ভারতের সর্বকালের সেরা এ জয়?

অনন্য এক জয়।ছবি: এএফপি

ব্রিসবেনে নামার আগে কত কথাবার্তা। প্রায় দেড় মাসের সফর শেষে ক্লান্তশ্রান্ত ভারত ব্রিসবেনের কড়া নিয়মে আর থাকতে চাইছিল না। রাজ্য সরকারের বেঁধে দেওয়া কড়া কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মানতে আপত্তি ছিল তাদের। এ কথা বলায় অস্ট্রেলিয়ান সাবেক ক্রিকেটাররা বললেন, হারের ভয়েরই এত অজুহাত সৃষ্টি করছে ভারত। মেলবোর্নে জিতে তখন মাত্রই সিরিজে সমতায় ফিরেছে ভারত। সিডনির মহাকাব্যিক সে লড়াকু ড্র তখনো দেখা যায়নি।

৩২ বছর ধরে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়াকে কেউ হারাতে পারেনি। সর্বশেষ যারা হারিয়েছিল, তারা ছিল অন্য গ্রহের দল, সেই প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্যাবার উইকেটে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়া সব ফাস্ট বোলারে ভর্তি সে দলের পর অস্ট্রেলিয়ার এই মাঠ থেকে কেউ জয় নিয়ে ফেরেনি। ভারত তো ইতিহাসেই কখনো এ মাঠে জয় পায়নি। তাই খোঁটাটা পরিষ্কার, হারের ভয়েই ব্রিসবেনে যেতে চাইছে না ভারত।

দুই সপ্তাহ আগের সেসব কথাবার্তাকে বড্ড খেলো বানিয়ে দিয়েছে ভারত। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ ভারত দলে খেলা এগারোজনের আটজনই হয়তো থাকতেন না মাঠে। এতটাই দুর্বল এক দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গে খেলতে নেমেছিল ভারত। পাঁচ দিনের এক দুর্দান্ত লড়াই শেষে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল সেই ‘ভয়ে খেলতে রাজি না হওয়া’ ভারত। যে জয়কে ভারতের সেরা জয় বলেই মনে করছেন অনেকেই।

অস্ট্রেলিয়াকে অসহায় বানিয়ে দিয়েছে ভারত।
ছবি: এএফপি

সফরটা ভারত শুরু করেছিল ব্যাক ফুটে। সফর শুরু হয়েছে মূল পেসার ইশান্ত শর্মাকে ছাড়া। এই ইশান্তই এক যুগ আগে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ দুর্গ জয় করেছিলেন। ইশান্তের সঙ্গে অনুপস্থিতির তালিকা ভারী করলেন রোহিত শর্মাও। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে টেস্ট শুরু হতেই ধাক্কা। প্রথম ইনিংসের ভালো শুরুটা শেষ হলো নিজেদের সর্বনিম্ন ইনিংসের ধাক্কায়। অ্যাডিলেডে ৩৬ রানের ধাক্কা তো ভারত দলকে নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল।

প্রথম টেস্ট শেষেও যে ধাক্কা শেষ হয়েছে, তা নয়; পিতৃত্বকালীন ছুটিতে দেশে ফিরেছেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। শুধু অধিনায়কের বিদায়ই তো নয়, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজেদের সেরা ব্যাটসম্যানের সেবা থেকেও বঞ্চিত হলো অস্ট্রেলিয়া। সঙ্গে ফিরলেন মোহাম্মদ শামিও। মূল ব্যাটসম্যান ও সেরা তিন পেসারের একজনকে ছাড়াই মেলবোর্নে নামল ভারত। সেখানে টেস্ট দলের উপস্থিত পেসারদের মধ্যে সেরা উমেশ যাদবও চোটে পড়লেন! যাদবকে ছাড়াই রবীন্দ্র জাদেজার বীরত্বে মেলবোর্ন জয় করল ভারত। কিন্তু এর জন্য চড়া মূল্যও দিল দল। চোট কেড়ে নিল যাদব, জাদেজা ও উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ফর্মে থাকা লোকেশ রাহুলকে।

তৃতীয় টেস্টও কম পরীক্ষা নেয়নি ভারতের। সিডনিতে হার নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও হনুমা বিহারি দলকে হারতে না দেখার প্রতিজ্ঞা করলেন। দলে নিজেকে টিকিয়ে রাখার ক্ষুধাটা কী চমৎকারভাবেই না ব্যবহার করলেন দুজন। পুরো দুটি সেশন সিডনির পঞ্চম দিনের উইকেটে লড়াই চালিয়ে গেলেন। জয়ের সমান এক ড্র এনে দিলেন দলকে। কিন্তু এমন এক ম্যাচও দাগ ফেলে গেল। দলের ফিল্ডিংয়ের সময়ই চোট পেয়েছিলেন যশপ্রীত বুমরা। দেশে ফেরার পরই ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ। তাই পেস বোলারদের স্বর্গে দলের সেরা পেসারকে নিয়ে নামেনি ভারত।
ওদিকে দলের হার এড়ানোর সেসব ইনিংসের আগেই চোট পেয়েছিলেন বিহারি ও অশ্বিন। মহাকাব্যিক দুই ইনিংস শেষে যখন বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়লেন, ততক্ষণে চতুর্থ টেস্ট থেকে নাম কাটা পড়ে গেছে তাঁদের।

ফলে ব্রিসবেনের দল যখন ঘোষণা করা হলো, তখন জানা গেল চার টেস্টই খেলেছেন, এমন খেলোয়াড় মাত্র দুজন—অধিনায়ক অজিঙ্কা রাহানে ও চেতেশ্বর পূজারা। টি-টোয়েন্টি খেলে আর বাকি সময় নেটে বল করে দেশে ফেরার কথা ছিল যাঁর, সেই নটরাজনের টেস্ট অভিষেক করতে বাধ্য হয়েছে ভারত। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও যাঁকে দেখা যায় না, সেই ওয়াশিংটন সুন্দরও নেমে গেলেন।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টানা দুই সিরিজ জিতল ভারত।
ছবি: এএফপি

এই দুই অভিষিক্তের সঙ্গে আর যাঁরা ভারতের বোলিং লাইনআপ সাজিয়েছেন, তারা হলেন মোহাম্মদ সিরাজ, নবদীপ সাইনি ও শার্দুল ঠাকুর। তাঁদের অভিজ্ঞতা? এই সিরিজেই মেলবোর্নে অভিষেক হয়েছে বাবা হারানো সিরাজের। সিডনিতে অভিষেক হয়েছে সাইনির। আর দুই বছর আগে টেস্ট অভিষিক্ত ঠাকুরের টেস্ট বোলিং অভিজ্ঞতা ছিল ১০ বলের!

এত অনভিজ্ঞ বোলিং লাইনআপ নিয়ে ভারত সর্বশেষে ৭০ বছরে খেলেনি। সে দলই নেমেছে ব্রিসবেনে। যেখানে বোলাররাই ম্যাচ বদলে দেন। যে উইকেটে গতির ঝড় তোলেন সবাই, সেখানে ভারতের পেসারদের বল মধ্য আশি পেরোতেও হিমশিম খায়। এক টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট স্পিনারের অভিষেক হলো পেসবান্ধব ব্রিসবেনে! ব্যাটিং লাইনআপেও ব্যাটসম্যানদের চেয়ে টেল এন্ডারদের দক্ষতা বেশি বলে ভ্রম হয়। এই ভারতকে তাই হারের ভয়ের খোঁচা দেওয়াই যায়।

কিন্তু এভাবে স্কোয়াডের শেষ সদস্যদের গড়া দলটিও ফেবারিট অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিল। কারণ, কিছু করে দেখানোর ক্ষুধাটা এ দলেরই বেশি ছিল। ভয়ংকর বিরুদ্ধ পরিবেশেও লড়াই করতে জানার সাহস থাকলে যে সবকিছু অর্জন করা সম্ভব। টেস্ট ক্রিকেট সাহসিকতার পরীক্ষা নেয়। একজনের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে। ব্রিসবেনে চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা আর নিবেদনে একটি দলই এগিয়ে ছিল। আর দিন শেষে তারাই জয়ী। এ জয়কে ভারতের সেরা জয় বলা তাই বাহুল্য বলে ঠেকে না।