেছে। তিন ম্যাচের সিরিজে এখন ১-১ সমতা। আগামী ২৮ মার্চ একই ভেন্যুতে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ খেলবে দুই দল।

ঝড় তুলেছিলেন স্টোকস।
ছবি: এএফপি

ম্যাচটা ওভাবে একপেশে করে আবার জমজমাট বানানো—পুরোটাই স্টোকসের সুবাদে। আগের ম্যাচের মতোই আজও ইতিবাচক ক্রিকেট খেলেছেন জেসন রয়। ৫২ বলে ৫৫ রান করে তাঁর রান আউট হওয়াটা বিপদ ডেকে আনতে পারত। কিন্তু ১১০ রানের উদ্বোধনী জুটির যেভাবে খেলার দরকার ছিল, সেভাবেই খেলেছেন স্টোকস।

আগের ম্যাচের মতো যেন ব্যাটিং ধস না নামে, সেটা নিশ্চিত করেছেন স্টোকস। ইনিংসের গতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। প্রথম ১০ বলে ৬ রান করেছিলেন। পরের ১০ বলে তুলেছেন ১১ রান। রান ও বলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হলো এ পর্যায়ে এসে। ব্যস, পরের ১০ বলে তুলে নিলেন আরও ১৭ রান। ৩২ রানে থাকা অবস্থায় অবশ্য একটা জীবন পেয়েছেন স্টোকস। তৃতীয় আম্পায়ার তাঁকে রান আউট না দিলেও সিদ্ধান্তটা বেশ বিতর্কিত। ৩০ বলে ৩৪ রান থেকে স্টোকস ৫০-এ পৌঁছালেন ঠিক আরও ১০ বল পরে।

স্টোকস ৫০ পেরোনোর আগেই অবশ্য বেয়ারস্টোর সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। আগের ম্যাচে ৬৬ বলে ৯৪ রান করেও দলকে জেতাতে পারেননি। আজ তাই ও রকম সব ছেড়ে–খুঁড়ে ফেলার ঢঙে ব্যাট করেননি। তবু ৩১তম ওভারের প্রথম বলে যখন সেঞ্চুরিতে পৌঁছালেন, তখনো রানের চেয়ে বল সংখ্যা কম ছিল। ৯৫ বলেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম সেঞ্চুরি পেয়েছেন বেয়ারস্টো। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে অবশ্য মাত্র একবারই সেঞ্চুরি ছোঁয়ার সময়ে রানের চেয়ে বল খেলেছেন বেয়ারস্টো।

দারুণ এক সেঞ্চুরি করেছেন বেয়ারস্টো।
ছবি: এএফপি

বেয়ারস্টো তবু মনোযোগ ধরে রাখতে পারেননি কারও। ওদিকে যে স্টোকস ঝড় তুলেছেন। কুলদীপ যাদবের ওই ওভারেই ছক্কা মেরে পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন এই অলরাউন্ডার। পরে ছক্কার হ্যাটট্রিক করেছেন বাঁহাতি লেগ স্পিনারের বলে। কিন্তু তাঁর তাণ্ডব ভালোভাবে টের পেয়েছেন ক্রুনাল পান্ডিয়া। প্রথম ওয়ানডেতে ওয়ানডে অভিষেকটা স্বপ্নের মতো কেটেছে পান্ডিয়া ভাইদের বড়জনের। আজ সেটা দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। ৩৪তম ওভারের প্রথম বল লং অফ দিয়ে উড়ে যেতেই ভড়কে গেলেন ক্রুনাল। পরের বলটা অফের বেশ বাইরে ফেলতে গিয়ে করে বসলেন ওয়াইড। নিজের ওপর চাপ বাড়ল আরও। পরের বলটার রিপ্লে দেখলে লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইবেন।

জোরের ওপর বল করতে গিয়েছিলেন। গতিও বেশ উঠেছিল। ঘণ্টায় প্রায় ১০৯ কিলোমিটার। কিন্তু গতি তুলতে গিয়ে উইকেটের মাঝে বল ফেললেন ক্রুনাল। বলটাকে মিডিয়াম পেসারের শর্ট বল ধরে নিয়ে হাঁকালেন স্টোকস, ৪ রান। পরের বলটাও অনেক বাইরে করলেন জোরের ওপর। ওয়াইড হতে পারত, কিন্তু স্টোকস ব্যাটে লাগিয়ে আরও ২ রান নিলেন। পরের বলে আবার অফের বেশ বাইরে ইয়র্কার দেওয়ার চেষ্টা। এবার আর স্টোকস সে ফাঁদে পা দিলেন না, ওয়াইড। বোলিং অ্যাঙ্গেল বদলাতে রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে বল করলেন। লাভ হলো না কোনো, আবার ছক্কা। পরের বলটাও সীমানা পার হলো উড়ে। ওভারের শেষ বলটাই শুধু ঠিক ব্যাটে বলে হলো স্টোকসের। তবু উইকেটকিপারকে ফাঁকি দেওয়ায় পেয়ে গেলেন ২ রান। এক ওভারেই এল ২৮ রান।

৩৫তম ওভারে কৃষ্ণর বলে বেয়ারস্টোর ঝড় শেষ হওয়ার পর ৩৬তম আবার স্ট্রাইক পেলেন। প্রথম বলেই ভুবনেশ্বরের পাশ দিয়ে বল ছুটে গেল বাউন্ডারিতে। ৪০ বলে ৫০ ছোঁয়া স্টোকসের রান তখন ৯৯। ৫০ পেরোনোর পর বল খেলেছেন মাত্র ১১টি। ৫১ বলে ৯৯ রান, এখন শুধু সেঞ্চুরির অপেক্ষা। ইংল্যান্ডের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড দখলে নেওয়া তখন আর সম্ভব নয়। তবে প্রথম দুটি স্থানে থাকা জস বাটলারের পর তিনে অন্তত থাকতে পারতেন স্টোকস।

প্রতিপক্ষ আজ সেরা দল ছিল, সেটা মেনে নিয়েছেন কোহলি।
ছবি: এএফপি

এরপরই শুরু হলো নাটক। ভুবনেশ্বর কুমারের বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে ঋষভ পন্তের কাছে ক্যাচ দিয়ে দিলেন স্টোকস। সম্ভাব্য এক সেঞ্চুরি এক রানের জন্য হতাশায় রূপ নিল। শেষ ১২ বলে ৬ ছক্কা, ২ চারে ৪৯ রান তুলেছিলেন স্টোকস। এর আগের ৪০ বলেও ছিল ৪ ছক্কা ও ২ চার। স্বর্গের দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলতে বলতে মাঠ ছাড়লেন স্টোকস।

নাটক তখনো শেষ হয়নি। পরের ওভারে আবার বল পেলেন প্রসিধ কৃষ্ণ। আগের ওভারে তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে ১৫ রান আদায় করেছিলেন বেয়ারস্টো। এর প্রতিশোধ নিলেন প্রথম বলেই। মারার মতো বল করেছিলেন। বেয়ারস্টো কভার ড্রাইভটাও খেলেছিলেন ভালো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শটটা কভারে থাকা কোহলি বরাবর ছিল। ১১২ বলে ১১ চার ও ৭ ছক্কায় ১২৪ রান করে ফিরেছেন বেয়ারস্টো।

৮৩ বলে ৫০ রান দরকার ইংল্যান্ডের। হাতে ৭ উইকেট। এ অবস্থায়ও ম্যাচ নিয়ে ভাবনার কিছু ছিল না। কিন্তু ভাবনাটা শুরু করতে বাধ্য করলেন কৃষ্ণ। দারুণ এক ইয়র্কার জস বাটলারকে শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দিল। ২ রানে ৩ উইকেট হারাল ইংল্যান্ড। তবে কি প্রথম ওয়ানডের মতো আবার ধস নামবে? ডেভিড মালান ও অভিষিক্ত লিয়াম লিভিংস্টোন আর নাটক জমাতে দেননি। ৪১ বলে ৫০ রানের জুটিতে ম্যাচটা শেষ করে এসেছেন এই দুজন।

এর আগে ভারত সিরিজের মীমাংসা করে দেওয়ার মতোই এক স্কোর পেয়েছিল। দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান দ্রুত ফিরে যাওয়ার পর ইনিংস গড়েছেন বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। ১২১ রানের জুটি গড়ে কোহলি (৬৬) ৩২তম ওভারে ফিরে যাওয়ার পরও কক্ষচ্যুত হয়নি ভারত; বরং ঋষভ পন্তকে সঙ্গী পেয়ে রাহুল আরও আগ্রাসী হতে পেরেছেন। ৭৭ বলে ১১৩ রানের জুটি গড়েছেন দুজন। দলকে ২৭১ রানে রেখে ফিরে গেছেন রাহুল (১০৮)। পন্তের ৪০ বলে ৭৭ ও হার্দিক পান্ডিয়ার ১৬ বলে ৩৫ রানে ৬ উইকেটে ৩৩৬ রান তুলেছিল ভারত। তখন লক্ষ্যটাকে পাহাড় বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ৩৯ বল হাতে রেখে ইংল্যান্ডের এভাবে জয় পাওয়া সে ভাবনাকে বড় ভুল বলেই প্রমাণ করল।